অধ্যাপক এ. বি. এম. ফজলুল করীম
বিশ্ব শিক্ষক দিবসের সূচনা ও তাৎপর্য : বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয় প্রতি বছর ৫ অক্টোবর। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো (UNESCO)-এর উদ্যোগে দিনটিকে বিশ্বব্যাপী শিক্ষক সমাজের মর্যাদা, অধিকার ও দায়িত্বের প্রতীক হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এর পেছনে রয়েছে ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ঘটনা-যখন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এবং ইউনেস্কো যৌথভাবে ‘Recommendation concerning the
Status of Teachers’ শীর্ষক এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল-
শিক্ষকদের ন্যায্য বেতন-ভাতা, পেশাগত স্বাধীনতা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মপরিবেশের মানোন্নয়ন, এবং সর্বোপরি, শিক্ষার মান উন্নত করার মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়া।
বাংলাদেশে ১৯৯৪ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর এ দিবসের আলাদা থিম বা স্লোগান থাকে। ২০২৫ সালের স্লোগান- ‘শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান’-যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে শিক্ষকের ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করা মানেই জাতির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়া।
শিক্ষকের ভূমিকা : জাতির বিবেক থেকে জাতি নির্মাতা : একজন শিক্ষক শুধু পাঠদান করেন না; বরং তিনি আলোকিত মানুষ তৈরি করেন। শিক্ষকের হাতে গড়ে ওঠে- নৈতিক চরিত্রবান প্রজন্ম, সমাজ সচেতন নাগরিক, দেশপ্রেমিক তরুণ এবং সৃজনশীল মননশীল নেতৃত্ব। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে দেন- গভীরভাবে চিন্তা করতে, তথ্য বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে, সহযোগিতার মাধ্যমে দলগত কাজ করতে এবং মানবিক গুণাবলীকে জীবনে ধারণ করতে। তাই শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করা মানেই একটি সভ্য জাতি নির্মাণ।
বাংলাদেশে শিক্ষকদের বর্তমান বাস্তবতা
১. সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধা পেলেও এখনো রয়েছে- গবেষণা বরাদ্দের অভাব, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতি, আবাসনের সংকট এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে অসামঞ্জস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষকরা গবেষণার মাধ্যমে বৈশ্বিক অবদান রাখতে পারতেন, কিন্তু পর্যাপ্ত গবেষণা তহবিল ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা না থাকায় তাঁদের সামর্থ্য সীমিত হয়ে যায়।
২. বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাঁদের সমস্যাগুলো আরও গুরুতর- সরকারিভাবে নির্ধারিত বেতন স্কেলের সাথে বৈষম্য, সীমিত ভাতা ও পেনশনের অনুপস্থিতি, অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মিত বেতন প্রদান এবং ম্যানেজিং কমিটির অযাচিত হস্তক্ষেপ। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা বরাদ্দ, বিদেশ প্রশিক্ষণ, এবং সম্মানজনক সুযোগ-সুবিধা এখনো অপ্রতুল।
৩. এমপিওভুক্ত ও নন-এমপিও শিক্ষক : এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ও বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। নন-এমপিও শিক্ষকরা নিয়মিত বেতনই পান না; তাঁদের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটছে। তাদের চাকুরী আছে বেতন নেই।
৪. মাদ্রাসা শিক্ষা : বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করে। কিন্তু এখানকার শিক্ষকরা অবহেলিত। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলো অবিলম্বে এমপিওভুক্ত বাস্তবায়ন করা। অনার্স-মাস্টার্স চালুর অনুমতি অল্প কিছু মাদ্রাসায় সীমাবদ্ধ থাকবেনা।
আধুনিক কারিকুলাম ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার পর্যাপ্ত করতে হবে। তবে ইতিবাচক দিক হলো-আলীয়া মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগ চালু হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করছে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ : আমাদের অবস্থান কোথায়? : অনেক দেশেই শিক্ষকরা ‘জাতি নির্মাতা’ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পান। যেমন-ফিনল্যান্ডে শিক্ষক পেশাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়; সেখানে শিক্ষক হতে হলে কঠিন বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। জাপানে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান অত্যন্ত উচ্চ। দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষকরা প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে সর্বদা আপডেটেড থাকেন। বাংলাদেশ যদি বৈশ্বিক মানের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়, তবে শিক্ষকদের বেতন, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও সামাজিক মর্যাদা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে।
করণীয় : শিক্ষকদের জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের করণীয় : বেতন-ভাতা ও সুবিধার সমতা আনয়ন সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূর করতে হবে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা নিশ্চিত করা। নন-এমপিও শিক্ষকদের দ্রুত এমপিওভুক্ত করতে হবে।
গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সুযোগ বৃদ্ধি করা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা তহবিল বৃদ্ধি। দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষকতা দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা করা।
জাতীয়করণ ও মানোন্নয়ন : মানসম্মত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাকে ধাপে ধাপে জাতীয়করণ। কারিগরি শিক্ষা ও মাদ্রাসায় অনার্স-মাস্টার্স চালু করা। সামাজিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে শিক্ষকদের সম্মানজনক আসনে বসাতে হবে। গণমাধ্যমে শিক্ষকদের ইতিবাচক ভূমিকা প্রচার করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার উন্নয়ন এবং শিক্ষক আবাসন নিশ্চিতকরণ, চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, পরিবহন সুবিধা প্রদান এবং অবসর-ভাতা চালু করা।
উপসংহার : ‘শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান’-এ স্লোগানটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শিক্ষক পেশার মর্যাদা রক্ষা করা জাতি গঠনের প্রধান শর্ত। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মানসম্মত ও বিশ্বমানের করতে হলে শিক্ষকদের পেশাগত সমস্যা সমাধান, বেতন-ভাতার বৈষম্য দূর, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে হবে।
একজন শিক্ষক যদি সঠিকভাবে মূল্যায়িত হন, তবে তিনি তাঁর মেধা ও দক্ষতাকে সহজেই শিক্ষার্থীদের মাঝে সঞ্চার করতে পারবেন। আর শিক্ষার্থীই হবে ভবিষ্যতের সৎ, আদর্শবান, আলোকিত নাগরিক। ২০২৫ সালে শিক্ষকদের প্রতি আহবান-জাতি গঠনের এ অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দেওয়া হোক।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশন