প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনে অতটা সক্রিয় না হলেও কুরআন-হাদিসের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কিছু বললে বা করতে চাইলে তারা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে এবং ঈমানের দাবি অনুসারেই তারা সেটি করে। দেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে এমন সময়ে দাউদ হায়দার কবিতায় একই সাথে গৌতম বুদ্ধ, যিশুখৃষ্ট ও মুহাম্মদ (সা.)-কে গালি দিলে বাংলাদেশ ফুঁসে উঠে এবং সমগ্র বাংলাদেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে। আমরা তখন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র। কী বিশাল মিছিল! শেখ মুজিব দ্রুত তাকে দেশ থেকে বের করে দেন। তসলিমা নাসরিনও ইসলামের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে টিকতে পারেনি। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন মাত্র তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। কমিশন জেনা-ব্যভিচারকে একটি কর্ম হিসেবে উল্লেখ করে যারা এর সাথে জড়িতদেরকে যৌনকর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দানের কথা বলেছেন। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করে নারী ও পুরুষের সমতা আনয়নের কথা বলেছেন। আরো অনেক বিষয়ে অবান্তর কথাবার্তা বলেছেন।

ইসলাম নারীকে যতখানি সুরক্ষা দান করেছে তা অতীতে কখনো কেউ দিতে পারেনি এবং সম্ভবও না। পাশ্চাত্য যা করেছে তা নারীকে ভোগের সামগ্রীই মাত্র করেছে এবং তাদের পারিবারিক জীবন ধ্বংস হয়েছে। পাশ্চাত্যে ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষ অপেক্ষা নারী অগ্রগামী। তারা সুখ-শান্তি খুঁজছে ইসলামের মাঝে। ইসলাম নারীকে মা, কন্যা, বোন ও স্ত্রী হিসেবে যে মর্যাদা দান করেছে তা অতুলনীয়। আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন : মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত, পিতা অপেক্ষা মায়ের মর্যাদা তিনগুণ; যে নারীর প্রথম সন্তান কন্যা সে নারী ভাগ্যবতী। তিনি আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি তিনটি, দু’টি বা একটি কন্যাকে যত্নের সাথে লালন-পালন করবে এবং সুপাত্রে পাত্রস্থ করবে কেয়ামতের দিন তার ও আমার অবস্থান হবে একসাথে (একথা বলতে গিয়ে তিনি দুটি আঙুল একত্রিত করে দেখান)। একজন নারী পিতার সংসারে পূর্ণ নিরাপদ, ভাইয়ের সংসারে-স্বামীর সংসারে ও সন্তানের কাছেও নিরাপদ। অনিরাপদ একজন জাহেলের কাছে (যে ইসলাম মানে না) হোক সে পিতা, ভাই, স্বামী ও সন্তান। সদাচরণের শিক্ষা ইসলাম যতটা দিয়েছে তা আর কে দিতে পারেনি। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। তিনি আরো বলেছেন, কিয়ামতের দিন স্ত্রীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। একজন মুসলিম কোনভাবেই মানুষের প্রতি জুলুম করতে পারে না। ইসলামে সদাচরণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিজের পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দান করা হয়েছে।

স্বাধীনতাত্তোর শেখ মুজিবকে বাকশাল গঠন এবং ভারতঘেঁষা হয়ে উঠার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের বড়ো ভূমিকা ছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন গণতন্ত্রী এবং জনগণের ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে তিনি তাঁর দলকে দ্রুত জনগণের কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক। বর্তমানে বিএনপি নেতৃত্ব বাম চিন্তাধারার লোকদের হাতে এবং তারা ক্রমান্বয়ে ভারতপ্রেমী হয়ে পড়ছেন। এগুলো ঘটে বিশ্বাস থেকে।

১৯৯৬-এর আওয়ামী লীগ এবং পরবর্তী সময়ের আওয়ামী লীগ এক নয়। আওয়ামী লীগের বিজয় লাভের পরে চীনমৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। প্রোগ্রাম শেষে সাংবাদিকরা শেখ হাসিনাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন করলে শেখ হাসিনা হেসে বলেন, জনগণ তাঁকে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে জবাব দিয়ে দিয়েছে। শেখ হাসিনা এড়িয়ে যেতে চাইলেও ভারত ও বামরা (তাদের হাতে প্রচারযন্ত্র) তাঁকে বাধ্য করেছে এক ভুয়া বিচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসে এক নিকৃষ্টতম শাসকে পরিণত করতে। এতো গুম-খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও সম্পদ পাচার হয়তো বর্তমান সময়ে তাঁর মতো দ্বিতীয় জন নেই।

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট স্পষ্টত বামদের চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন স্বয়ং আল্লাহপাক প্রদত্ত। আল্লাহপাক সবিস্তারে কুরআনে উল্লেখ করেছেন। একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান- এতটুকু প্রাপ্তি নিশ্চিত করাই কঠিন। নানা ছলেবলে নারীদের বঞ্চিত করা হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব নারীকে আল্লাহপাক প্রদত্ত অধিকারটুকু নিশ্চিত করা। আমরা যদি বলি কমিশনে যারা ছিলেন সবাই ইসলাম বিদ্বেষী ও নাস্তিক সেটি কি ভুল হবে? নাস্তিক না হলে মহান আল্লাহপাকের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে? এ রিপোর্টের পক্ষে সব বামরা একাট্টা হয়ে নানা যুক্তি দেখাবে ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জোর দাবি জানাবে। অন্যদিকে সকল ইসলামপন্থী দল ও জনতা একযোগে রুখে দাঁড়াবে এবং এটিই স্বাভাবিক ও ঈমানের দাবি। সরকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার সাথে সাথে এ সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, যেটা ভারত ও পতিত হাসিনার চাওয়া। সরকারের জনপ্রিয়তার ভীত হলো ইসলামপন্থী জনতা এবং এই জনতা প্রকাশ্যে কুরআনের বিরুদ্ধে অবস্থানকে কোনভাবেই মেনে নেবে না। যেমন মেনে নেয়নি দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরিনকে।

জেনা-ব্যভিচার অত্যন্ত ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক- তা সকল ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই মনে করে। পাশ্চাত্য সমাজ ও আমাদের সমাজ এক নয়। হিন্দু ও মুসলিম সমাজে নগ্নতা-অশ্লীলতা পছন্দনীয় নয়। জেনা-ব্যভিচারকে একটি কর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দান কোনো সভ্য, ভদ্র, রুচিশীল ও বিবেকবান মানুষ কখনই মেনে নিতে পারে না। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে এ রকম একটি রিপোর্ট কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ সরকারকে অপ্রিয় ও গণবিচ্ছিন্ন করা প্রতিবেশী দেশ ও বাম ঘরনার বুদ্ধিজীবীদের এক কৌশল হতে পারে। এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত রয়েছে কি না সরকারকে তা খতিয়ে দেখতে হবে। দেশ-বিদেশে ড. ইউনূসের ইমেজের কারণে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ড. ইউনূসের পক্ষে ছাত্র-জনতা দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে। এমতাবস্থায় এমন রিপোর্ট দিয়ে পরিবেশ ঘোলাটে করা দেশপ্রেমিক কারো কাম্য হতে পারে না। তা এ রিপোর্ট বাতিল বা প্রয়োজনীয় সংশোধনের লক্ষ্যে ইসলামিক স্কোলারদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব.), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।