মানবসমাজে গৃহ আছে, হাসপাতাল আছে এবং আছে পাগলাগারদও। কারাগার অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। তবে সব জায়গাতেই মানুষ থাকে। অবশ্য সব মানুষের মান একরকম নয়। মানভেদে আবাসস্থলেও তারতম্য ঘটে যায়। একটি প্রশ্ন অবশ্যই করা যায়। মানুষে মানুষে যে মানভেদ, তা কি ন্যায়সঙ্গতভাবে রক্ষিত হয়? অর্থাৎ যথাব্যক্তিকে কি যথাস্থানে রাখা হয়? নাকি এখানে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, ধর্ম-বর্ণের পার্থক্য; নৈতিক বিচ্যুতি ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে অন্যায় কিংবা বৈষম্য ঘটে যায়? পরিবারে কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে পাঠানো হয়, আর পাগল হলে পাঠানো হয় পাগলাগারদে। সমাজে কেউ চুরি করলে পাঠানো হয় জেলখানায়। এমন ব্যবস্থাপনা থেকে উপলব্ধি করা যায়, কেবল সুস্থ ও অপরাধমুক্ত মানুষরাই সমাজে বসবাসের অধিকার রাখে। অন্যদের আবাসন হবে হাসপাতাল, পাগলাগারদ কিংবা কারাগারে। এমন ব্যবস্থাপনা কি কার্যকর আছে আমাদের সমাজে? অনেক ক্ষেত্রে বিপরীত ব্যবস্থাপনাই লক্ষ্য করা যায় আমাদের সমাজে এবং বিশ্ব পরিসরে। গৃহের ন্যায়বান মানুষকে থাকতে হচ্ছে কারাগারে, আর কারাগারের উপযুক্ত মানুষ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সমাজে। বিশ^ পরিসরের চিত্র আরও ভয়াবহ। বিশে^ অশান্তি ও যুদ্ধের যারা কারিগর, তাঁরাই শান্তির রোডম্যাপ জারি করে যাচ্ছেন বিশ^ময়। অথচ এদের অবস্থানের উপযুক্ত জায়গা ছিল কারাগার কিংবা পাগলাগারদ। অসুস্থ এমন মানুষগুলো পুরো বিশ^টাকেই অসুস্থ করে তুলেছে। আপাতত স্বেচ্ছায় ওরা হাসপাতালে ভর্তি হলে পৃথিবীটা নিরাময়ের একটু সুযোগ পেত। কিন্তু ওরা হাসপাতালে ভর্তি হবে তো?
উত্তর মেরুর কাছাকাছি দ্বীপ গ্রিনল্যান্ডের সাথে কেমন আচরণ করতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? তবে ট্রাম্প চাইলেই কোনো দেশের ভূখ-কে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী ম্যাটে ফ্রেডরিকসেন। বৃহস্পতিবার গ্রিনল্যান্ড সফরে গিয়ে এক সাংবাদ সম্মেলনে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটি কেবল ডেনমার্ক বা গ্রিনল্যান্ডের প্রশ্ন নয়। বহু প্রজন্ম ধরে আমরা আটলান্টিক সংলগ্ন এলাকায় যে অঞ্চল গড়ে তুলেছি, এটা তার শৃঙ্খলার প্রশ্ন।’ তিনি বলেন, ‘কোনো দেশকে এভাবে নিজের সঙ্গে যুক্ত করে নেয়া যায় না। এমনকি সুরক্ষার দোহাই দিয়েও নয়। উল্লেখ্য যে, গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অংশ হলেও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা স্বয়ংশাসিত। ডেনমার্ক তাদের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়গুলো দেখে থাকে। বলা হচ্ছে, রাশিয়া ও চীনকে মোকাবিলা করার জন্য ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডের ওপর আমেরিকার ক্ষমতা বাড়াতে চান। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্প একই সঙ্গে গ্রিনল্যান্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপরেও দখলদারিত্ব চান। ট্রাম্প সম্পর্কে কম বলাই ভালো, কারণ তিনি নিজেই নিজেকে উলঙ্গ করতে ভালোবাসেন, রাখ-ঢাক তাঁর পছন্দ নয়।
দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হবার পর ট্রাম্প নিজেকে আরও আগ্রাসীরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। একের পর এক তিনি নিচ্ছেন বিতর্কিত নানা সিদ্ধান্ত। তাঁর শুল্কনীতি পুরো পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছে এক অস্থির পরিস্থিতি। অনেকেই বিষয়টিকে বাণিজ্য-যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করছেন। ট্রাম্প তাঁর অভিযাত্রায় এবার উপদেষ্টা হিসেবে সঙ্গে নিয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ককে। উভয়ে মিলে রাষ্ট্র পরিচালনায় এবার যে নীতি গ্রহণ করছেন তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন মার্কিন জনগণ। গত শনিবার রাজপথে নেমে তাঁরা স্লোগান দিয়েছেনÑ ‘ট্রাম্পের পদত্যাগ চাই’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, ‘আমাদের কোনো রাজা নেই’। আমেরিকার ৫০ অঙ্গরাজ্যের সব কটিতে বিক্ষোভ করেছেন লাখ লাখ মানুষ। ইউরোপের কয়েকটি দেশেও রাজপথে নেমেছেন বিক্ষোভকারীরা। ট্রাম্পের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাঁরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা হরণ করছেন। মার্কিন জনগণ তাঁদের দেশব্যাপী বিক্ষোভের নাম দিয়েছেন ‘হ্যান্ডস অফ’। অধিকার কর্মীদের প্রায় দেড়শ গোষ্ঠী এ বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, টেক্সাস, ফ্লোরিডা, কলোরাডো, মিনেসোটা, ক্যারোলাইনা, ডেলাওয়ারসহ সব অঙ্গরাজ্যের প্রধান শহরগুলোয় ১ হাজার ৪০০টির বেশি বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ আয়োজকদের মধ্যে ছিল নাগরিক অধিকার সংস্থা, নারী অধিকার গোষ্ঠী, শ্রমিক সংগঠন, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের সংগঠন ও অধিকার কর্মীরা। তাঁদের প্রধান তিনটি দাবি হলোÑ ট্রাম্প প্রশাসনে শত কোটিপতিদের দখলদারি ও দুর্নীতি বন্ধ করা, ‘মেডিকেইড’ নামে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যবীমাসহ সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মসূচিগুলোয় অর্থায়ন বন্ধ না করা এবং অভিবাসী, ট্রান্সজেন্ডার ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ওপর হামলা বন্ধ করা। শনিবার সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয় রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখান থেকে বিক্ষোভের আয়োজক সংস্থা ইনডিভিজিবলের সহপ্রতিষ্ঠাতা এজরা লেভিন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, বিশাল এ বিক্ষোভের মধ্যদিয়ে তাঁরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ইলন মাস্ক, রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য ও তাঁদের মিত্রদের পরিষ্কার বার্তা পাঠাতে চান যে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ মেনে নেয়া হবে না। এদিকে নিউজার্সি অঙ্গরাজ্য থেকে এসে ওয়াশিংটন মনুমেন্টের নিচে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানী টেরি ক্লেইন রয়টার্সকে বলেন, ‘অভিবাসন, সরকারি দক্ষতা বিভাগ, পাল্টা শুল্ক এবং শিক্ষাসহ ট্রাম্পের নেয়া সব নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এখানে এসেছি। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের পুরো দেশটার ওপর হামলা চালানো হয়েছে, যেগুলো নিয়ে আমেরিকা গঠিত।’
শনিবার ওয়াশিংটনের আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। বৃষ্টির মধ্যেই মনুমেন্টের আশেপাশে জমায়েত বড় হতে থাকে। অনেকের হাতে ছিল ট্রাম্প ও মাস্কবিরোধী স্লোগান লেখা ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড। কয়েকজন নিয়ে এসেছিলেন ইউক্রেনের পতাকা। কেউ কেউ আবার ‘ফিলিস্তিনের মুক্তি চাই’ লেখা প্ল্যাকার্ড ধরে ছিলেন। উপলব্ধি করা যায়, ওয়াশিংটন মনুমেন্টের চারপাশে শনিবার জড়ো হয়েছিলেন মুক্তিকামী মানুষ। ইউক্রেন, ফিলিস্তিন ও আমেরিকার বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা সেখানে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে সোমবার বিশে^র বিভিন্ন দেশে একযোগে পালিত হয়েছে ‘নো ওয়ার্ক নো স্কুল’ কর্মসূচি। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা, বর্বরতা ও লাগাতার হামলার প্রতিবাদে সোমবার গর্জে উঠেছে রাজধানী ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশ। বিশে^র সাথে সংহতি প্রকাশ করে সোমবার বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন দিনভর বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। এ সময় গাজায় ইসরাইলী বর্বর হামলার বিরুদ্ধে সঙ্গত ভূমিকা পালন না করায় বড় বড় দেশগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিক্ষোভকারীরা। মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করেন তাঁরা। বিক্ষোভকারীরা ইসরাইলী পণ্য বর্জনসহ দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার জন্য মুসরিম বিশে^র প্রতি আহ্বান জানান। বিশ^বাসীর সঙ্গত ভূমিকাও তাঁরা কামনা করেন। ওয়াশিংটন মনুমেন্টের চারপাশে শনিবার মানবমুক্তির যে আকাক্সক্ষা উচ্চারিত হয়েছে, তা গোটা বিশে^ ছড়িয়ে পড়–কÑ শুরু হোক নতুন এক অভিযাত্রা।