কর্মজীবী নারীদের পরিবার ও সমাজে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে হয়, এ বাস্তবতা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। বাংলাদেশের নারীরা চাকরি করার পাশাপাশি পরিবার ও সন্তান ব্যবস্থাপনা, বয়োজ্যেষ্ঠদের সেবা, ঘরসংসার-সবকিছু সামলে থাকেন। বর্তমান আট-দশ ঘণ্টার অফিস টাইমের সঙ্গে যাতায়াত মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় এগারো-বারো ঘণ্টা কর্মক্ষেত্র সংক্রান্ত সময় দিতে হয়। তাই নারীদের অফিস টাইম পাঁচ ঘণ্টা করলে পুরো সমাজ একটি বাস্তব সমস্যার সমাধানমুখী উদ্যোগ পাবে বলে মনে করছেন সচেতন ও মানবিক রাজনীতিবিদগণ। তাদের মতে, নারীদের কিছুটা কম কর্মঘণ্টার মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধ শক্তিশালী হবে। আর মজবুত পরিবার একটি সুস্থ জাতির ভিত্তি নির্মাণ করে দেয়। নারীদের পরিবারে বেশি সময় দিতে দিলে- পারিবারিক বন্ধন, নৈতিক মূল্যবোধ, সুশিক্ষা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বাড়বে। এটি শুধু নারী নয়, পুরো সমাজের উপকারে আসবে। কর্মক্ষেত্রে নারী-বান্ধব নীতি দেশের ইমেজ বাড়াবে। নারীদের জন্য নমনীয়, মানবিক ও পরিবারবান্ধব কর্মনীতি থাকলে- বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নারী-ক্ষমতায়ন মডেল হিসেবে পরিচিত হতে পারে। বৈশ্বিক জেন্ডার সমতা সূচকে অবস্থান উন্নত হবে। এতে দেশের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়বে। বাংলাদেশের নারীবান্ধব এই উদারনীতি পৃথিবীর বহু দেশ গ্রহণ করবে। পাশাপাশি আরও কিছু ইতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারীভাবে সমাজে পড়বে, নিম্নে তা তুলে ধরা হলো।

শিশু ও পরিবার লালন-পালনে পজিটিভ প্রভাব পড়বে। শিশু লালন-পালনের জন্য শূন্য থেকে আট বছর পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ে শিশুর যত্নে মায়েদের বাড়তি সময়ের প্রয়োজন। বাচ্চা প্রতিপালনে মায়ের বাড়তি সময়- শিশুর মানসিক বিকাশ, তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রদান, তাদের সুরক্ষা, আত্মবিশ্বাস গঠন ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এর ফলে ভবিষ্যতে সুস্থ, মানবিক ও নৈতিক প্রজন্ম গড়ে উঠবে- যা রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বটে।

এ নীতিতে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়তে পারে। বাংলাদেশে কর্মক্ষম নারীদের মাত্র- ৩৭% শ্রমবাজারে যুক্ত (এশিয়ার মধ্যে কম)। অনেক নারীরই দীর্ঘ অফিস টাইম, সন্তান ও পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে না পারায় চাকরি ছাড়তে হয়। পাঁচ-ছয় ঘণ্টা অফিস হলে- নারীদের চাকরিতে আগ্রহ বাড়বে, চাকরি ছাড়ার হার কমবে, “মা হলে ক্যারিয়ার থেমে যায়”- এই বাঁধা কমবে, সর্বোপরি অর্থনীতি লাভবান হবে।

নারীদের কম কর্মঘণ্টায় মানসিক চাপ কমে উৎপাদনশীলতা বাড়তে পারে। বিশ্বব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে- কাজের সময় কম হলে উৎপাদনশীলতা (Productivity) কমে না, বরং বাড়ে। তাই পাঁচ ঘণ্টা বা কিছু কম-বেশি কর্মঘণ্টা হলে- ‘বার্নআউট’ কমবে। বেশি সময় কাজ করলে মানসিক ক্লান্তি বাড়ে, ভুল বেশি হয়। কম সময় কাজ করলে উল্টোভাবে ফলাফল বাড়ে। এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, ফোকাসড এবং কার্যকর কাজ পাওয়া যাবে। “Less hour, more output” মডেল কার্যকর হতে পারে। অর্থাৎ “কম সময় কাজ করে, বেশি ফল পাওয়া”- এমন একটি বৈজ্ঞানিক, আধুনিক ও মানবিক কর্মব্যবস্থা। এটি এমন একটি কাজের পদ্ধতি যেখানে- কর্মীদের কম সময় অফিস বা কাজে থাকতে হয়, কিন্তু সেই কম সময়েই সর্বোচ্চ মনোযোগ, দক্ষতা ও প্রযুক্তির সহায়তায় বেশি কাজ সম্পন্ন করা হয়। একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে অব্যাহত কাজের চাপ না দিয়ে কর্মীদের মানসিক স্বস্তি দেওয়া হয়। এর ফলে তারা সৃজনশীলভাবে, মনোযোগ দিয়ে, কম ভুলে কাজ শেষ করতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মীদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে সুফল পাওয়া গেছে। যেমন, ডেনমার্ক, সুইডেনে- ছয় ঘণ্টার কর্মদিবস। আইসল্যান্ড- দু’বছর পরীক্ষা করে দেখেছে যে, কম ঘণ্টায় তাদের আউটপুট বেড়েছে। জাপানে- মাইক্রোসফট চার দিনের ওয়ার্কউইক চালু করে ৪০% productivity বৃদ্ধি পেয়েছে। UK তে চার দিনের work week ট্রায়ালে ৯২% কোম্পানি ইতিবাচক ফল পেয়েছে। সুতরাং কর্মঘণ্টা কমালে মালিকপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এ ধারণা অমূলক। তবে বাস্তব জরিপ ও গবেষণায় যদি দেখা যায় যে- নারীদের কর্মঘণ্ট কমানোতে শিল্প মালিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তাতে সে দায় সরকার নিবে। সরকার শিল্প মালিককে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। অনেক দেশে নারীদের মধ্যে পার্ট-টাইম কাজের হার বেশ বেশি, যার ফলে গড়ে তাদের কাজের ঘণ্টা পুরুষের তুলনায় কম হয়ে যায়। Organization for Economic Co-operation and Development (OECD) এর তথ্যে দেখা যায়, নেদারল্যান্ডস এ প্রায় ৬০ % নারী পার্ট-টাইম কাজ করেন। পার্ট-টাইম কাজে “কম” ঘণ্টা খুব সাধারণ। OECD--এর তথ্যে, নেদারল্যান্ডসে অনেক মহিলা “সাধারণ কাজের ঘণ্টা” হিসেবে ত্রিশ ঘণ্টার কম ঘণ্টার চাকরি করেন। সুইজারল্যান্ডেও নারীদের মধ্যে পার্ট-টাইম কাজের হার খুব বেশি। OECD-এর তথ্যে, প্রায় ৪৫% মহিলারা সপ্তাহে ত্রিশ ঘণ্টা বা তার কম কাজ করেন।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর বিখ্যাত উক্তি, “আমাকে একজন আদর্শ মা দাও, আমি তোমাকে আদর্শ জাতি দিবো”- এ বাণীটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বারো-চৌদ্দ ঘণ্টা কর্মস্থলে চাকরি করে বেশিরভাগ নারীর পক্ষেই এমন আদর্শ সন্তান প্রতিপালন সম্ভব নয় যাদের দ্বারা এক সময় আদর্শ জাতি গঠন করা সম্ভবপর হবে। আর ‘শিক্ষা ও সার্টিফিকেট অর্জনটা শুধু চাকরির জন্য’ এই কথাটিও সার্বজনীন সঠিক কোন কথা নয়।

এ ব্যাখ্যা আমাদের মুসলিম সমাজে নেতিবাচক হিসেবে প্রভাব ফেলছে। নারী সমাজের বিশাল একটা শ্রেণিকে এই মন্ত্র পড়িয়ে প্রয়োজনের বাইরে চাকরিমুখী করা হয়েছে। কর্মস্থলে কাজের সঠিক পরিবেশ, পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা, সার্বিক নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে তেমন আলোচনা দেখা যায় না।

এখানে একটা দুরভিসন্ধি বা মতলব থাকতে পারে। তা হচ্ছে, কম বেতনে নারীদেরকে শ্রমে লাগানো যায় এবং আচ্ছামতো কাজ করানো যায়! অর্থাৎ বিষয়টা এমন যে, তোমাদেরকে চাকরি করতেই হবে, তবে আমি যে বেতন দিবো, যেভাবে নির্দেশনা দিবো এবং যা যা বলবো তা তা করতে হবে। এগুলো এক ধরনের ধূর্ততা ও ছলচাতুরি।

ইসলাম এবং ইসলামী দলগুলোর বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপনের সুযোগ নাই। তারা নারীদের প্রকৃত মর্যাদা নিশ্চিত করে সত্যিকারের বৈষম্য দূর করার কথা বলেছেন। সন্তান গর্ভধারণের কষ্ট, প্রসব বেদনার কষ্ট, দুই বছর পর্যন্ত নিজেকে নিঃশেষ করে দুগ্ধ পান করানোর কষ্টের পাশাপাশি পুরুষের সমান কর্মঘণ্টা তাদের কর্মস্থলে দিতে হবে এটা সুস্পষ্ট জুলুম। আর মায়েদের উপর জুলুম করে কোন জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে না। দেশের সচেতন মানুষকে এই দাবির পক্ষে জনমত তৈরি করে দাবি আদায়ে এক প্লাটফর্মে সমেবেত হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।