মো: রুহুল আমিন

সংস্কার নাকি নির্বাচন? চায়ের দোকান থেকে শুরু করে খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়া এবং টকশোতে চলছে তুমুল বাকযুদ্ধ। বিএনপি চাচ্ছে দ্রুত নির্বাচন। যে কোন সমস্যা দেখা দিলেই তারা বলছে দ্রুত নির্বাচন একমাত্র সমাধান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রচলিত আছে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে যে কোন রোগের জন্য ডাক্তারের কাছে গেলে প্যারাসিটামাল ধরিয়ে দেন। বিএনপির কাছে নির্বাচন যেন এখন সর্ব রোগের মহৌষধ। জামায়াত প্রয়োজনীয় সংস্কার ও আওয়ামী লীগের বিচারের কাজ শেষে করে রমযানের আগেই নির্বাচন চায়। এনসিপি প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং আওয়ামী লীগের বিচারের পূর্বে কোন ধরনের নির্বাচন চায় না।

বিএনপি নির্বাচন চাওয়ার বড় কারণ হচ্ছে তারা ভাবছে নির্বাচন হলেই তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে। বাংলাদেশে সব চেয়ে বড় দুইটি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মী পলাতক। আওয়ামী লীগ না থাকায় ভোটের মাঠে বিএনপির বড় প্রতিপক্ষ হতে যাচ্ছে জামায়াত এবং এনসিপি। এনসিপি নতুন দল তাদের গুছিয়ে উঠতে সময়ের প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় কমিটি বাদে জেলা উপজেলা পর্যায়ে তাদের নেতৃত্ব সেভাবে গড়ে উঠেনি। যত সময় যাচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীরা বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের ইমেজ সংকট চরমে উঠেছে। বিএনপি চাচ্ছে না নির্বাচন বিলম্বিত করে অন্য দলগুলোকে দল গুছানোর সুযোগ এবং নিজেদের ইমেজ সংকটে ফেলতে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকলে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে থাকে। কারণ রাজনৈতিক নেতারা রাজনীতিকে পেশা হিসাবে নেয়। অন্তর্বর্তী সরকার থাকলেও বিএনপি যেন ক্ষমতায় আছে সেভাবে সব সুবিধা ভোগ করছে। আমাদের দেশে নির্বাচনে হেরে গেলে প্রার্থীরা পরাজয় শিকার করে না। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার দায় দায়িত্ব নিয়ে পরাজিত দলের নেতারা পদত্যাগ করে না। তারা নতুন নেতৃত্বের অধীনে দল গোছানোর সুযোগ দেয় না।

জুলাই বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এতে দু’হাজারেরও বেশি মানুষ নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। প্রাণ বিসর্জন শুধু নির্বাচনের জন্য দেয়নি রাষ্ট্রের কল্যাণে দিয়েছে। ঘুনেধরা রাষ্ট্রের সকল জায়গায় সংস্কার করে তারপর নির্বাচন দিতে হবে। কেউ যেন রাষ্ট্রে ফ্যাসিজম কায়েম করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা রাখতে হবে। দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে তার কোনটিই সুখকর নয়। বিএনপি বলছে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কার করবে। কিন্তু রাজনীতিবিদরা যা বলে তা করে না। ক্ষমতায় গেলে তারা দানবে পরিণত হয়। তাদের কাছে লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশে যে কোন পথই বৈধ।

বাঙালি স্বপ্নবাজ জাতি। আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছি। কিছু ক্ষেত্রে সফল হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখেনি। এর কারণ দেশের আমজনতা গণঅভ্যুত্থানের সময় সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐকবদ্ধ হয়ে রাজপথে নেমেছিলো। কিন্তু অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থের জন্য আবার বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

আমরা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূসকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের দেশের ভেঙ্গেপড়া অর্থনীতি, বিচার ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার দারুণ সুযোগ ছিলো। কিন্তু বাঙালির একটা স্বভাব আছে যে নিজেরা ভাল কিছু করতে না পারলে অন্য কেউ ভাল কিছু করবে সেটা আমাদের সহ্য হয় না। কেউ একটু উপরে ওঠার চেষ্টা করলে তাকে উপরে উঠতে সাহায্য না করে কিভাবে তার উপরে উঠার পথ বাঁধাগ্রস্ত করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান কাজ হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সফল হতে না দিয়ে কিভাবে দ্রুত তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিজেরা সেই স্থানে বসা যায়। আরেকটি বড় বাধা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের ১৬ বছরে গড়ে তোলা কাঠামো। এ কাঠামোর গুরত্বপূর্ণ স্থানে হাসিনা সরকারে নিয়োগকৃত দলীয় লোকজন রয়েছে। তারা ইউনূস সরকারকে সফল হওয়ার পথে বিভিন্নভাবে বাধার সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশের সৌভাগ্য আমরা ড. ইউনূসের মতো একজন বিশ্ব নেতাকে পেয়েছি। কিন্তু নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য আমরা জাতিগত স্বার্থকে নষ্ট করে ফেলছি। নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছি। যে কোন পরিস্থিতিতে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্ব-স্ব জায়গা থেকে সহযোগিতা করতে হবে। ড. ইউনুসের হাত ধরে দেশর সংকটময় সময় কাটিয়ে উঠতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। সংস্কারের মাধ্যমে দেশে জনগণের ভোটের অধিকারসহ দেশে যেন আর কোন ফ্যাসিস্ট তৈরি হতে না পারে সেটির বন্দোবস্ত করতে হবে। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।