মনসুর আহমদ
আমাদের প্রত্যেক পরিবারে কমবেশী দুধ, দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি, শাক-সবজি, ফলমূল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ সব দ্রব্যাদি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ব্যবহারবিধি সম্পর্কে মা-বোনদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা দরকার। প্রথমে অলোচনা করা যাক দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি নিয়ে। দুধের ন্যায় একটি উত্তম ও সুসম খাদ্য অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে একটি ভীতিকর খাদ্যে পরিণত হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অনেক সময় দুধকে স্বাভাবিক চেহারায় বজায় রাখতে তার সাথে দূষিত রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে থাকে। ফলে দুধের বাহ্যিক রূপ অপরিবর্তিত থাকে বটে, কিন্তু দুধে ক্ষতিকর রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। এ বিষয়টির ব্যাপারে দুধের ব্যাপারীদেরকে সচেতন করার পাশাপাশি পরীক্ষকদের উচিত দায়িত্বশীলতার সাথে বাজারজাত দুধ পরীক্ষা নিরীক্ষা করা।
সমাজে তরল দুধের পাশাপাশি ঘনীভূত দুধের ব্যবহার প্রচুর। ঘনীভূত দুধ সীসার ঝালাই করা টিনে বাজারজাত করা হয়; যা সীসার মধ্যেমে বিষক্রিয়ার উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অতি ঘনীভূত দুধ, শুকনা দুধ বাষ্পীভূত দুধসমূহের কাঁচামাল বা মূল উপাদানে ত্রুটি থাকতে পারে। শুকনা দুধের আর্দ্রতা এত কম যে, তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করলে পরমাণুজীবী ধ্বংসের (Microbial Spoilage) সমস্যা কম সৃষ্টি হয়। যদি শুকনা দুধে ৮% -এর বেশি আর্দ্রতা থাকে তবে তাতে ছাতা (Mold) পড়তে পারে। ঘনীভূত ঘোল বা টকানো দুধ যদি খোলা অবস্থায় বাতাসের সংস্পর্শে রাখা হয়,তবে তা ছাতা পড়ে নষ্ট হতে পারে। অতি ঘন এসিড বা এ জাতীয় দ্রব্য ব্যাকটেরিয়া ও ইস্ট (yeast) জন্মাতে বাধা সৃষ্টি করে।
মুক্ত অক্সিজেন না পেয়ে বাঁচতে পারে- এমন সক্ষম এককোষী অণুজীব (Anacrobic) বাষ্পীভূত টিনজাত দুধে স্ফীতি ঘটাতে পারে। দুধ ছড়া দেয়া বা জমাট বেঁধে যাওয়ার জন্য দায়ী বেসিলাস প্রজাতি। প্রোটোলাইসিস (চৎড়ঃবড়ষুংরং) প্রক্রিয়া বা জলের সাথে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রোটিন ভাঙ্গার কারণে দুধ তিক্ত স্বাদবিশিষ্ট হয়ে যেতে পার। মিষ্ট করা ঘনীভূত দুধ ইস্ট, অ্যাস্পারগিলস (Aspergills) এবং পেনিসেলিয়াম নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা নষ্ট হয়ে যায়।
জমাট বাঁধা মিষ্টি যেমন আইসক্রিম, জমাট বাঁধা ডিমের পায়েস ইত্যাদিতে রং সুগন্ধীসহ ফল, বাদাম, ডিম ইত্যাদি থাকে। এগুলোর যে কোনটি পরমাণু জীব উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে এসমস্ত খাদ্যদ্রব্যাদি যদি অতি সাবধানতার সাথে নাড়াচাড়া করা হয় বা হিমায়িত অবস্থায় রাখা হয় বা সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয় তবে বড় ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য কারখানাগুলোতে উৎপাদিত বস্তুর গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ ও গুণগতমান বিশ্লেষণ যথোপযুক্তভাবে করা প্রয়োজন।
এ বারে কিছু আলোচনা করা যাাক শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি সংরক্ষণের সাবধানতা নিয়ে। সঞ্চয়িত কৃষিজাত দ্রবাদির ২৫% ব্যবহারের পূর্বেই নষ্ট হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। তরিতরকারি ফলমূল সাধারণত ভাণ্ডারে জমা রাখাকালে, পরিবহনকালে এবং প্রক্রিয়াজাত করণের উদ্দেশ্যে অপেক্ষমান কালে নষ্ট হয়। বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত যেমন শুকানো, হিমায়িত, পাস্তুরিত বা কৌটাজাত তরিতরকারি ফলমূলে নানাভাবে ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হতে পারে। তাই এসব ব্যাপারে আমাদেরকে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। তরকারি, ফলফলাদি, শাক-শব্জি গোলাজাতকরণ, বাক্সবন্দীকরণ, ঝুড়ি বা ট্রাক ভর্তিকালে যখন তা ভালোভাবে পানিতে ভিজিয়ে রেখে ঝাঁকিয়ে ধোয়া হয় তখন তা অনিষ্টকর জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তরিতরকারি, ফলমূলাদি পরিবহনকালে যান্ত্রিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অধিকতর উপযোগেী হয়ে উঠতে পারে। প্রক্রিয়াজাত করণকালে কারখানার পানি দ্বারা ধোয়ার কারণে এসব খাদ্যদ্রব্যে মাইক্রোঅর্গানিজম জন্মের সম্ভাবনা কমে যায়। এ ছাড়াও ফলফলাদি শাক-সবজির আবরণ বা খোসা ছাড়াবার জন্য স্টিম বা গরম পানির ব্যবহার উগ্র ক্ষারীয় তরল পদার্থ ব্যবহারের ফলে তাতে মাইক্রোঅর্গানিজম জন্মের সম্ভাবনা কমে যায়। উৎপাদিত বস্তু নাড়াচাড়া করার সময় তা ঘামে যায় এবং তার আয়ুষ্কাল কমে যায়। প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্দেশ্যে ফল-ফলাদি সুবিন্যস্ত করা, ছাঁচা, খোসা ছাড়ান, কাটাকুটি টুকরা করার সময় তাতে অপকারী জৈব উপাদন মিশ্রিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রক্রিয়াজাত করণের সরঞ্জমাদি যেমন ট্রে, ট্যাঙ্ক, পাই ক্ষুদ্রাকার প্রক্রিয়াজাত করণ পদ্ধতিতে প্রচলিত পরিপূর্ণ বৃহদাকার সংরক্ষণ পদ্ধতির যেকোন পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়। টুকরা করা ফল, খোসা ছাড়ান বা ফালি করা আলু, লেটুস, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন তরকারি যেগুলোর গুণগত মান উন্নয়নের জন্য এবং ভোক্তাদের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সেগুলিকে ক্ষুদ্রাকার প্রক্রিাজাত করণের আওতায় নেওয়া হয়। তরিতরকারি, ফল ক্ষুদ্রকার প্রক্রিয়াজাত করলে এ গুলির জীবন্ত কোষ অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা করা এবং ব্যাকটেরিয়া প্রজনন নিয়ন্ত্রণে রাখা একটি দুরূহ ব্যাপার। মাইক্রোঅর্গানিজমের মারফৎ ফল, তরিতরকারির কোষ নষ্ট হওয়া বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। উৎপাদিত দ্রব্যাদির বৈশিষ্ট্যের উপর নিভর করে মাইক্রোঅর্গানিজমের তীব্রতা কেমন হবে। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে কী ধরনের মাইক্রোঅর্গানিজম সৃষ্টি হবে। আংশিক প্রক্রিয়াজাত ফলমূল, তরিতরকারি অতিদ্রুত ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক আক্রান্ত হয়ে জৈব বিষে পরিণত হতে পারে। তাই খাদ্যদ্রব্য আংশিক প্রক্রিয়াজাত করা উচিত নয়। অধিকন্তু আংশিক প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে আটা রঞ্জক জাতীয় পদার্থ সৃষ্টি হয় এবং মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করে। অতএব মানুষকে ক্ষতিকর অবস্থা থেকে রেহাই দিতে ক্ষুদ্রাকার প্রক্রিয়াজাত করণ পদ্ধতিকে সতর্কতার সাথে দেখা প্রয়োজন। নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজনে ক্ষুদ্রকার প্রক্রিয়াজাত করণে দ্বিতীয় একটি অতি সূক্ষ্ম মাইক্রোবিয়াল অন্তরায় যেমন অতি নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ, রাসায়নিক সংরক্ষক (Preservation)- এর প্রয়োগ , মৃদু তাপ , উপযুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ সংরক্ষণ প্রয়োজন। লেখক : প্রাবন্ধিক।