জাফর আহমাদ

আরবী ‘কালবে সালিম” মানে ‘বিশুদ্ধ চিত্ত’। বিশুদ্ধ চিত্ত মানে হচ্ছে, সঠিক ও নিষ্কলুষ অন্তকরণ। অর্থাৎ সব রকমের বিশ্বাসগত ও নৈতিক ত্রুটিমুক্ত অন্তর। যেখানে কুফুরী ও শিরক এবং সন্দেহ-সংশয়ের লেশমাত্রও নেই। যার মধ্যে নাফরমানী ও বিদ্রোহের কোন সামান্যতম অনুভূতিও পাওয়া যায় না। যা সব ধরনের অসৎ প্রবণতা ও অপবিত্র কামনা-বাসনার সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত। যার মধ্যে কারো বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ ও অকল্যাণ কামনা পাওয়া যায় না এবং যার নিয়তে কোন প্রকার ত্রুটি ও কৃত্রিমতা নেই।

এ ধরনের বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ জ্ঞান-বুদ্ধির সাথে সাথে তাকে নৈতিক বোধ ও অনুভূতি দান করেন যার মাধ্যমে সে প্রকৃতিগতভাবেই ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন। যার ফলে সে ভালো-মন্দ কর্ম ও বৈশিষ্ট্য থেকে শুধুমাত্র ভালো কর্ম ও বৈশিষ্ট্যগুলো নিজের মধ্যে ধারণ করেন এবং মন্দগুলো থেকে দূরে অবস্থান করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “শপথ (মানুষের) প্রবৃত্তির আর সে সত্তার যিনি তাকে (সব রকমের বাহ্যিক) ও আভ্যন্তরীণ শক্তি দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। আর পাপাচার ও তাকওয়ার অনুভূতি দু’টোই তার ইলহাম করেছেন।” (সুরা শামস : ৭-৮)

কালবে সালিম বা বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী ব্যক্তি নিজের বিবেককে কখনো প্রতারিত করেন না। এমন কোন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন না যার কারণে অবশেষে বিবেকের প্রতারণা করার দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য নিজের কর্মকাণ্ডের স্বপক্ষে অসংখ্য ওজর পেশ করতে হয়। স্বার্থ ও লোভ-লালসার কারণে যেসব দর্শন রচিত হয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে খারাপ ও পাপকার্যকে বৈধ করে নেয়। বিশুদ্ধ চিত্তের লোকেরা এ ধরনের মিথ্যা ও অলীক দর্শনকে কখনো গ্রহণ করে না। ভালকাজ ও গুণাবলীকে কেউ মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা এবং সেকেলে ঠাওরিয়ে রাখলেও এবং দুনিয়ার সফলতার জন্য বিরাট প্রতিবন্ধক হলেও তারা তা গ্রহণ করে না। বাহ্যিক বা দুনিয়ার দৃষ্টিতে তারা বিফল হলেও হতে পারে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা সফল। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যেদিন অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে লাগবে না, তবে যে বিশুদ্ধ অন্তকরণ নিয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হবে।” (সুরা শুয়ারা : ৮৮-৮৯)

দুনিয়াতে আমরা সফলতার মানদণ্ড ভিন্নভাবে নির্ধারণ করেছি, আল্লাহর কাছে সে মানদণ্ড ভিন্ন। আখিরাতে আমাদের নির্ধারিত মানদণ্ড ভেস্তে যাবে, যা উল্লেখিত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছ্।ে কিয়ামতের দিন যদি কোন জিনিস মানুষের কাজে লাগতে পারে, তাহলে তা তার ধন-দৌলত ও সন্তান-সন্ততি নয় বরং একমাত্র প্রশান্ত চিত্ত এমন একটি অন্তর যা কুফুরী, শিরক, নাফরমানী, ফাসেকী ও অশ্লীল কার্যকলাপ মুক্ত। ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততিও প্রশান্ত ও নির্মল অন্তরের সাথেই উপকারী হতে পারে। প্রশান্ত অন্তরকে বাদ দিয়ে এদের কোন উপকারিতা নেই। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিও সেখানে কেবলমাত্র এমন অবস্থায় উপকারী হবে যখন মানুষ দুনিয়ায় ঈমান ও আন্তরিকতা সহকারে সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করবে। নয়তো কোটিপতি ও বিলিয়ন সম্পদের মালিকরাও সেখানে পথের ভিখারীই হবে। তদ্রুপ সন্তানদেরও যদি দুনিয়ায় নিজের সামর্থ অনুযায়ী ঈমান ও সৎকর্মের শিক্ষা দিতে পারে তবেই তারা সেখানে কাজে লাগতে পারে। অন্যথায় পুত্র যদি নবীও হয়ে থাকে তাহলে যে পিতা কুফুরী ও গোনাহের মধ্যে নিজের জীবনকাল শেষ করেছে এবং সন্তানের সৎ কাজে যার কোন অংশ নেই তার শাস্তি পাওয়া থেকে কোন নিষ্কৃতি নেই।

বিশুদ্ধ চিত্ত মানে শক্তিশালী বিবেক। দুনিয়ার জীবনে যে বিবেক সারাক্ষণ নফসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। যে বিবেক তাকে মন্দ কাজে বাঁধা দান করে। নাফসের ক্রমাগত প্রলোভনকে সে শক্ত হস্তে দমন করে। বিবেক সারাক্ষণ সজাগ থাকে, যতই তাকে হাত বুলিয়ে বা আদর-সোহাগ করে ঘুম পাড়াবার বা তাকে অনুভূতিহীন বানানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, সত্যিকারর্থে তাকে ঘুম পাড়িয়ে অনুভূতিহীন করা সম্ভব নয়। কারণ বিশুদ্ধ চিত্ত ভালো করেই জানে যে, আল্লাহ হাইয়্যুল কাইয়্যুম, তিনি সামিউম বাছির, তিনি রাকিব। আমরা সার্বক্ষণিক তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছি। নিজের সত্তায় এবং চারপাশের যমীন থেকে আসমান পর্যন্ত গোটা বিশ্ব-জাহানের সর্বত্র এমন অসংখ্য নিদর্শনাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা জানিয়ে দিচ্ছে যে, সে হাইয়্যুল-কাইয়্যুম, সামিউম বাছির ও রাকিব আল্লাহ ছাড়া হতে পারে না কিংবা বহু সংখ্যক রব এ বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিকর্তা ও পরিচালক হতে পারে না। বিশ্ব চরাচরের সর্বত্র এবং তার আপন সত্তার অভ্যন্তরে বিদ্যমান এ নিদর্শনাবলীই কিয়ামত ও আখেরাতের সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করে।

বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারীরা হেদায়াত প্রাপ্ত বলে মহান আল্লাহ তাদেরকে আরো বেশি হেদায়াত দান করেন এবং তাদের সামনে চলার পথকে আরো বেশি উজ্জল ও শক্তিশালী করে দেন। ফলে তার তাকওয়ার মাত্রা আরো বেশি বৃদ্ধি পায়। আগে সে মোটা মোটা দাগের অসৎ ও মন্দ কাজগুলো পরিহার করতো আর এখন সে ছোট্র সরিষা দানা পরিমাণ মন্দ কাজ থেকেও নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর যারা হিদায়াত লাভ করেছে আল্লাহ তাদেরকে আরো অধিক হেদায়াত দান করেন এবং তাদের অংশের তাকওয়া দান করেন।” (সুরা মুহাম্মদ : ১৭)

আল কুরআনে কালবে সালিম, কালবে মুুনিব, শারহে সদর, নাফসুল মুতমাইন্ন পরিভাষাগুলো ভাবার্থের দিক থেকে অত্যন্ত কাছাকাছি অবস্থান করে। অর্থাৎ যিনি কালবে সালিম-এর অধিকারী তিনি কালবে মুনিব, শারহে সদর ও নাফসুল মুতমাইন্নারও অধিকারী। প্রত্যেক মু’মিনকে এ পরিভাষাগুলো জেনে নেয়া ভালো। নিচে পরিভাষাগুলোর ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

অনুরক্ত মন : আরবী ‘কালবে মুনিব’ অর্থ অনুরক্ত মন। আর অনুরক্ত মন মানে নিজেকে একদিকে মুখ করা এবং বার বার সে দিকেই ফিরে যাওয়া। যেমন: কম্পাসের কাঁটা সবসময় মেরুর দিকেই মুখ করে থাকে। আপনি তাকে যতই নাড়াচাড়া বা ঝাঁকুনি দেন না কেন তা ঘুরে ফিরে মেরুর দিকেই চলে আসে। কালবে মুনিব বা অনুরক্ত মনও ঠিক তদ্রুপ। এমন হৃদয়-মন যা সবদিক থেকে এক আল্লাহর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। যিনি জীবনভর তার উপর যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন তাতে সে বার বার আল্লাহর দিকেই ফিরে আসে। জোর করে খুব বেশি সময় তাকে অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখা যায় না। কোন এক ফাঁকে মুখখানি তার মহান আল্লাহর দিকে ফিরে যায়। একেই বলে কালবে মুনিব। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর বেহেশতকে আল্লাহভীরুদের নিকটতর করা হবে-তা মোটেই দূরে থাকবে না। তখন বলা হবে: এ হচ্ছে সে জিনিস, যার কথা তোমাদেরকে আগাম জানানো হতো। এটা প্রত্যেক প্রত্যাবর্তনকারী ও সংরক্ষণকারীর জন্য। যে অদেখা দয়াময়কে ভয় করতো, যে কালবে মুনিব অর্থাৎ অনুরক্ত হৃদয় নিয়ে এসেছে। বেহেশতে ঢুকে পড় শান্তির সাথে। সেদিন অনন্ত জীবনের দিন হবে।” (সুরা ক্বফ : ৩১-৩৪)

‘কালবে মুনিব বা অনুরক্ত মন’ মূলত আয়াতে বিবৃত ‘মুত্তাকী লোকদের গুণ-বৈশিষ্ট্য। উল্লেখিত আয়াতে প্রথমে বলা হয়েছে বেহেশতকে মুত্তাকী বা আল্লাহভীরুদের নিকটতর করা হবে। এ মুত্তাকী কারা তাদের পরিচয় হলো, এরা প্রত্যাবর্তনকারী, সংরক্ষণকারী. অদেখা দয়ময়কে ভয় করে এবং কালবে মুনিব বা অনুরক্ত হৃদয়ের অধিকারী। মুত্তাকীদের চারটি গুণ যথা:এক. প্রত্যাবর্তনকারী দুই, সংরক্ষণকারী, তিন. অদেখা দয়ময়কে ভয় করে ও চার, কালবে মুনিব বা অনুরক্ত মন।

প্রশান্ত আত্মা : আরবী ‘নাফসে মুতমাইন্না’ মানে প্রশান্ত আত্মা। এটি এমন মানুষকে বুঝায় যারা কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় ছাড়াই পূর্ণ নিশ্চিন্ততা সহকারে ঠাণ্ডা মাথায় এক ও লা শরীক আল্লাহকে নিজের রব এবং নবীগণ যে সত্য দীন এনেছেন তাকে নিজের দীন ও জীবনবিধান হিসাবে গণ্য করেছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছে থেকে যে বিশ্বাস ও বিধানই পাওয়া গেছে তাকে সে পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নিয়েছে। আল্লাহর দীন যে জিনিসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তাকে সে অনিচ্ছা সত্বেও নয় বরং এ বিশ্বাস সহকারে বর্জন করেছে যে, সত্যিই তা খারাপ। সত্য প্রীতির পথে যে কোন ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সে নির্দ্ধিধায় তা করেছে। এ পথে যেসব সংকট, সমস্যা, কষ্ট ও বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে হাসি মুখে তা সহ্য করেছে। অন্যায় পথে চলে লোকদের দুনিয়ায় নানান ধরনের স্বার্থ, ঐশ্বর্য ও সুখ-সম্ভার লাভ করার যেসব দৃশ্য সে দেখছে তা থেকে বঞ্চিত থাকার জন্য তার নিজের মধ্যে কোন ক্ষোভ বা আক্ষেপ জাগেনি। বরং সত্য দীন অনুসরণ করার ফলে সে যে এ সমস্ত আবর্জনা থেকে মুক্ত থেকেছে, এ জন্য সে নিজের মধ্যে পূর্ণ নিশ্চিন্ততা অনুভব করেছে। আল কুরআনের অন্যত্র এ অবস্থাটিকে ‘শারহে সদর’ বা হৃদয় উন্মুক্ত করে দেয়া অর্থে বর্ণনা করা হয়েছে। (সুরা আনআম:১২৫) মৃত্যুকালে, আবার পুনরায় জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানের দিকে যেতে থাকবে সে সময় এবং আল্লাহর আদালতে পেশ করার সময় এদেরকে বলা হবে, “হে প্রশান্ত আত্মা! চলো তোমার রবের দিকে এমন অবস্থায় যে তুমি সন্তুষ্ট।’ (সুরা ফযর : ২৭-২৮)

উন্মুক্ত বক্ষ : আরবী ‘শরহে সদর’ অর্থ হচ্ছে উন্মুক্ত বক্ষ বা খোলা মন। বক্ষদেশ উন্মুক্ত করে দেয়ার মানে হচ্ছে, ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে হৃদয়ে পূর্ণ নিসংশয়তা ও নিশ্চিয়তা সৃষ্টি করা এবং যাবতীয় সন্দেহ, সংশয় ও দোদুল্যমানতা দূর করে দেয়া। অর্থাৎ আল্লাহ যাদেরকে তাঁর নিদর্শন থেকে বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছেন এবং ইসলামকে অকাট্য ও নির্ভুল সত্য বলে মেনে নেয়ার যোগ্যতা দিয়েছেন। কোন ব্যাপারে মানুষের বক্ষ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া মূলত এমন একটি মানসিক অবস্থার নাম, যখন তার মনে উক্ত বিষয় সম্পর্কে কোন দুচিন্তা বা দ্বিধা-দ্বন্ধ কিংবা সংশয় থাকে না এবং কোন বিপদের আভাস বা কোন ক্ষতির আশংকাও তাকে ঐ বিষয় গ্রহণ করতে বাধা দিতে পারে না, বরং সে পূর্ণ মানসিক তৃপ্তির সাথে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, এ জিনিসটি ন্যায় ও সত্য। তাই যাই ঘটুক না কেন আমাকে এর ওপরই চলতে হবে। এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোন ব্যক্তি যখন ইসলামের পথ অবলম্বন করে তখন আল্লাহ ও রাসুলের (সা:) পক্ষ থেকে যে নির্দেশই আসে তা সে অনিচ্ছায় নয় খুশী ও আগ্রহের সাথে মেনে নেয়। কিতাব ও সুন্নাহ থেকে যে আকাঈদ ও ধ্যান ধারণা এবং যে নীতিমালা ও নিয়ম কানুন তার সামনে আসে তা সে এমনভাবে গ্রহণ করে যেন সেটাই হৃদয়ের প্রতিধ্বনি।

কোন অবৈধ সুবিধা পরিত্যাগ করতে তার কোন অনুশোচনা হয় না। সে মনে করে ঐগুলো তার জন্য কল্যাণকর কিছু ছিল না। বরং তা ছিল ক্ষতি যা থেকে আল্লাহর অনুগ্রহে রক্ষা পেয়েছে। অনুরূপ ন্যায় ও সত্যের ওপর কায়েম থাকার কারণে তার যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে সে সেই জন্য আফসোস করে না, ঠাণ্ডা মাথায় বরদাশত করে এবং আল্লাহর পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পরিবর্তে তার কাছে ঐ ক্ষতি হালকা মনে হয়। বিপদাপদ আসলে তার এ একই অবস্থা হয়। সে মনে করে, আমার দ্বিতীয় কোন পথই নেই-এ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য, যে পথ দিয়ে আমি বেরিয়ে যেতে পারি। আল্লাহর সরল সোজা পথ একটিই। আমাকে সর্বাবস্থায় ঐ পথেই চলতে হবে। বিপদ আসলে আসুক। আল কুরআনে এটিকে ‘শরহে সদর” উন্মুক্ত বক্ষ বা খোলা মন বলা হয়েছে।

লেখক : ব্যাংকার।