জাফর আহমাদ
হাশরের ময়দানে কতককে তার ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে আর কতককে বাম হাতে। ডান হাতে আমলনামা দেয়ার অর্থ হবে তার হিসেব নিকেশ অত্যন্ত পরিস্কার। একজন সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অধিকতর সম্ভবনা হলো, আমলনামা দেয়ার সময়ই সৎ ও সত্যনিষ্ট মানুষগুলো নিজেরাই ডান হাত বাড়িয়ে আমলনামা গ্রহণ করবে কারণ মৃত্যুর সময় থেকে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার সময় পর্যন্ত তার সাথে যে আচরণ করা হবে তাতে তার মনে এতটা আস্থা ও প্রশান্তি থাকবে যে, সে মনে করবে আমাকে এখানে পুরস্কার প্রদানের জন্য হাজির করা হচ্ছে। একজন মানুষ সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে পরপারে যাত্রা করছে, না অসৎ ও পাপি হিসাবে যাত্রা করছে মৃত্যুর সময় থেকেই তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। মৃত্যুর সময় থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত একজন নেক্কার মানুষের সাথে সম্মানিত মেহমানের মত আচরণ করা হয়।
কিন্তু একজন অসৎ ও বদকার মানুষের সাথে আচরণ করা হয় অপরাধে অভিযুক্ত কয়েদীর মত। এরপর কিয়ামতের দিন আখিরাতের জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই নেককার মানুষের জীবন যাপনের ধরণ-ধারণাই পাল্টে যায়। একইভাবে কাফের,মুনাফিক ও পাপীদের জীবন যাপনের ধরণ ভিন্নরূপ হয়ে যায়।
মৃত্যুর সময় নেককার ও বদকারদের অবস্থা: এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “এমন মুত্তাকীদেরকে, যাদের পবিত্র থাকা অবস্থায় ফেরেশতাগণ যখন মৃত্যু ঘটায় তখন বলে, “তোমাদের প্রতি সালাম, যাও নিজেদের কর্মকাণ্ডের বদৌলতে জান্নাতে প্রবেশ করো।” (নাহল : ৩২) “হায়, যদি তোমরা সে অবস্থা দেখতে পেতে যখন ফেরেশতাগণ নিহত কাফেরদের রুহ কবয করছিল! তারা তাদের চেহেরায় ও পিঠে আঘাত করছিল এবং বলছিল “নাও এবং জালাপোড়ার শাস্তি ভোগ করো। এ হচ্ছে সে অপকর্মের প্রতিফল যা তোমরা আগেই করে রেখে এসেছো। নয় তো আল্লাহ তার বান্দাদের ওপর জুলুমকারী নন।” (আনফাল : ৫০-৫১)
কবরের অবস্থা : এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,“হ্যাঁ এমন কাফেরদের জন্য, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করতে থাকা অবস্থায় যখন ফেরেশতাদের হাতে পাকড়াও হয় তখন সংগে সংগেই আত্মসমর্পণ করে এবং বলে, “আমরা তো কোন দোষ করছিলাম না।” ফেরেশতারা জবাব দেয় কেমন করে দোষ করছিলে না! তোমাদের কার্যকলাপ আল্লাহ খুব ভালো করেই জানেন। এখন যাও, জাহান্নামের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ো, এখানেই থাকতে হবে চিরকাল। সত্য বলতে কি, অহংকারীদের এ ঠিকানা বড়ই নিকৃষ্ট” (নাহল : ২৯) “অন্যদিকে যখন মুত্তাকীদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে কি নাযিল হয়েছে, তারা জবাব দেয়, সর্বোত্তম জিনিস নাযিল হয়েছে।
এ ধরণের সৎকর্মশীলদের জন্য এ দুনিয়াতেও মঙ্গল রয়েছে এবং আখিরাতের আবাস তো তাদের জন্য অবশ্যই উত্তম।” (নাহল : ৩০) দুটি আয়াতে মৃত্যুর পর ফেরেশতাদের সাথে মুত্তাকী ও বদকারদের আলাপ আলোচনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলো কুরআন মজিদের এমন ধরণের আয়াতের অন্যতম যেগুলো সুস্পষ্টভাবে কবরের আযাব ও সওয়াবের প্রমাণ পেশ করে।
মৃত্যু ও কিয়ামতের মাঝখানের অবস্থা : এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীস থেকে এ চিত্র পাওয়া যায়। চিত্রটি হচ্ছে, মৃত্যু নিছক দেহ ও রুহের আলাদা হয়ে যাওয়ার নাম। একটি অপরাধী রুহকে ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসাবাদ, তারপর আযাব ও যন্ত্রনার মধ্যে পড়ে যাওয়া এবং তাকে দোযখের সামনে উপস্থাপিত করা-এসব কিছু এমন একটি অবস্থার সাথে সাদৃশ্য রাখে যা একজন খুনের আসামীকে ফাঁসি দেবার তারিখের একদিন আগে একটি ভয়ংকর স্বপ্নের আকারে তার কাছে উপস্থিত হয়। অনুরূপভাবে একটি পবিত্র পরিচ্ছন্ন ও নিস্কুলষ রুহের সম্বর্ধনা, তারপর তার জান্নাতের সুখবব শোনা এবং জান্নাতের বাতাস ও খোশবুতে আপ্লুত হওয়া। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স:) বলেছেন, “তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তিই মারা যায় তাকেই সকাল ও সন্ধায় তার শেষ বাসস্থান দেখানো হতে থাকে। জান্নাতি ও দোযখী উভয়ের ক্ষেত্রেই এটি হতে থাকে। তাকে বলা হয় কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তোমাকে পুনরায় জীবিত করে তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে নেবেন, তখন তোমাকে আল্লাহ সে জায়গা দান করবেন এটা সেই জায়গা।” (বুখারী মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদ)
হাশরের ময়দানের অবস্থা: এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি সৎকাজ নিয়ে আসবে সে তার চেয়ে বেশী ভালো প্রতিদান পাবে এবং এ ধরণের লোকেরা সেদিনের ভীতি-বিহবলতা থেকে নিরাপদ থাকবে। আর যারা অসৎ কাজ নিয়ে আসবে, তাদের সবাইকে অধোমুখে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। তোমরা কি যেমন কর্ম তেমন ফল-ছাড়া অন্য কোন প্রতিদান পেতে পারো?” (নামল : ৮৯-৯০)
হাশরের ময়দানে জান্নাতের হকদার লোকদের সাথে অপরাধীদের থেকে ভিন্নতর ব্যবহার করা হবে। তাদের সম্মানের সাথে বসানো হবে। হাশরের দিনের কঠিণ দুপুর কাটাবার জন্য তাদের আরাম করার জায়গা দেয়া হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, “সেদিন যারা জান্নাতের অধিকারী হবে তারাই উৎকৃষ্ট স্থানে অবস্থান করবে এবং দুপুর কাটাবার জন্য চমৎকার জায়গা পাবে। (ফুরকান : ২৪) সেদিনের সব রকমের কষ্ট ও কঠোরতা হবে অপরাধীদের জন্য। সৎকর্মশীলদের জন্য নয়। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে,আবু সাঈদ খুদরী (রা:) থেকে বর্ণিত নবী (স:) বলেছেন, “সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রান আবদ্ধ, কিয়ামতের মহা ও ভয়াবহ দিবস একজন মু’মিনের জন্য অনেক সহজ করে দেয়া হবে। এমন কি তা এত সহজ করে দেয়া হবে, যেমন একটি ফরয নামায পড়ার সময়টি হয়।” (মুসনাদে আহমাদ) আল্লাহ বলেন, “সেই ভীতিকর অবস্থা তাদেরকে একটুও পেরেশান করবে না এবং ফেরেশতারা এগিয়ে এসে তাদেরকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে এই বলে, “এ তোমাদের সেইদিন যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হতো।” (আম্বিয়া : ১০৩) আল্লাহ আরো বলেন, “যাকে আল্লাহ পথ দেখান সে-ই পথ লাভ করে এবং যাদেরকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তাদের জন্য তুমি তাঁকে ছাড়া আর কোন সহায়ক সাহায্যকারী পেতে পারো না। এ লোকগুলোকে আমি কিয়ামতের দিন উপুর করে টেনে আনবো অন্ধ, বোবা ও বধির করে, এদের আবাস জাহান্নাম। যখনই তার আগুন স্তিমিত হতে থাকবে আমি তাকে আরো জোরে জ্বালিয়ে দেবো।” (বণী ইসরাইল : ৯৭)
হে আরশের মালিক! তুমি আমাদেরকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করো এবং ডান হাতে আমলনামা যাতে গ্রহণ করতে পারি সে কর্ম যেন করে আসতে পারি। আমীন।
লেখক : ব্যাংকার