আসিফ আরসালান

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে কি না, অথবা দলকে নির্বাচন করতে দেয়া হবে কি না, সে বিষয়টি ঝুলন্ত রয়েছে। এ ব্যাপারে বিএনপি বলেছে যে, জনগণ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যদি কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ সম্পর্কে ছাত্রদের নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। তাদের কঠোর অবস্থান হলো, আওয়ামী লীগকে অবশ্যই নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। তাদেরকে রাজনীতিতে আসতে দেয়া যাবে না। নির্বাচনে আসতে গেলে তাদেরকে প্রতিহত করা হবে। জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান হলো, সংস্কার এবং বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে দেয়া যায় না। আসুন, আমরা এক এক করে দলগুলোর অবস্থান পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণ করি।

বিএনপি বলেছে যে, এ ব্যাপারে জনগণই নাকি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। জনগণ কিভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন? বাংলাদেশ কি সে প্রাচীন আমলের সিটি স্টেট যে জনগণ এক জায়গায় জড়ো হয়ে রাজার কাছে বলবেন যে এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক?

আগেই বলেছি, এটি হলো প্রাচীন আমলের ব্যবস্থা। ঐ সব দিন হয়েছে বাসি। তাহলে জনগণের মতামত কিভাবে নেয়া যাবে? সবচেয়ে সহজ যে উপায় ছিলো, সেটি হলো সরাসরি গণভোট অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে ইতোপূর্বে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে গণভোট হয়েছে। এখনো গণভোট হতে পারে। হয়তো কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, গণভোট অনুষ্ঠানের যে অনুচ্ছেদটি সংবিধানে ছিলো সেটিতো অর্থাৎ ১৪১ নং অনুচ্ছেদ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে। তারপরেও কি গণভোট অনুষ্ঠান করা যায়? উত্তর হলো, অবশ্যই করা যায়।

কোনো কোনো মহল এব্যাপারে সংবিধানের দোহাই দেন। তাদের জানা দরকার যে, ড. ইউনূসের সরকার কোনো সাংবিধানিক সরকার নয়। ড. ইউনূস তো নিজেই বলেছেন, তার সরকার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট। এ ব্যাপারে একজনের উক্তি উল্লেখ না করে পারছি না। তিনি হলেন, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহম্মেদ। সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ সরকার তো সাংবিধানিক সরকার। আর গণঅভ্যুত্থানও তো সাংবিধানিক বিষয়। আমার অবাক লাগে যে, আমাদের অনেক বড় বড় জাতীয় নেতা রাজনীতি, সংবিধান ইত্যাদি বিষয়ে গভীরভাবে পড়াশোনা করেন না। সংবিধানের কোথাও একটি অনুচ্ছেদও নেই যেখানে গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের কথা লেখা আছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে সংবিধান বহির্ভূত পথে। অর্থাৎ জনগণ রাস্তায় নেমে রাষ্ট্রশক্তি অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পরাভূত করে শেখ হাসিনাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ব্রিটিশ আইনে তথা বর্তমানে সব দেশের গণতান্ত্রিক সংবিধানে জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলা হয়েছে। সে জন্যই বলা হয়, The awful majesty of the people. জুলাই বিপ্লবে কোটি কোটি জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন এবং নেমে এসে তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে হাসিনা সরকারকে বিতাড়িত করেছেন এবং ড. ইউনূসের ইন্টারিম সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। এ বিপ্লব জনতার বিপ্লব হলেও কয়েকজন ছাত্রনেতা এ বিপ্লবকে সমন্বিত করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাই ড. ইউনূস যখন বলেন যে, তিনি ছাত্র নেতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তখন তিনি আসলে পরোক্ষভাবে কোটি কোটি জনতার ডাকেই সাড়া দিয়েছেন।

॥ দুই ॥

যেহেতু এটি একটি গণঅভ্যুত্থানের সরকার তাই নীতি বা আইনগতভাবে এ সরকারের কোনো মেয়াদ বা সময়সীমা থাকার কথা নয়। যারা বলেন, এ সরকার অনির্বাচিত সরকার, তাদেরকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে সালাউদ্দিন সাহেবদের জিজ্ঞেস করতে চাই, জেনারেল জিয়া যেদিন সেনা প্রধান হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন সেদিন থেকে পরবর্তী গণভোট পর্যন্ত যে প্রায় দুই বছরের সময়, তখন কি তিনি নির্বাচিত ছিলেন? তারপরেও তো তিনি দেশ শাসন করেছেন। এ সময়টির শাসনের বৈধতা নিয়ে কেউ তো কোনো প্রশ্ন করেননি। কারণ তিনি ভালোভাবে দেশ চালিয়েছেন এবং জনগণ সন্তুষ্ট চিত্তে তাকে গ্রহণ করেছিলেন। এজন্য সেটা বৈধতা পেয়েছে। এছাড়া পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেও তাকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। ড. ইউনূসও ভালোভাবে দেশ চালাচ্ছেন। একমাত্র আওয়ামী ঘরানার লোকজন ছাড়া অবশিষ্ট ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ তার দেশ চালনায় সন্তুষ্ট। আজ যদি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার মতো ড. ইউনূসের ক্ষমতায় কন্টিনিউ করা সম্পর্কে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় তাহলে আমি নিশ্চিত, ৯০ শতাংশ মানুষ তাকে ক্ষমতায় রাখার পক্ষে ভোট দেবে। সুতরাং গণভোটের বিধান বাতিল হওয়া সত্ত্বেও অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণভোট করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না করা সম্পর্কে জনমত যাচাই করা যায়।

এবার আমরা আসছি জামায়াতের অবস্থান সম্পর্কে। জামায়াত যেটা বলেছে সেটি হলো সময়ের দাবি। আমাদের কথা বাদ দিন, স্বয়ং জাতিসংঘের রিপোর্ট মোতাবেক মাত্র ২১ দিনে শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ কমান্ডে এবং হুকুমে ১৪০০ শত ছাত্রজনতাকে হত্যা করা হয়েছে। ২০ হাজারেরও বেশি মানুষকে বুলেটের আঘাতে আহত করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে কয়েক হাজার চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। প্রায় ৮ শত আহত ব্যক্তি চিরদিনের জন্য চোখের আলো হারিয়েছেন। তাদের পিতামাতা ভাই-বোনদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়েছে। এরা তাদের স্বামী, সন্তান বা ভাইকে আর ফেরত পাবেন না। কিন্তু এ আওয়ামীরা, যারা গণহত্যার জন্য দায়ী তাদের যদি বিচার হয় তাহলে তারা হয়তো কিছুটা শান্তনা পাবেন। সুতরাং মানবতার খাতিরেও এ বিচারের আগে ইলেকশন হয় কিভাবে? সকলের বিচার সমাপ্ত করা হয়তো অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু ওদের বিচার শুরু হয়েছে, এটুকুতো জনগণ দেখতে চান। তার আগে নির্বাচন করা কোটি কোটি জনগণের আশা আকাক্সক্ষার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতার শামিল।

আর একটি বিষয় কেউ বলেন না। গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব তো আরও অনেক দেশেই হয়েছে। কিন্তু তাই বলে শেখ হাসিনাসহ সমস্ত মন্ত্রী, এমপি, অনেক আওয়ামী পন্থী আমলা, অনেক আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী এবং অনেক আওয়ামী নেতা কর্মী যেভাবে এক সাথে দেশ থেকে পালিয়েছেন সেভাবে অন্য কোনো দেশে এ গণপলায়ন ঘটেনি। বাংলাদেশের একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে দিল্লির সংবাদদাতার রিপোর্টে বলা হয়েছে, আওয়ামী পন্থী নেতাকর্মী ব্যবসায়ী এবং আমলাসহ প্রায় ১ লক্ষ মানুষ ৫ অগাস্টের পর ভারতে পালিয়েছেন। এদের ৯০ শতাংশ রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। অবশিষ্ট ১০ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৪ শতাংশ ত্রিপুরায় এবং অবশিষ্ট ৬ শতাংশ আসাম, দিল্লি প্রভৃতি স্থানে আস্তানা গেড়েছে। সমগ্র পার্টি তাদের সমর্থকসহ বিদেশে পালিয়ে গেছেন এমন নজীর পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।

॥ তিন ॥

এতকিছুর পরেও বাংলাদেশের জনগণ সংযম এবং সহনশীলতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। সিরিয়ায় বাসার আল আসাদের পতনের পর ১ সপ্তাহের মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার বাসারপন্থীদের হত্যা করা হয়েছে। ওবায়দুল কাদের তো বলেছিলেন আওয়ামী লীগের পতন হলে ৫ লক্ষ আওয়ামী লীগারদেরকে হত্যা করা হবে। কই? এমন ইতিহাস বিশ্রুত গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পর একজন আওয়ামী লীগারকেও হত্যা করা হয়নি।

একথা ঠিক কিছু সংখ্যক আওয়ামী পান্ডাদের ঘরবাড়িতে ভাংচুর হয়েছে, শেখ মুজিবের ম্যুরাল ও মূর্তি ভাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু ১৫ বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের মনে আওয়ামী বিরোধী যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছিলো সে তুলনায় সেই বিক্ষোভের বিস্ফোরণের আকার অনেক নগণ্য।

একথা চরম সত্য, এ যে নজীরবিহীন গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লব, সেটি তো কেবল শেখ হাসিনাকে সরিয়ে অন্য কাউকে ক্ষমতায় আনার জন্য নয়। জনগণ চেয়েছিলেন, দেশে এমন একটি পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হোক যেন হাসিনার মতো ফ্যাসিস্টের দানবির পুনরুত্থান আর না ঘটে। সে ব্যবস্থা গ্রহণ করার নামই হলো সংস্কার। এমন একটি ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা যে ন্যূনতম পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সেটুকু না করে তো নির্বাচনে যাওয়া যায় না। সুতরাং আগে যেমন বলেছি, এখনো বলছি, জামায়াতের অবস্থান এ ব্যাপারে বাস্তবের সাথে সংগতিপূর্ণ।

॥ চার ॥

এব্যাপারে ছাত্রদের নতুন দলের অবস্থানকে বলা যেতে পারে আদর্শভিত্তিক। তারা পুুরাতন প্রক্লামেশন বা স্বাধীনতার ফরমানের স্থলে নতুন প্রক্লামেশন বা ফরমান জারি করতে চান। তারা বর্তমানে বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান চান। এটি করার জন্য তারা পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে গণপরিষদের নির্বাচন চান। সে গণপরিষদ যে নতুন সংবিধান রচনা করবে সে সংবিধানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উপহার দেয়া হবে সেকেণ্ড রিপাবলিক বা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র। ছাত্রদের দল অর্থাৎ এনসিপির অবস্থানে কোনো অস্পষ্টতা নেই।

ওপরে যে আলোচনা করা হলো তার আলোকে বলা যায়, এনসিপির তিনটি এজেণ্ডা এ মুহূর্তে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হোক বা না হোক, তাদের অবস্থানের নায্যতাকে প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। এখন শেষ প্রশ্ন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে কিনা। আজকের মতো সংক্ষেপে এটুকু বলতে চাই, হিটলারের নাৎসিবাদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ৮০ বছর আগে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াতে। ইটালিতে ফ্যাসিবাদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে ৮২ বছর আগে। আজও ঐসব দেশে নাৎসিবাদ বা ফ্যাসিবাদ ফিরে আসেনি। মুসোলীনিকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে (মতান্তরে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে)। জার্মানিতে নুরেমবার্গ বিচারের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে অনেককে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। নাৎসি পার্টি কোনো রাজনৈতিক দল ছিলো না। ছিলো একটি সন্ত্রাসী দল। আওয়ামী লীগও কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এটি একটি সন্ত্রাসী দল। সুতরাং এ ক্ষেত্রে জার্মানি এবং ইটালি যে পথে গেছে বাংলাদেশকেও যেতে হবে সে পথে।