গাজী মুহাম্মদ রানা

হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের ১৭ রমযান (১৩ মার্চ, ৬২৪ খ্রি.)। এক সোনালি ভোর উদিত হয়েছিল, যার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল ইতিহাসের গগনে। ঐতিহাসিক বদরের প্রান্তরে সংখ্যায় স্বল্প, অস্ত্রে দুর্বল, কিন্তু ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান ৩১৩ জনের এক বাহিনী দাঁড়িয়েছিল তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তির বিরুদ্ধে। তাঁদের কাছে ছিল না পর্যাপ্ত তলোয়ার, ছিল না রণঘোড়া, ছিল না সুরক্ষিত বর্ম। কিন্তু তাঁদের হৃদয়ে ছিল এক অদম্য বিশ্বাস আল্লাহর সাহায্য আসবেই! একদিকে ৩১৩ জন ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, ন্যূনতম অস্ত্রধারী মুমিন সৈনিক, অন্যদিকে ১০০০ প্রশিক্ষিত, সুসজ্জিত কুরাইশ বাহিনী। সেদিন কাফিরদের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা, যেন মৃত্যুকেও পরোয়া করে না। যেন রক্তের দামে ঈমানের পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত।

তৎকালীন আরবের রীতি অনুসারে প্রথমে শুরু হলো মল্লযুদ্ধ। কুরাইশদের বীর উতবা, শাইবা, ওয়ালিদ অগ্রসর হলে নবীজি (স.) এর নির্দেশ অনুযায়ী মুসলিম বাহিনী থেকে এগিয়ে গেলেন হামযা, আলি ও আবু উবায়দা (রাদিআল্লাহু আনহুম)। তাঁরা মুহূর্তের মধ্যে কুরাইশ বাহিনীর বীর যুদ্ধাদের ধরাশায়ী করে ফেলেন। উপায়ান্তর না দেখে আবু জেহেল মুসলমানদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। মুহূর্তের মধ্যে ঘোড়ার কোড়ের ঘর্ষণে বদরের বাতাসে ধুলো উড়লো, আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হলো, তরবারির ঝনঝনানি বেজে উঠলো! দু’পক্ষের মধ্যে চলছে তুমুল যুদ্ধ। মুসলিমদের মূল পতাকা বহন করছেন মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)। তাঁদের মুখে ছিল তাওহিদের ‘আহাদ আহাদ’ ধ্বনি।

আর প্রিয় নবী (সা.) তাঁর বাহিনীর বিন্যাস শেষেই জায়নামাযে বসে গিয়েছিলেন। অব্যাহতভাবে রবের কাছে সাহায্যর আকুতি জানাতে থাকলেন। সেদিন তিনি কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, “হে আল্লাহ! যদি আজ এ মুষ্টিমেয় দলটি পরাজিত হয়, তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত আপনার নাম নেয়ার মতো কেউ থাকবে না!” এত প্রবলভাবে মিনতি জানাচ্ছিলেন যে, তাঁর কাঁধ থেকে চাদর খুলে পড়ে গিয়েছিল। আবু বকর (রা.) নবীজি (সা.)-এর এ অবস্থা দেখে সহ্য করতে না পেরে বলতে লাগলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! যথেষ্ট হয়েছে। আপনি আপনার রবের কাছে যেভাবে চেয়েছেন, এমন চাওয়া কখনো ব্যর্থ হবে না।” কী এক হৃদয়বিদারক মুহূর্ত! অশ্রুসিক্ত নবীজি, দোয়া করতে করতে কাঁদছেন। সেই ক্রন্দনরত কণ্ঠ, সেই আকুলতা আজও বদরের বাতাসকে প্রকম্পিত করে।

যাইহোক, যুদ্ধ তখনও চলমান। তুমুল যুদ্ধ! কত কাফিরের যে মাথা কাটা পড়লো। মুসলিমদের রক্তও বদরের মাটিকে সিক্ত করল। যুদ্ধ তখন চরম মুহূর্তে পৌঁছাল। অতঃপর নবীজির ডাকে আল্লাহর সাড়া প্রদান আকাশ থেকে তখন নেমে এসেছিল অদৃশ্য সাহায্য (ফেরেশতা)। ফেরেশতারা কেটে দিচ্ছিল শত্রুর গলা, হাত। ভয় ঢেলে দিচ্ছিল তাদের হৃদয়ে। কুরআনের ভাষায়:

“আমি তোমাদের সাথে রয়েছি। মুমিনদের অবস্থান দৃঢ় করে রাখো; অতি শীঘ্রই আমি কাফিরদের অন্তরে ভয় ঢেলে দিব। অতএব তোমার আঘাত করো কাফিরদের ঘাড়ের উপরে, এবং আঘাত করো তাদের প্রত্যেক আঙুলের অগ্রভাগে” (সূরা আনফাল: ১২)। “আমি ক্রমাগত এক হাজার ফেরেস্তা পাঠিয়ে তোমাদের সাহায্য করেছি” (সূরা আনফাল: ৯)। “আর এই দল (কুরাইশ বাহিনী) শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পিছু হটবে” (সূরা আল ক্বামার: ৪৫)।

অবশেষে তুমুল আক্রমণের মুখে কুরাইশ বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হলো এবং শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো। মুসলিমরা অর্জন করলো এক চরম বিজয়। মুসলিমদের মধ্যে থেকে এই যুদ্ধে ১৪ জন শাহাদাতবরণ করেন। আর কুরাইশ বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ছিল চরম পর্যায়ে। তাদের নিহতের সংখ্যা ছিল ৭০ জন। বন্দিও হয়েছিল ৭০ জন, এদের অধিকাংশই ছিল নেতৃস্থানীয় ও ক্ষমতাশীল। গণিমত হিসেবেও মুসলমানরা পেয়েছিল প্রচুর সম্পদ। আর এভাবেই সেদিন মুসলমানরা আল্লাহর অশেষ কৃপায় ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে তাঁদের প্রথম বিজয়ের স্বাদ পেয়েছিল।

বদর কেবল একটি যুদ্ধ নয়, বদর এক অবিনশ্বর চেতনা, এক দাঁত ভাঙা জবাবের নাম। এক তাজা ঈমানের গল্প। যা মুসলিমদের যুগ যুগ ধরে প্রেরণা আর সাহস যোগাবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।