॥ মনসুর আহমদ ॥

বিজ্ঞানে বিগ ব্যাং থিউরি হলো মহাবিশ্বের একটি বিশেষ দিককে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা। কোনো থিউরিকে প্রমাণ করা যায় না, তবে তা ভুল বলে প্রমাণ করা যায়। যদি নিরীক্ষা ও পরীক্ষা কোন থিউরিকে স্বীকৃতি দেয় তাহলে সে থিউরি অধিক দৃঢ় হয় এবং অধিক সংখ্যক বিজ্ঞানীরা তা গ্রহণ করেন। যদি প্রমাণাদি থিউরির সাথে ভিন্নতা পোষণ করে তা হলে বিজ্ঞানীরা অবশ্যই তা পরিত্যাগ করবে, নয় নতুন প্রমাণাদির আলোকে তা পরিমার্জন করবেন। বিগ ব্যাং মহাবিশ্বের শুরু নিয়ে আলোচনা করে। মহাবিশ্বের শুরু মানবজাতির জন্য চরমতম রহস্য ঘেরা একটি বিষয়, যা পুরাণ- বিজ্ঞান (Mythology), দর্শন ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাকে তৎপর করেছে। সৃষ্টিজগতের আদিম অব্যবস্থা সম্পর্কে মহাজাগতিক পৌরাণিক কথা বর্ণনা করা থেকে আরম্ভ করে জটিল অংক ও হিসাব- নিকাশের মাধ্যমে সমসাময়িক মহাজাগতিক চিন্তা, কীভাবে বিশ্ব অস্তিত্বে এসেছে সময়ের ব্যাপ্তিতে জন্ম নিয়েছে। এ বিবর্তন আমাদের অস্তিত্ব ও আমাদেরকে ঘিরে রাখা মহাজগৎ রহস্য উন্মোচনে আমাদের কৌতূহল, কল্পনা ও সংকল্প ব্যাখ্যা করে।

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা যতই মহাজাগতিক গতিবিদ্যার গভীরে প্রবেশ করি, আমরা এর বিশালতা, জটিলতা এবং দীপ্তিতে বিনীত হই, যা সর্বদা বিস্তৃতি ঘটমান মহাজগতের রহস্য ব্যাখ্যা করে। সমস্ত মহাজাগতিক মতবাদ হোক তা বিগ ব্যাং, মহাজাগতিক স্ফীতি অথবা প্রকৃতভাবে অবস্থিত বহুজগতের ধারণা আমাদেরকে মহাজগতের সৃষ্টি ও বিবর্তনের মুগ্ধকর পরিপ্রেক্ষিত পরিবেশন করে। এটি কৌতূহল, বিস্ময়ের উদ্রেক করে এবং তা ব্যতীত মহাজগতের সাথে একটি গভীর সম্পৃক্ততার এবং ভূপৃষ্ঠে একের সাথে অপরের আত্মীয়তার অনুভূতি জন্ম দেয়। তাই আমাদের উচিত মহাবিশ^কে জানার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং লক্ষ করা সত্য আমাদেরকে কোথায় উপনীত করে।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিগ ব্যাং সংঘটিত হয়েছিল এখন থেকে ১৩.৮ মিলিয়ন বছর আগে তখন মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল এক ক্ষুদ্র নিবিড় অগ্নিকুণ্ড যা প্রচণ্ড ভাবে বিস্ফোরিত হয়েছিল তা থেকে। অধিকাংশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করে থাকেন বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি শুরু। কিন্তু এটি প্রথমে ঘটার পেছনে কী কারণ ছিল তা আজও রহস্যজনক ও অজ্ঞাত। বর্তমান সর্বোত্তম অনুমান মতে মহাবিশ্বের ব্যাস ছিল ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। যদি মহাজাগতিক স্ফীতি সঠিক হয় তবে আমরা যে মহাবিশ্বকে দেখে থাকি তা-ই সব নয়। বিজ্ঞান আমাদেরকে জানান দেয় যে, মহাবিশ্ব আকারে অসীম। জ্যোতির্বিজ্ঞানী Fred Hoyle বিগ ব্যাং পরিভাষা চালু করেন, যদিও তিনি পরিবর্তিতে এ পরিভাষাটিকে প্রত্যাখ্যান করেন।

শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ তারাকারাজির দিকে তাকিয়ে ভেবেছে এবং আশ্চার্যান্বিত হয়েছে এ ভেবে যে, মহাবিশ্ব বর্তমান অবস্থায় কীভাবে উপনীত হলো। যে সমস্ত বিজ্ঞানী এ তত্ত্ব উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আইনস্টাইন, এড্উইন হাবল এবং স্টিফেন হকিং।

সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত এবং বলতে গেল সর্বজন স্বীকৃত বিশ্বসৃষ্টি তত্ত্ব থিউরি হল বিগ ব্যাং থিউরি। এ প্রসিদ্ধ থিউরি সম্পর্কে প্রচুর ভুল ধারণা রয়েছে। একটি সাধারণ ভুল ধরণা হলো এ থিউরি মহাবিশ্বের উৎপত্তির ব্যাপারে বর্ণনা প্রদান করে। এটি সম্পূর্ণভাবে ঠিক নয়। আসলে মহাবিশ্ব কীভাবে ক্ষুদ্রবিন্দু ও ঘন অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছলো তার ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করে বিগ ব্যাং। কিন্তু এ থিউরি কীভাবে সৃষ্টির সূচনা হলো বা বিগ ব্যাং এর পূর্বে কী ঘটেছিল এবং মহাবিশ্বের বাইরে কী আছে তা ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করে না।

মহাবিশ্বের ইতিহাস ও এর সৃষ্টি তত্ত্বকে বিস্তারিতভাবে বিগ ব্যাং মডেল হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এ তত্ত্ব বর্ণনা করে যে, ১ ৩.৭৫ বিলিয়ন বছর আগে, মহাবিশ্বের সমস্ত উপাদান ও শক্তি অসীম ঘনত্ব এবং তাপমাত্রাসহ একটি একতায় আবদ্ধ ছিল। এটি দ্রুত প্রসারিত হতে শুরু করে এবং এ সম্প্রসারণটি বিগ ব্যাং নামে পরিচিত। তাই প্রশ্ন জেগেছে এ মহাবিশ্ব কয়েক মিলিমিটার প্রশস্ত থেকে বর্তমান অবস্থার অসীম বিশ্বে কীভাবে পরিণত হলো? এ থিউরির নামকরণ থেকে যেমন মনে হয় বিগ ব্যাং তদ্রুপ মহাশূন্যে কোন বিস্ফোরণকে বুঝায় না। বরং গবেষণায় বলে, মহাবিশ্বের সর্বত্র স্থানের উপস্থিতি বুঝায়। বিগ ব্যাং থিউরি মতে শূন্যে অসীম ঘনত্ব এবং তাপমাত্রার একটি বিন্দু (Singularity), এর থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং এর পূর্বে স্থান-কাল কিছুই ছিল না। তা হলে Singularity কী? এর কোন আকার বা মাত্রা নেই। Singularity কে অঙ্ক শাস্ত্র অনুযায়ী ১ সংখ্যা দিয়ে বর্ণনা করা হয়। সৃষ্টিতত্ত্ববিদগণ বিগ ব্যাং-এর পূর্ব মুহুর্তে কী ঘটেছিল সে ব্যাপার অনিশ্চিত, তবে সফিস্টিকেটেড স্পেস মিশন, ভূমি থেকে দেখা টেলিস্কোপ এবং জটিল অংকের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা প্রাথমিক মহাবিশ্বের একটি স্পষ্ট চিত্র এবং প্রাথমিক সৃষ্টির ব্যাপারে তত্ত্ব সামনে আনতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০০১ সালে নাসা উইকিলসন মাইক্রোওয়েব এনিস্ট্রপি প্রব মিশন আদি মহাবিশ্বের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য কসমিক মাইক্রাওয়েব রেডিয়েশন পরিমাপ করে তত্ত্ব সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করে। অন্যান্য আবিষ্কারের মধ্যে (WMAP) মিশন মহাবিশ্বের ১৩,৭ মিলিয়ন বছর বয়স নির্ণয় করতে সক্ষম হয়।

মহবিশ্বের বয়স যখন খুব কম ছিল তখন মহাবিশ্বে এক অবিশ্বাস্য আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে। সে সময় মহাবিশ্বের যে বিস্তৃতি বা ইনফ্লেশন ঘটে তার ফলে মহাবিশ্ব exponentially বেড়ে যায় এবং কমপক্ষে প্রায় ৯০ গুণ বৃদ্ধি প্রাপ্তি ঘটে। মহাবিশে^র প্রসারতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি শীতল ও এর ঘনত্ব কমতে থাকে। স্থান বৃদ্ধির সাথে সাথে মহাবিশে^র তাপমাত্রা কমে যেতে থাকে এবং পদার্থ সৃষ্টি হতে থাকে।

বিশ্ব সৃষ্টির প্রথম তিন মিনিটের মধ্যে হাল্কা রাসায়নিক পদার্থ সৃষ্টি হয়। মহাবিশ্ব যতই সম্প্রসারিত হতে থাকে তাপমাত্রাও কমতে থাকে এবং প্রোটন ও নিউট্রন ধাক্কাধাক্কি করে, ফলে হাইড্রোজেনের আইসোটপ ডিউটোরিয়াম সৃষ্টি হয়। ডিউটোরিয়ামের অধিকাংশ মিশ্রিত হয়ে হিলিয়ামের সৃষ্টি হয়। বিগ ব্যাং -এর পরবর্তী প্রথম ৩৮০.০০০ বছর মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতে নির্গত তাপ আলো বিচ্ছুরণের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং অণুসমূহ পরস্পর আঘাত হেনে ভেঙ্গে গিয়ে প্রোটন, ইলেকট্রন ও নিউট্রনের স্বচ্ছ প্লাজমা তৈরী করে যা আলোরূপে কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ে।

বিগ ব্যাং-এর ৩৮০.০০০ বছর পরে পদার্থ প্রচুর শীতল হয়ে ইলেকট্রন সমূহ নিউক্লির সাথে সংযুক্ত হয়ে নিউট্রাল এটম সৃষ্টি করে। এ পর্বকে বলা হয় ‘রিকম্বিনেশন’ পর্ব এবং মুক্ত ইলেকট্রন বিশোষণ প্রক্রিয়ার কারণে মহাবিশ্ব স্বচ্ছ হয়। এ সময় যে আলো ছড়িয়ে পড়েছিলো তা কসমিক মাইক্রোওয়েব রেডিয়েশনের মাধ্যমে বর্তমান সময় তা বের করা সম্ভব।

এমনকি, পুনর্মিলনের যুগের আগে তারকা ও বিভিন্ন উজ্জ্বল বস্তু সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এক অন্ধকার যুগ অতিবাহিত হয়েছে।

বিগ ব্যাং -এর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর পরে মহাবিশ^ তার কালো-যুগ (Dark ages) থেকে বের হয়ে আসা শুরু করে। মহাবিশ্বের এ অভিব্যক্তি কালকে ‘রি -আয়োনাইজেশন’ কাল বলা হয়। মনে করা হয়ে থাকে গতিশীল দশা পরিবর্তন হতে অর্ধ বিলিয়ন বছর সময় কেটেছে। কিন্তু বর্তমানের নতুন পর্যবেক্ষণের উপরে নির্ভর করে বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, ‘রি-আয়োনাইজেশন’ আগের চিন্তিত কালের চেয়ে দ্রুত ঘটেছে। এ সময়ে গ্যাস কুণ্ডলী প্রচণ্ড চুপসে গিয়ে সর্বপ্রথম তারকা মণ্ডলী ও গ্যালাক্সি সৃষ্টি হয়। এ শক্তিশালী মুহূর্তে অতি বেগুনী রশ্মি বের হয়ে আসে এবং চার দিকে ঘেরা উিট্রাল হাইড্রোজেন গ্যাসকে ধ্বংস করে। ‘রি-আয়োনাইজেশন’ পদ্ধতি এবং কুয়াশাচ্ছন্ন হাইড্রোজেন মহাবিশ্বকে অতি-বেগুনী রশ্মির জন্য প্রথম বারে নির্মল করে। হিসাব করা হয়ে থাকে,আমাদের সৌর জগৎ বিগ ব্যাং -এর ৯ বিলিয়ন ছর পরে সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান হিসাব মতে আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে বর্তমান ১০০ বিলিয়নের অধিক তারকাদের মধ্যে সূর্য একটি। এটি গ্যালাক্টিক কোর বা গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে ২৫,০০০ আলোক বর্ষদূর থেকে প্রদক্ষিণ করছে।

অনেক বিজ্ঞানীরা চিন্তা করেন যে, সূর্য এবং সৌরজগতের অন্য সব কিছু এক বৃহৎকায় ঘূর্ণায়মান গ্যাসের ও ধূলিকণার মেঘ যা সোলার নেবুলা নামে পরিচিত তা থেকে সৃষ্টি। মহাকর্ষ শক্তি নেবুলাকে ধ্বংস করেছে, এবং তা দ্রুত গুটিয়ে গিয়ে চওড়া চাকতির আকার ধারণ করেছে। এ ঘটনাকালে সমগ্র বস্তু কেন্দ্রাভিমুখে চলে গিয়ে সূর্যের সৃষ্টি করেছে। ১৯৬০এবং১৯৭০ সালে জ্যোতির্বিদগণ ভাবতে শুরু করলেন যে, বর্তমানে পর্যবেক্ষণযোগ্য ভরের চেয়ে অধিক ভর মহাবিশ্বে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। মূল নিউটনিয়ান পদার্থবিদ্যা ইঙ্গিত দেয় যে, গ্যালক্সির প্রান্ত দেশের তারা গ্যালাক্সির কেন্দ্রের তারার চেয়ে অধিক ধীরগতিতে ঘোরে। বিজ্ঞানী রুবিন বলেন যে, গ্যালাক্সির সকল তারকারাজী সমগতিতে কেন্দ্রেকে প্রদক্ষিণ করে।

১৯২০ সালে জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল মহাবিশ্ব সম্পর্কে এক বৈপ্লবিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। লস এঞ্জেলসে তাঁর নব আবিষ্কৃত টেলিস্কোপের সাহায্যে হাবল লক্ষ করেন যে, মহাবিশ্ব স্থির নয় বরং এর বিস্তৃতি ঘটে চলছে। ১৯৯৮ সালে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে অনেক দূরের সুপার নোভা পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, এক বিরাট সময় পূর্বে বর্তমান সময়ের চেয়ে কম গতিতে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতো। এই আবিষ্কার ছিল বিস্ময়কর, কারণ একটি লম্বা চিন্তা ছিল যে, মহাবিশে^র মধ্যকার বস্তুর মহাকর্ষ শক্তি মহাবিশ্বের বিস্তৃতির গতি কমিয়ে দেবে বা এমনকি মহাবিশ্বকে সঙ্কুচিত করে ফেলবে।

যখন মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে অনেক কিছুই আবিষ্কার হয়েছে তখনও অনেক স্থায়ী প্রশ্ন রয়ে গেছে যার উত্তর এখনও মিলেনি। এদের মধ্যে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি দু’টি বৃহত্তম রহস্য, তবুও আকাশ বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এ আশায় যে, সব কিছু কি ভাবে শুরু হয়েছিল তা বুঝা যায় কি না।

বিগ ব্যাং নিয়ে যে আলোচনা তা অতি সংক্ষিপ্তভাবে আল্লাহ তাঁর একটি আয়াতের মাধ্যমে জনিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে,‘ যারা কুফরী করে তারা কি চিন্তা করে দেখে না যে, আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম; এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে; তবু কি তারা ঈমান আনবে না?’ (২১:৩০)

বিগ ব্যাং-এর পূর্বে কী ছিল সে রহস্য মানুষকে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন। স্রষ্টা আল্লাহই। সৃষ্টিকর্ম কেবলমাত্র তাঁরই কৃত। সৃষ্টি করার ক্ষমতা শক্তি ও যোগ্যতা পূর্ণমাত্রায় কেবল তাঁরই রয়েছে। তিনি নিরঙ্কুশ, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছিলেন। সে ইচ্ছাকে তিনি সৃষ্টি কর্মের প্রতি নিবদ্ধ করেছিলেন। ফলে এ বিশ্বলোকের পক্ষে অস্তিত্ব লাভ করা সম্ভবপর হয়েছিল। তাই যেমন তিনি চেয়েছেন, সৃষ্টিটা সেভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। মাঝখানে কোন মাধ্যম বা সহায়কের প্রয়োজন দেখা দেয়নি। মাধ্যম বা সহায়ক হওয়ার সাধ্যও ছিল না, নেই কারুরই। আল্লাহর সে ইচ্ছার নিগুঢ় তত্ত্ব কি, তা কারুর জানা নেই; কারুর পক্ষে তা জানা সম্ভবও নয়। সে ইচ্ছা বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করল কি ভাবে, তা অনুভব করা মানবীয় ক্ষমতার বাইরে। এ তত্ত্ব গভীর তমসাচ্ছন্ন রহস্য। সে রহস্য জানার শক্তি মানুষের নেই।

“আল্লাহই ‘প্রথম’ অর্থ তিনিই সবকিছুর পূর্বে ছিলেন, সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পরেও থাকবেন। বিশ্বলোক বা সৃষ্টিলোক বলতে যেখানে যা আছে, তা কিছুই যখন ছিল না, তখনও তিনি ছিলেন। আর এক সময় যখন এর কিছুই থাকবে না, সব কিছুই ধ্বংস ও নিঃশেষ হয়ে যাবে, তখনও তিনি থাকবেন। কেননা তিনিই একমাত্র শাশ্বত সত্তা। তিনি সময়-কালের হিসাবের ঊর্ধ্বে। যখন এই সময়কাল সূচিত হয়নি, সময়-কালের হিসাব বা গণনার কিছু ছিল না তখনও তিনি স্ব-সত্তায় মহীয়ান হয়েছিলেন। আবার যখন সময়-কালের গতিপ্রবাহ স্তব্ধ হয়ে যাবে, বিশ্বলোক ও সৃষ্টিলোকের সবকিছুই চূর্ণ-বিচূর্ণ, ধ্বংস এবং নিঃশেষ ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখনও তিনি স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবেন। তাঁর নিজের শেষ বা সূচনা নেই, নেই কোন পরিসমাপ্তি। মর্যদায় তিনি যেমন সর্বোচ্চ, সক্রিয়তায়ও তিনি সর্বাগ্রে। তাঁর সত্তা কোন কাল বা সময়ের মধ্যে নয়, সময়ও কালের হিসাবের মধ্যে পড়ে না তাঁর সত্তা ও সক্রিয়তা। কেননা তিনি সব কিছুর মত সময়ও কালের স্রষ্টা। সময়ও কাল তাঁরই সৃষ্টি।

লেখক : প্রাবন্ধিক।