গতকালের পর

সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চতুর্দশ সম্মেলনে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এ ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস হবে নয়াদিল্লিতে, বাংলাদেশে হবে একটি শাখা ক্যাম্পাস। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সার্কভুক্ত অঞ্চলে শিক্ষার বিস্তার ঘটবে।

জরুরি খাদ্য সঙ্কট, খাদ্য ঘাটতি এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় সার্ক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ ব্যাংকে থাকবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ মেট্টিক টন চাল ও গম।

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে পণ্য ও জনগণের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে সার্ক দেশগুলোর রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। চতুর্দশ সম্মেলনের মূল বিষয়বস্ত্ত ছিল কানেক্টিভিটি বা যোগাযোগ।

চতুর্দশ শীর্ষ সম্মেলনে সার্কের অবয়বগত পরিবর্তন ঘটেছে। কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্তি সার্ককে দক্ষিণ এশিয়ার পরিচিতির ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা প্রদান করেছে। সার্ককে পূর্ণ অবয়বে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের অন্তুর্ভুক্তি অত্যন্ত ইতিবাচক দিক।

দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোতে উৎপাদিত ও বাজারজাত করা পণ্যের অভিন্ন মান নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সার্কের দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এর সদর দপ্তর ঢাকায়।

নারী ও শিশু উন্নয়ন, শান্তি প্রতিষ্ঠা, দরিদ্রতা দূরীকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ২০০৪ সাল থেকে সার্ক অ্যাওয়ার্ড দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

সার্ক কার্যক্রমের একটি বিশ্লেষণ : প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত প্রায় আড়াই দশকে সার্কের আওতায় ২১টি চুক্তি এবং অনেকগুলো ঘোষণা আসলেও তার অধিকাংশই বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। ২০০০ সালের মধ্যে এ অঞ্চলের প্রতিটি মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য সার্ক যে অঙ্গীকার করেছিল তা যেমন বাস্তবায়িত হয়নি তেমনি ২০০২ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াকে দারিদ্র্যমুক্ত করার ঘোষণাও এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে। বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে SAPTA I SAFTA-র মতো চুক্তি করা হলেও ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত ৩০ বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বেড়েছে মাত্র ৫.৮ শতাংশ। সন্ত্রাস দমনে একযোগে কাজ করার কথা থাকলেও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিস্তার ও উৎস নিয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহের বেড়াজাল। পক্ষান্তরে সদস্য দেশগুলোর সাধারণ মানুষ মনে করে যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সার্ক নেতৃবৃন্দ যে সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ এশিয়ার চেহারা পাল্টে যেত। অনেকে মনে করেন সদস্য দেশগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস, তাদের মধ্যে স¤প্রীতির অভাব এবং ক্ষমতার দ্ব›দ্ব সার্ককে অনেকটাই অকার্যকর করে তুলেছে।

বাংলাদেশের উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশ নিয়ে সার্কের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ২০০৭ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে আফগানিস্তানকে অষ্টম সদস্য দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইতোমধ্যে গত ২৫ বছরে সার্কের আওতায় ২১টি চুক্তি এবং ১৬টি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। সার্ক দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য সাপটা চুক্তি এবং সন্ত্রাস দমন সংক্রান্ত সনদ সার্কের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হলেও তা এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। ২০০৪ সালে ইসলামাবাদ সম্মেলনে সাফটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরের বছর থেকে তা কার্যকর করার কথা থাকলেও স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা নিয়ে দু’প্রভাবশালী সদস্য রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চুক্তিটির বাস্তবায়ন আটকে আছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভারতের বেনিয়া ও সংরক্ষণনীতি। এছাড়াও আছে স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পরস্পর পরস্পরকে ছাড় না দেয়ার প্রবণতা। ফলে আন্তঃবাণিজ্য স¤প্রসারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। ১৯৮৫ সালে সার্ক যখন যাত্রা শুরু করেছিল তখন এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের হার ছিল ৩.২ শতংাশ। ২৫ বছর পর এখন এ হার মাত্র ৫.৮ শতাংশ। পক্ষান্তরে আসিয়ানের (ASEAN) ক্ষেত্রে আন্তঃবাণিজ্যের হার ২৫ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে তা ৬০ শতাংশের বেশী, সার্কের আওতায় প্রথমে সাপটা ও পরে সাফটা স্বাক্ষরের পরও আন্তঃবাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসেনি। বস্ত্ততঃ ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগের কথা বলা হলেও সার্ক দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ড এখনও খুব কম। এর আগের কয়েকটি শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির অঙ্গীকার করা হলেও আশানুরূপ তেমন অগ্রগতি আসেনি। নিকট প্রতিবেশী হওয়া সত্বেও সার্ক দেশগুলোর সাধারণ মানুষ পরস্পর পরস্পরের বন্ধু হতে পারেনি।

প্রায় প্রতিটি সম্মেলনে সন্ত্রাস দমনে সার্ক নেতারা জোরালো অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ফলপ্রসূ কোনও পদক্ষেপের অভিব্যক্তি ঘটেনি। বরং বড় একটি সদস্য দেশ প্রতিবেশী দেশগুলোতে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে মদদ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং মাওবাদী সন্ত্রাসে জর্জরিত এ দেশটি নিজ দেশে সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ হয়ে তা অন্যদেশে রফতানী করে ভার লাঘবে এখন বদ্ধপরিকর। প্রতিবেশী দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় দেশটি সন্ত্রাসকে এখন পুঁজি হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়। সন্ত্রাসের বিস্তার ও সন্ত্রাসীদের আশ্রয় নিয়ে প্রতিবেশী দেশসমূহের মধ্যে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ চলছে।

২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কায় পঞ্চদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে চারটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে দক্ষিণ এশীয় উন্নয়ন তহবিল গঠন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর হবার কথা থাকলেও তার বাস্তবায়ন অবস্থা অত্যন্ত নড়বড়ে। তিনশ’ মিলিয়ন ডলারের এ উন্নয়ন তহবিলটি দু’বছরের মধ্যেও পূর্ণতা না পাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ-সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে এসডিএফ গঠনের ধারণাটি গৃহিত হয়। পরে ১৯৯৬ সালে সার্ক ফান্ড ফর রিজিওনাল প্রজেক্টস (SFRP) ও সার্ক রিজিওনাল ফান্ড (SRF) একীভ‚ত করে এসডিএফ গঠন করা হয়। সার্ক দেশগুলোর গৃহিত উন্নয়ন কর্মসূচী বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচীসমূহ বাস্তবায়নের জন্যই এসডিএফ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ২০০৪ সালে পাকিস্তানের করাচীতে এসডিএফ-এর গভর্নিং বোর্ডের অষ্টম সভায় সার্কের সদস্য দেশগুলোর প্রস্তাবিত সকল কর্মসূচী অনুমোদন করা হয়। এছাড়াও এ অঞ্চলে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য কর্মসূচী প্রণয়নের লক্ষ্যে সার্ক মহাসচিবের সমীক্ষা প্রস্তাব ও তখন গৃহিত হয়েছিল।

২০০৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশ শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং প্রস্তাবিত এসডিএফ-কে ১০০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দেন। এর পর থেকে এসডিএফ সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে উন্নয়ন তহবিলে ভারত ২০০ মিলিয়ন দেয়ার প্রস্তাব করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৩৪ মিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। ২০০৪ সালে ইসলামাবাদ শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় ফুড ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব করা হয়। সদস্য দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করা এবং আপৎকালীন সময়ে খাদ্য ঘাটতির দেশগুলোতে খাদ্য সরবরাহ এ ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য। তবে সব দেশ এখনো ফুড ব্যাংকের এ প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে। প্রস্তাবিত ফুড ব্যাংকে ২,৪১,৫৮০ টন চাল ও গম মওজুদ রাখার কথা বলা হয়েছে। নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সার্কের আওতায় দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। কয়েক দফা স্থান পরিবর্তনের পর এখন কলকাতার শান্তি নিকেতনে সার্ক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে।

প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার অবনতি, পণ্য মূল্য, ঋণের বোঝা, বহিঃসম্পদের সীমিত অবস্থা, অসম বাণিজ্য এবং উন্নত বিশ্ব কর্তৃক সংরক্ষণ নীতি অনুসরনের ব্যাপারে সার্ক নেতৃবৃন্দ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে নারীদের অংশ গ্রহনের অনুকূলে ও মাদক দ্রব্যের ব্যবসা বন্ধে কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া রেডিও, টেলিভিশনসহ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বেতার কর্মসূচী গ্রহণ, পর্যটন, ছাএ শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি, কারিগরি, বৈজ্ঞানিক ও উন্নয়ন বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও প্রযুক্তি বিনিময়ের জন্য ডকুমেন্টশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তৃতীয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি খাদ্য ভান্ডার গড়ে তোলা, রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের দেশ থেকে বিতাড়ন করে অভিযোগকারী দেশের হাতে তুলে দেয়া এবং পরিবেশ রক্ষায় আঞ্চলিক সহযোগিতার অঙ্গীকার করা হয়। সার্কভুক্ত দেশগুলোর সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি না করা এবং পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলনে সার্ক দেশসমূহের সুপ্রীম কোর্টে বিচারপতি ও পার্লামেন্টের সদস্যদের বিশেষ সার্ক ভ্রমণ দলিল দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পঞ্চম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দারিদ্র্য দূরীকরনের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করা হয়।

এই কমিশন ১৯৯২ সালে তাদের রিপোর্ট পেশ করে এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সম্মেলনে তা অনুমোদিত হয়। এ রিপোর্টে ১০ বছরের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রস্তাব করা হয়। ষষ্ঠ সম্মেলনে সার্ক দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাপটা গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। পরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সাপটা স্বাক্ষরিত হয়। চুুক্ত অনুযায়ী ১৯৯৫ সাল থেকে সাপটা কার্যকর হয়। এর আওতায় ২২৬টি পণ্যের ক্ষেত্রে শূণ্য থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক রেয়াত ঘোষণা করা হয়। সপ্তম সম্মেলনে ঢাকা ঘোষণায় সার্ক তৎপরতার ক্ষেত্রে সমন্বিত কর্মসূচীকে আরো সংহত ও জোরদার করা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও অবক্ষয় রোধে জাতীয়, দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকসহ সব রকমের কর্মসূচী বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। ১৯৯৫ সালে নতুন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত অষ্টম শীর্ষ সম্মেলনে একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক চুক্তির অধীনে পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের আহবান জানানো হয়। মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত নবম শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অবাধ বাণিজ্য প্রসারের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশীয় অবাধ বাণিজ্য এলাকা (সাফটা) গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

দশম সম্মেলনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ত্বরান্বিত করা, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা বিধান, বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ এবং সস্ত্রাস ও মাদক চোরাচালান বন্ধের অঙ্গীকার করা হয়। এছাড়া ২০০২ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনে সার্কের অঙ্গীকার অব্যাহত রাখা এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের কথা বলা হয়। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত একাদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার দৃঢ় অঙ্গীকার, অবাধ বাণিজ্য এলাকা গড়ে তোলা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। ২০০৫ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ শীর্ষ সম্মেলনে ৪৩ দফা ঘোষণায় খাদ্য নিরাপত্তা কার্যকর, এইডস প্রতিরোধে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণসহ অভিন্ন স্বার্থে বহুপাক্ষিক ফোরামে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয়ার কথা বলা হয়। এ সম্মেলন থেকে দক্ষিণ এশিয়ার জনগনের জীবন মানের উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে সার্ক সামাজিক সনদ এবং সন্ত্রাস দমনে অতিরিক্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গঠনের অঙ্গীকার করা হয়। এছাড়া সম্মেলনে আঞ্চলিক সহযোগিতা, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সন্ত্রাস নির্মূল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পারস্পরিক সহযোগিতা ও একযোগে কাজ করার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়।

২০০৭ সালে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ শীর্ষ সম্মেলনে সন্ত্রাস দমন ও যোগাযোগ বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। দিল্লী সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঞ্চলিক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।

২০০৮ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত পঞ্চদশ শীর্ষ সম্মেলনে বহুমুখী যোগাযোগ ও ট্রানজিট সুবিধা, বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানানো হয়। এতে সন্ত্রসীদের ব্যাপারে তথ্য বিনিময় ও আইনগত সহায়তা প্রদান, এসডিএফ সনদ অনুমোদন, দক্ষিণ এশীয় ষ্ট্যান্ডার্ড টেষ্টিং ল্যাবরেটরী প্রতিষ্ঠা এবং সাফটার আওতায় আফগানিস্তানকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সার্কের চ্যালেঞ্জসমূহ : ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ঐক্যবদ্ধভাবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ৭টি দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর মোকাবেলা এবং সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ সাতটি দেশ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এবং অত্যন্ত কাছাকাছি অবস্থিত হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা আসিয়ানের ন্যায় তাদের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যের হার বৃদ্ধি পায়নি, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নতুন বাজার সৃষ্টি, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত। এ শর্ত পূরণে আঞ্চলিক এই সংস্থাটির ভ‚মিকা অত্যন্ত সীমিত বলে প্রতীয়মান হয়। সদস্য দেশগুলোর উপর ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রবণতা এর জন্য প্রধানতঃ দায়ী। সার্কের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের সমস্যাও রয়েছে। একটি বড় ও শক্তিধর দেশ হিসেবে ভারত অন্যান্য দেশগুলোকে সার্কের সম অংশীদার বলে মনে করে না। সার্ক দেশসমূহের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব, প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে ভারতের সম্পর্কের তিক্ততা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রবণতা আঞ্চলিক এ জোটের ঐক্য ও সংহতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এর ফলে বাণিজ্যিক চুক্তিসমূহের ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে করে সদস্য দেশগুলোকে জোট ও চুক্তির বাইরে এসে একক ও দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ গ্রহণ করে স্বস্ব বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করতে দেখা যায়।

সার্কের দু’দশকের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ার আর্থ সামাজিক নীতির স্থপতি হিসেবে নয়, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও সম্মেলনের মাধ্যমে আঞ্চলিক আলাপ-আলোচনা উৎসাহিত করার একটি ফোরাম হিসেবেই সার্কের কর্মকান্ড বেশী পরিচিত লাভ করেছে। একটি আঞ্চলিক সংস্থা বা জোট হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা কতিপয় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। (চলবে)