॥ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম ॥

কুরবানি শব্দটিও ‘কুর্ব’ ধাতু থেকে গঠিত। যার অথ নৈকট্য। কুরবান হল, প্রত্যেক সে বস্তু, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। আর সেখান থেকেই ফারসী বা উর্দু-বাংলাতে গৃহীত হয়েছে ‘কুরবানি’ শব্দটি। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ সূরা হজ্বের ৩৪নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানির বিধান রেখেছি, যাতে তারা গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুগুলো যবাহের সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। যা তিনি তাদেরকে রিযিক হিসাবে দান করেছেন।’ রাসূলে আরবি (সা.) জামে তিরমিযির বর্ণিত হাদীসে ইরশাদ করেন, ‘কুরবানির দিনে রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় আমল আল্লাহর নিকটে আর কিছুই নেই। ঐ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন কুরবানির পশুর শিং, লোম ও ক্ষুর সমূহ নিয়ে হাযির হবে। আর কুরবানির রক্ত যমীনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদার স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কুরবানি দ্বারা নিজেদের নফসকে পবিত্র কর।’ মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)কে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি দেয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মানবজাতিকে যে ত্যাগের শিক্ষা দিয়েছেন, সে আদর্শ ও প্রেরণায় আমরা আমাদের জীবনকে উজ্জীবিত করাই কুরবানির মৌলিক শিক্ষা। বস্তুত ত্যাগ ছাড়া কল্যাণকর কিছুই অর্জন করা যায় না। ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে অফুরন্ত প্রশান্তি। আল্লাহ তাআলা তার হাবীব নবী করিম (সা.)কে নামায ও কুরবানি এ দু’টি ইবাদাতকে একত্রিত করে আদায় করতে আদেশ দিয়ে সূরা কাউসারে ইরশাদ করেন, ‘অতএব আপনি নামায পড়ুন আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে এবং কুরবানি করুন। বিশ^নবী (সা.) সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসূলে করিম (সা.) দীর্ঘ ও সুন্দর শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো মিশ্রিত (মেটে বা ছাই) রঙের দু’টি দুম্বা কুরবানি করেছেন।’ তিনি কোন বছর কুরবানি ত্যাগ করতেন না। যেমন তিনি তাঁর কর্ম দ্বারা কুরবানি করতে উম্মতকে অনুপ্রাণিত করেছেন, তেমনি তিনি তাঁর বাক্য দ্বারাও উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইরশাদ করেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে পশু যবেহ করে সে নিজের জন্য যবেহ করেছে। আর যে ব্যক্তি নামাযের পরে যবেহ করে তার কুরবানি সিদ্ধ হয় এবং সে মুসলমানদের তরীকার অনুসারী হয়।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করে না, সে যেন অবশ্যই আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’’ বক্ষমান নিবন্ধে কুরবানির উদ্দেশ্য ও তৎসম্পর্কিত কিছু মাসআলা আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।

কুরবানির উদ্দেশ্য : মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কুরবানি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সূরা মায়েদায় আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লহর কাছে (কুরবানির পশুর) মাংস, রক্ত পৌঁছে না, বরং আল্লাহর কাছে তোমাদের তাকওয়া (তথা একনিষ্ঠভাবে সম্পন্ন আমল) পৌঁছে।’ সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসে রাসূলে করিম (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারার দিকে এবং তোমাদের সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল। সুতরাং কুরবানিদাতা অবশ্যই একমাত্র মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে তার কুরবানির পশু জবেহ করতে হবে। নতুবা ঐ কুরবানি আল্লাহর দরবারে গৃহিত হবে না।

কুরবানির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মাসআলা

১. কান বা লেজ কাটা পশুর কুরবানি: যে পশুর লেজ বা কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানি জায়েয হবে না। আর যদি অর্ধেকের কম থাকে তাহলে তার কুরবানি জায়েয। তবে যদি জন্মগতভাবেই কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই কুরবানি হয়ে যাবে ।

২. অন্ধ পশুর কুরবানি: যে পশুর দুটি চোখ অন্ধ বা এক চোখ পুরোই নষ্ট সে পশু কুরবানি করা জায়েয নয়।

৩. গর্ভবতী পশুর কুরবানি: গর্ভবতী পশু কুরবানি করা জায়েয। জবাইয়ের পর যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবাই করতে হবে। তবে প্রসবের সময় আসন্ন হলে সে পশু কুরবানি করা মাকরূহ। আর বাচ্চাটা জবেহ না করে সাদকাহ করে দিলেও হবে। আর যদি কুরবানির পশু কুরবানির দিন আসার আগেই বাচ্চা দিলে ওই বাচ্চা জবাই না করে জীবিত সদকা করে দেওয়া উত্তম। যদি সদকা না করে তবে কুরবানির পশুর সাথে বাচ্চাকেও জবাই করবে এবং গোশত সদকা করে দিবে।

৪. পশু কেনার পর দোষ দেখা দিলে: কুরবানির নিয়তে ভালো পশু কেনার পর যদি তাতে এমন কোনো দোষ দেখা দেয় যে কারণে কুরবানি জায়েয হয় না তবে, ওই পশুর কুরবানি সহীহ হবে না। এর স্থলে অন্য পশু কুরবানি করতে হবে। তবে ক্রেতা গরীব হলে (কম) ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারাই কুরবানি করতে পারবে।

৫. বন্ধ্যা পশুর কুরবানি: বন্ধ্যা পশুর কুরবানি জায়েয।

৬. পশুর হাঁটার সক্ষমতা: পশু যদি এমন হয় যে, পায়ে হেঁটে যবেহ করার স্থানে যেতে পারে না। তবে এমন পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নয়।

৭. কোন পশু কত বয়সে কুরবানি বৈধ? উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ইত্যাদির নর-মাদি উভয়টি দ্বারাই কুরবানি করা জায়েয। উটের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর, গরু ও মহিষের কমপক্ষে ২ বছর এবং ছাগল, ভেড়া, দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কম হয়েও এমন হৃষ্টপুষ্ট হয়, যাতে ১ বছর বয়সী মনে হয়, তাহলে তা দ্বারা কুরবানি করা যাবে। তবে কমপক্ষে ৬ মাসের হতে হবে।

৮. শিং কর্তিত পশু: যদি পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙে গিয়ে থাকে তাহলে তা দ্বারা কুরবানি করা যাবে না। আর যদি অর্ধেকের কম বা কিছু অংশ ভেঙে থাকে অথবা একেবারেই শিং উঠেনি, তাহলে তা দ্বারা কুরবানি করা যাবে।

৯. নিজের কুরবানির পশু নিজে জবাই করা: কুরবানির পশু নিজে জবাই করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানিদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা উত্তম।

১০. জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি অংশগ্রহণ: অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না হলে কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ যবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানি সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না।

১১. কুরবানির পশুর দুধ পান করা: কুরবানির পশুর দুধ পান করা যাবে না। যদি জবাইয়ের সময় আসন্ন হয় আর দুধ দোহন না করলে পশুর কষ্ট হবে না বলে মনে হয় তাহলে দোহন করবে না। প্রয়োজনে ওলানে ঠা-া পানি ছিটিয়ে দেবে। এতে দুধের চাপ কমে যাবে। যদি দুধ দোহন করে ফেলে তাহলে তা সদকা করে দিতে হবে। আর নিজে পান করে থাকলে মূল্য সদকা করে দিবে।

১২. কুরবানির গোশত বণ্টন: পবিত্র ঈদুল আযহায় একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশু কুরবানি করাই যথেষ্ট। তবে সামর্থ্য থাকলে একাধিক পশুও কুরবানি করতে পারবে। তবে একা পশু ক্রয় করতে অক্ষম হলে একটি পশুতে একে অপরে শরীক হয়ে সাত ভাগে কুরবানি করা যায়। শরীকে কুরবানি করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবির (রা.) সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসে বলেন, হুদায়বিয়ার সফরে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) সাথে ছিলাম। তখন একটি গরুতে সাত জন ও একটি উটে সাত শরীক হয়ে কুরবানি করেছিলাম।

১৩. কুরবানির গোশত জমিয়ে রাখা: নিজ ভাগের কুরবানির গোশত তিনদিনেরও অধিক জমিয়ে রেখে খাওয়া জায়েয।

পশু কুরবানি মূলত নিজের নফস তথা কুপ্রবৃত্তিকে কুরবানি করার প্রতীক। কুরবানি আমাদেরকে সকল প্রকার লোভ-লালসা, পার্থিব স্বার্থপরতা ও ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনার জৈবিক আবিলতা হতে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে মহান আল্লাহর প্রতি নিবেদিত বান্দা হওয়ার প্রেরণা যোগায় এবং সত্য ও হকের পক্ষে আত্মোৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করে। তাই পশুর গলায় ছুরি চালানোর সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা, কুফর, শিরক, সযতেœ লালিত হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, রিয়া, পরচর্চা-পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মগর্ব, আত্মঅহংকার, কৃপণতা, ধনলিপ্সা, দুনিয়ার মায়া-মুহাববত, কলুষতা প্রভৃতি জঘণ্য পশুসুলভ আচরণের কেন্দ্রমূলে ছুরি চালাতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিটি মুহূর্তে প্রভুর আনুগত্য, আজ্ঞাপালন ও তাক্বওয়ার দ্বিধাহীন শপথ গ্রহণ করে পৃথিবীতে শান্তি ও সাম্যের পতাকা সমুন্নত রাখতে সক্ষম হওয়াই কুরবানির সার্থকতা। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কুরবানির মর্ম অনুধাবন করে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : আরবি প্রভাষক।