দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দরকার জনবান্ধব প্রশাসন। কিন্তু এক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের বড় ধরনের দুর্বলতা। কারণ, নানা কারণেই আমাদের গণপ্রশাসন এখনো পুরোপুরি গণমুখী ও পেশাদারি হতে পারেনি। মূলত, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমলারা সরকারের নীতিনির্ধারণ ও গৃহীত নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। আর আমলাতন্ত্রে স্থায়ী সরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্ব বিভাজনের মাধ্যমে সরকারের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন। আমলারা জনপ্রতিনিধি নন বা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিতও হন না। ফলে রাজনৈতিক সরকারের পরিবর্তন হলেও আমলারা পদ হারান না। সঙ্গত কারণেই আমলাতন্ত্রে সরকার পরিচালনার ধারাবাহিকতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত হয়।
আইন ও সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠায় রয়েছে আমলাদের অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এক্ষেত্রে আমলাদের ঐতিহাসিক অবদান থাকলেও একশ্রেণির দলবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির কারণে আমলাতন্ত্র আপন স্বকীয়তা হারিয়েছে বলেই মনে করা হয়। এজন্য আমাদের দেশের প্রচলিত নেতিবাচক রাজনীতি অনেকটাই দায়ী। আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমলাদের ব্যবহার রাজনীতির সাথে সাধারণ মানুষের দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। যদিও আমলা মানেই মন্দ শ্রেণির মানুষ এমনটা ভাবার কোন সুযোগ নেই। অনেক সৎ, যোগ্য ও প্রতিভাবান আমলাও রয়েছেন আমাদের গণপ্রশাসনে। যারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অতি দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কিন্তু অসৎদের প্রাবল্যে তারা খুব একটা সুবিধা করতে অতীতে পারেন নি; আর এখনো পারছেন না। যা এখন জনপ্রশাসনের জন্য দুষ্ট ক্ষত হয়ে দেখা দিয়েছে।
এক্ষেত্রে নানাবিধ কারণকে দায়ী করছেন গণপ্রশাসন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ, আমলাতন্ত্রে মেধা ও যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ সব সময় নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি। এমসিকিউ পদ্ধতির মাধ্যমে যে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হয়, তার মধ্য দিয়ে প্রকৃত মেধা যাচাই করা সম্ভব হয় না। আবার লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের বিধান করার পর থেকে স্বজনপ্রীতি করার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধ যাচাইয়ের প্রক্রিয়া রাখা হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যপ্রার্থী যাচাইয়ের সুযোগ থাকলেও শুধুমাত্র মূল্যবোধের অভাবে দায়িত্ব পালনে তারা পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা বাজায় রাখতে পারেন না। যা আমাদের দেশের জনপ্রশাসনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
এমতাবস্থায় ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যারা পরীক্ষায় বিভিন্ন স্তর পাস করে সরকারের বিভিন্ন ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন, তারা সবাই প্রত্যাশিত মাত্রায় যোগ্যতা নিয়ে আসতে পারছেন না। ফলে গণপ্রশাসনে যোগ্য, প্রজ্ঞাবান ও মূল্যবোধসম্পন্ন কর্মকর্তার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এর অর্থ এ নয় যে, বর্তমানে আমলাতন্ত্রে যারা কাজ করছেন তারা সবাই অযোগ্য। এদের মধ্যেও অনেক যোগ্য, প্রজ্ঞা ও প্রতিভাবান লোক রয়েছেন; কিন্তু আমলাতন্ত্রের ওপর অনাকাক্সিক্ষত রাজনৈতিক প্রভাবে যোগ্যরা স্তাবক আমলাদের চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। ফলে আমাদের অমলাতন্ত্র স্বকীয়তা হারাচ্ছে বলে অভিযোগ বেশ জোরালো। আর এটাই হয়তো বাস্তবতা।
রাজনৈতিক নেতৃত্বেও ব্যর্থতা ও অপরিপক্কতার কারণে ক্রমান্বয়ে দেশ পরিচালনায় আমলারা অধিকতর প্রভাব বিস্তার করেছেন নিকট অতীতে। যদিও আগস্ট বিপ্লবের পর সে অবস্থার ইষৎ পরিবর্তন হয়েছে। পতিত স্বৈরাচারি আমলে অনেক অবসরপ্রাপ্ত আমলা আবার সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। কারণ, প্রচলিত রাজনীতি প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোগ্য রাজনৈতিক তৈরি করতে পারছে না। সে সময় রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় সৎ, যোগ্য ও জনহিতৈষী রাজনৈতিক নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সরকারি নেতৃত্ব দুর্বল হওয়ায় সব সরকারি কাজে সরকার আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলো। এমনকি সরকার স্বাধীনতা পদক প্রদানেও সাহিত্যবোদ্ধাদের পরিবর্তে ছিলো আমলানির্ভর। ফলে অবলীলায় বঞ্চিত হয়েছেন যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তিরা।
আর পতিত সরকারের আমলা তোষণ ও নির্ভরতার কারণেই ২০২০ এবং ২০২১ সালে যথাক্রমে রইজ উদ্দিন এবং আমির হামজাকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে আবার তা প্রত্যাহার করতে হয়েছে। আবার সে সরকারের কিছু উদ্যোগ আমলাতান্ত্রিক অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সবকিছু মিলে আমলাতন্ত্র বিষয়ে জনমনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি নতুন কিছু নয়। আর কিছু ঘটনা সে প্রশ্নকে আরো জোরালো ভিত্তি দিয়েছিলো। যা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত ছিল না।
উদাহরণস্বরূপ অতীতের কিছু ঘটনা অবতারণা করা যৌক্তিক মনে করছি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে যেসব বিদেশি নাগরিক আমাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছিলেন তাদের সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে সময়ের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ কাজ সম্পন্ন করে। উল্লেখ্য, ৩৩৮ ব্যক্তি ও কয়েকটি সংগঠনকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়। এ সম্মাননায় অন্যান্য উপহারসামগ্রীর সঙ্গে ৩০ ভরি রুপা ও ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনা দিয়ে তৈরি একটি সুদৃশ্য স্মারক ক্রেস্টও প্রদান করা হয়। ২০১১ সালে শুরু করে তিন পর্বে এ সম্মাননা জানাবার কাজ ২০১৩ সালে শেষ হওয়ার পর এ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠে।
বিএসটিআই একটি ক্রেস্ট পরীক্ষা করে এতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পায়। এবিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি বাংলাদেশে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিক জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে দেওয়া মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা ক্রেস্টটি সংগ্রহ করে পরমাণু শক্তি কমিশন ও তাঁতিবাজারের বাংলা গোল্ড প্রাইভেট লিমিটেডে পরীক্ষা করায়। এ পরীক্ষায় ক্রেস্টটিতে সোনা বা রুপা অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে তামা, দস্তা, পিতল, নিকেল। আর এ জালিয়াতির ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন একশ্রেণির সরকারঘেঁষা দুর্নীতিবাজ আমলা।
অভিযোগ ছিলো সরকারি ‘আশ্রয়ন প্রকল্প’ নিয়েও। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল ভূমিহীন নিঃস্ব মানুষকে দু’শতক জমির ওপর বিনা মূল্যে সেমিপাকা ঘর করে দেওয়া। প্রথম পর্বে ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জনকে এমন সুবিধা দেওয়ার পর দেখা যায়, এ প্রকল্পে প্রশাসনের নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তারা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসাজশ করে এ ঘর তৈরিতে এমন দুর্নীতি করে যে, তৈরির পরই অনেক উপজেলায় নির্মিত ঘরের দেওয়াল ধসে পড়ে। পরে তদন্ত হলে এ দুর্নীতির সত্যতা ধরা পড়ে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এসব দুর্নীতিবাজ আমলাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।
এসব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের জনবান্ধব ভালো প্রকল্পগুলোকে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতিবাজরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং সুযোগ পেলে তারা আগামী দিনেও একই কাজ করবেন। শুধু তাই নয়, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে যেসব আমলা নির্বাচন অনুষ্ঠানে দায়িত্ব পেয়েছেন তারা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে জড়িত হয়ে প্রশাসনের গায়ে কালিমা লাগানোর অভিযোগ তো দিবালোকের মতই স্পষ্ট। ফলে নিকট অতীতে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। আর এজন্য আমাদের দেশের স্বার্থান্বেষী ও ক্ষমতা পাগল রাজনীতিবিদরাও কম দায়ী নন।
মূলত, রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও নেতিবাচক রাজনীতির কারণে আমলাতন্ত্রের বড় ধরনের বিচ্যুতি ঘটেছে। ফলে আমাদের দেশের গণপ্রশাসন এখনো পুরোপুরি জনবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। আর আমলাতন্ত্রকে সেবামুখী ও জনবান্ধব করা একটি দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এজন্য সর্বপ্রথমে আমলাদের যোগ্যতা সুনিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় হাত দেওয়া সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে যোগ্য ও মেধাবীরা আমলাতন্ত্রে প্রবেশ করতে পারবেন। তারপর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাদের নিয়োগ পদ্ধতিতে। একই সাথে প্রার্থীর নৈতিক মূল্যবোধ মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকাও জরুরি। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রার্থীর পারিবারিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধও বিবেচনায় আনা দরকার।
রাজনৈতিক পরিচয়ের ধুয়া তুলে অনেক মেধাবীকেই চাকরির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে পতিত স্বৈরাচারি ও ফ্যাসিবাদী আমলে। যা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত ছিলো না। কিন্তু আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ক্যাডারে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের কাজ করা পিএসসিকে সময়োপযোগী করে ঢেলে সাজিয়ে সেখানে মেধাবী ও মূল্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। সরকার সংশ্লিষ্ট, সরকারঘনিষ্ঠ ও আত্মীয়স্বজনদের পিএসসির সদস্য না করে এ ক্ষেত্রে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া দরকার। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে স্বাধীনভাবে পেশাদারিত্বের সাথে সরকারি কর্মকর্তা বাছাইয়ের কাজ করতে দিতে হবে। সর্বোপরি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে উন্নত ও আধুনিকীকরণ করাও খুবই জরুরি। সে ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক ও শ্রেণিকক্ষের লেকচারের মধ্যে প্রশিক্ষণ কাজ সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। ফিল্ড ওয়ার্কের ব্যবস্থা বাড়িয়ে কর্মকর্তাদের বাস্তব জ্ঞানার্জনের সুযোগ দিতে হবে।
প্রশিক্ষণ যেন যুগোপযোগী হয় সে দিকে লক্ষ রাখা খুবই জরুরি। ব্রিটিশ আমলের ১৮৭৩ সালের পুলিশ আইনে পুলিশ চললে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ হবে না বরং অন্তর্বর্তী সরকারের পুলিশ সংস্কার আইন অতিদ্রুত কার্র্র্যকর করে পুলিশ প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। মূলত, আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি। জনগণের জানমালের নিরাপত্তাসহ সকল সমস্যার আইনি সমাধান দেয়া দায়িত্ব প্রশাসনের। অথচ প্রশাসনে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ায় জনমনে প্রশাসন নিয়ে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। আর এ নেতিবাচক ধারণা দূর করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সময়োপযোগী ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে প্রশাসনের সর্বস্তরে সেবামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা সময়ের দাবি। কী নির্বাচনের সময়, কী স্বাভাবিক সময়, প্রশাসকদের কিছুতেই অঘোষিত রাজনৈতিক ডিকটেশনে কাজ করা উচিত নয়। প্রশাসনকে দলীয়করণ করা রাষ্ট্রের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। যা ইতোমধ্যেই দিবালোকের মতই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি উপলদ্ধি করবেন ততই মঙ্গল।
আমলাদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় থাকা ঠিক নয়। যে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতাসীন হবে, প্রশাসনযন্ত্রকে সে সরকারের গৃহীত পলিসি বাস্তবায়নে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। কিন্তু প্রশাসনকে কোনভাবেই রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িত হওয়া ঠিক হবে না। মূলত, আমলাতন্ত্রে দলবাজিই আমাদের দেশের আমলাতন্ত্রকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ফলে প্রশাসন হারিয়েছে গণমুখী চরিত্র। ফলে জনগণ তাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
আমাদের দেশে কতিপয় স্বার্থান্ধ আমলাদের দলবাজি একেবারে নতুন নয়। ১৯৯৬ সালে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে একদল আমলা ‘জনতার মঞ্চ’ তৈরি করে সেখানে সরকারবিরোধী বক্তৃতা করেছিলেন। কিন্তু তারা শাস্তির মুখোমুখী হওয়ার পরিবর্তে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। আর এ ঘটনায় আমাদের দেশের প্রশাসন ব্যবস্থার শৃঙ্খলা নষ্ট করেছে। যা আর স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় জনপ্রশাসনকে অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ, জনবান্ধব ও পেশাদার করার পরামর্শ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকেই।
তবে জনপ্রশাসন বা আমলাতন্ত্র সংস্কারের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেছে। সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদনের গেজেট আকারে জারি হয়েছে। জারিকৃত অধ্যাদেশে চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতায় এনে তিনটি শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো বরখাস্ত, অব্যাহতি এবং বেতন ও পদের গ্রেড কমিয়ে দেয়া। যেসব অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়া যাবে সেগুলো হলো-অনানুগত্য দেখানো ও কাজে বাধা দেয়া, একক বা সমবেতভাবে কাজে অনুপস্থিত থাকা, কাউকে কাজ থেকে বিরত থাকতে উস্কানি দেয়া এবং কাউকে কাজ করতে বাধা দেয়া। অধ্যাদেশের সরকারি কর্মচারীদের আচরণ ও দণ্ড সংক্রান্ত বিশেষ বিধান সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে-কোনো সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য কোনো কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কাজে বাধা তৈরি করে তাহলে সেটি হবে একটি অসদাচরণ। এমন অপরাধের জন্য পদ বা বেতন গ্রেড অবনমিতকরণ, চাকরি হতে অপসারণ এবং এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে। মূলত, ঘোষিত অধ্যাদেশটি জনপ্রশাসনে দলবাজি বন্ধ ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য খুবই সহায়ক হবে বলে মনে করছেন কিছু মানুষ। কিন্তু অনেকেই এ অধ্যাদেশকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিচ্ছেন না বরং তারা প্রত্যাহারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ক্রমেই এগিয়ে আসছে। তাই এ নির্বাচনকে সামনে রেখে জনপ্রশাসনকে ঢেলে সাজানো; দলবাজি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। মূলত, দেশে এমন একটি জনবান্ধব আমলাতন্ত্র ও প্রশাসন দরকার যে প্রশাসন কোনভাবেই রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াবে না বরং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শতভাগ পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার মান রক্ষা করে চলবে। মনে রাখতে হবে, আমলাতন্ত্র ও সুশাসন একে অপরের পরিপূরক। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রকে নাগরিকবান্ধব করতে আমলাতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার সময়ের বড় দাবি। তাই জনপ্রশাসন সংস্কার ও গণমুখী করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আরো কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দেশে সুশাসন ফিরে আসবে না; স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিতে পারে।