ফিলিস্তিন আসলে কী? এটি কি একটি রাষ্ট্র, নাকি কিছু মানুষের জনপদ? এ মানুষগুলো কি স্বাধীন, নাকি ক্রীতদাস? ভূমিপুত্র হওয়ার পরও কি এসব মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করা যায়, হত্যা করা যায়? আরও অনেক প্রশ্ন উত্তপ্ত হয়ে আছে ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে। এ যে এতসব অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন এর মূলে রয়েছে ইহুদীদের জন্য ‘ইসরাইল’ নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র। বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে যার যাত্রা শুরু হয়। ফিলিস্তিনের কথা বলতে গেলে ইতিহাসের অনেক প্রসঙ্গ চলে আসে, তার কিছু এ লেখাতেও উল্লেখ করতে চাইবো।
ফিলিস্তিন আবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে উঠেছে। রোববার ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বৃটেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার স্বীকৃতি প্রদানের পর সংবাদমাধ্যমে নতুনভাবে উঠে এসেছে ফিলিস্তিন। পরিস্থিতির বিশ্লেষণ হচ্ছে নানাভাবে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে নতুন করে স্বীকৃতি দেওয়া পশ্চিমা দেশের তালিকা ক্রমেই বড় হচ্ছে। ওই তিনটি দেশের পর ফ্রান্স, পর্তুগালসহ আরো কয়েকটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে ফিলিস্তিনকে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এমন পরিস্থিতির পরও গাজায় থামছে না ইসরাইলের জাতিগত নিধন। সোমবারও ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৩৭ ফিলিস্তিনি। উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে ১৫৭টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি প্রদানের আরও উদ্যোগ আছে। সামনের দিনগুলোতে আমরা তা দেখতে পাবো। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে বহুপ্রতীক্ষিত দু’রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার আশা করছে পশ্চিমা দেশগুলো। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে যে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল এ দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান। যদিও ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্রদের অনাগ্রহের কারণে এ উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। এখন ইসরাইলের দীর্ঘদিনের মিত্রদের ফিলিস্তিনের প্রতি স্বীকৃতি বাস্তবে বড় কোনো পরিবর্তন আনবে কিনা সেই প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনই বড় কোনো পরিবর্তন না আসলেও এখানে ফিলিস্তিনিদের জন্য শক্তিশালী নৈতিক বিজয়ের বার্তা রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের প্রতি পশ্চিমা বিশে^র সমর্থন আরো জোরদার হবে।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, জাতিসংঘের স্থায়ী ৫ সদস্যের মধ্যে ৪ সদস্যই ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, ব্যতিক্রম শুধু যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই এতকিছুর পরও এখনো ফিলিস্তিনে নির্বিচারে নৃশংস হামলা চালাবার সাহস পাচ্ছে ইসরাইল। প্রায় দু’বছর আগে গাজায় ইসরাইলের হামলা শুরুর পর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৩৪৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭৯৫ জন। বহু মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। আর সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য অনুযায়ী, নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার শিশু রয়েছে। এতো শুধু হতাহতের হিসাব। ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ ভবন ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ২১৩টি হাসপাতাল। স্কুল ১ হাজার ২৯টি, এসব স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল বাস্তচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনে ইসরাইল নামক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯১৭ সালে ‘ফেলফোর ঘোষণার’ মাধ্যমে। এতে সই করেছিলেন যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর। ওই ঘোষণায় ফিলিস্তিন ভূখন্ডে ইহুদিদের জন্য একটি আবাস গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখনো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারলো না কেন?
‘ফিলিস্তিনিদের দুঃখের শতবর্ষ’ এখনো অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সভ্যতার বিশ^াসঘাতকতার জন্যই এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যার মূলে ছিল ‘বেলফোর ঘোষণা’। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর জারি করা বেলফোর ঘোষণাটি ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত। মাত্র ৬৭ শব্দের একটি ঘোষণা, কিন্তু এর কারণে যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়, তা বর্তমান বিশে^র জন্য বড় সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ওই গোষণার শতবর্ষ পূর্ণ হলেও সংকটের কোনো সুরাহা হয়নি। বরং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত এখনো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে। যুক্তরাজ্যে অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ অ্যাভিশ্লায়াম বলেন, বেলফোর গোষণায় বৃটিশ সরকারের জন্য গৌরবের কিছু নেই। এ ঘোষণা ছিল লজ্জাকর ও দুঃখজনক পদক্ষেপ। বৃটিশ সরকারের তাই লজ্জায় মাথা নত করা উচিত। নির্মম বাস্তবতা হলো, শতবছর পর আজও আমাদের ‘বেলফোর ঘোষণা’ নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। ফেলফোর ঘোষণা ছিল ১৯১৭ সালে করা যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিশ্রুতি, ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাস প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি। তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এক চিঠিতে ইহুদি নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথস চাইল্ডকে ওই প্রতিশ্রুতি দেন। ফিলিস্তিন সে সময় অটোমান সা¤্রাজ্যের অংশ ছিল। ইহুদিরা সেখানে ছিল সংখ্যালঘু, মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ ছিল তারা। উল্লেখ্য যে, প্রথম বিশ^যুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) চলাকালীন সময়ে বেলফোর ঘোষণা আসে এবং অটোমান সা¤্রাজ্যের পতনের পর তা বাস্তবায়ন করা হবে বলে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। তথাকথিত এই ম্যান্ডেট-ব্যবস্থা মিত্রশক্তির দেশগুলো তৈরি করেছিল, যা ছিল আসলে ঔপনিবেশিকতা ও দখলদারিত্বের এক নোংরা রূপ। বিশ^যুদ্ধে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও অটোমান সা¤্রাজ্য পরাজিত হওয়ার পর এই ম্যান্ডেটের বলে বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ মিত্রশক্তির কর্তৃত্বে চলে যায়। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে বৃটিশ সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠা (এই লক্ষ্যের বাস্তবায়ন শুরু করার পর বৃটিশ সরকার ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদের ফিলিস্তিনে বসবাসের সুযোগ করে দিতে থাকে। এর পরের ঘটনা তো সবার জানা। ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্ররা আজ ফিলিস্তিনে উন্মূল। সভ্যতার শাসক আমেরিকার সহযোগিতায় যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহুর প্রশাসন ফিলিস্তিনে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম। এ কারণেই হয়তো যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক অ্যাভিশ্লায়াম বেলফোর ঘোষণা’ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এ ঘোষণায় বৃটিশ সরকারের জন্য গৌরবের কিছু নেই, বরং তাদের লজ্জায় মাথানত করা উচিত।
বেলফোর ঘোশষণার শত বছর পর কি বৃটিশ সরকারের মধ্যে কিছুটা বোধোদয় ঘটলো? সে কারণেই কি তারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিল? ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে বৃটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ বিরতির পর আবারও দু’রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বিষয়টি সামনে এসেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে চলতি মাসে ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে সাত পৃষ্ঠার একটি ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়েছে। ঘোষণাপত্রে দু’রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের লক্ষ্যে ‘স্পষ্ট, সময়সীমা নির্ধারিত ও অপরিবর্তনযোগ্য পদক্ষেপ’ নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি হয়। এটাই ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের দু’রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ভিত্তি। ১৯৯৫ সালে ‘অসলো চুক্তির’ দ্বিতীয় পর্ব সম্পন্ন হয়। শক্তিধর কয়েকটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও এ শান্তিচুক্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। এ চুক্তির অধীনে ১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা হয়। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনা বন্ধ রয়েছে। নতুন করে পশ্চিমা প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের স্বীকৃতি এবং ফ্রান্স-সৌদি আয়োজিত সম্মেলন দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দাবিকে আবার জোরালো করে তুললো। এখন প্রশ্ন হলো, ইসরাইল কি এ সমাধান মেনে নেব? না মানলে তো ইসরাইল এ পৃথিবীতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
বিশেষ করে ফিলিস্তিনের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতি বিচ্ছিন্নতার মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। পশ্চিমা দেশগুলো কিন্তু ইসরাইলের মিত্র হিসেবেই পরিচিত। ফিলিস্তিনে দখলদারি ও নৃশংসতা চালানোয় বিশে^র শান্তিকামী মানুষ থেকে আগেই দেশটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্র ইসরাইল কিংবা যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মতামত বা বক্তব্য বিশে^র মানুষের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়, বরং ওরা ঘৃণার পাত্র।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পথে এখন আসলে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র তথা ট্রাম্প প্রশাসন। এদের ছাড়া নেতানিয়াহুর কী মূল্য আছে। ওতো ভিখারি প্রায়। মানুষ তো কম-বেশি ভিখারিই বটে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তিনিও তো একজন ভিখারি, একজন প্রার্থী। তার ভিক্ষার বিষয় নোবেল প্রাইজ, শান্তিনে নোবেল প্রাইজ। তবে তাকে একটি উচিত পরামর্শ দিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেনট এমানুয়েল মাখোঁ। তিনি বলেছেন, নোবেল প্রাইজ পেতে হলে ট্রাম্পকে আগে গাজা যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। ঠিকই তো বলেছেন। যুদ্ধপ্রিয় কাউকে কি নোবেল প্রাইজ দেওয়া যায়? এই প্রাইজের একটা মান আছে না?