জাফর আহমাদ

“কাউকে কাঁদাবেন তো আপনাকে কাঁদতে হবে”, “রক্ত ঝরাবেন তো রক্তই আপনাকে তাড়া করে ফিরবে”, “জুলুম করবেন তো অচিরেই আপনাকে মাজলুমের কাতারে শামিল করা হবে”। মহান আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতেই এ ক’টি কাজের বদলা দিতে দেখেছি। আখিরাতের শাস্তি তো আছেই। দুনিয়ার শাস্তি কি আপনারা দেখেছেন? যদি না দেখে থাকেন তাহলে একটু নিবিড় দৃষ্টিতে আপনার পাশের স্বৈরচারী, অহংকারী, রক্তপিপাসু ও জালিম ব্যক্তিটির দিকে দিকে নজর দিন। দেখুন তার প্রতিটি কু-কাজের ফল কিভাবে তার দিকে প্রত্যাবর্তিত হচ্ছে? সে কাঁদিয়েছে, এখন সে কিভাবে কাঁদছে? সে অহংকার করেছে, কিভাবে তার দম্ভ চুর্ণ-বিচুর্ণ করা হয়েছে? জুলুম-নির্যাতন করেছে, এখন দেখুন সে নিজেই কিভাবে নির্যাতিত হচ্ছে? সে মানুষকে নিজেদের ঘর থেকে বহিস্কার করেছে, এখন দেখুন কিভাবে সে কিভাবে শুধু ঘর ছাড়াই হয়নি বরং তার ঘরখানি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষের ঘর ভেঙ্গেছে, নিজের ঘর ধুলিস্যাত করা হয়েছে। সে মানুষের রক্ত ঝড়িয়েছে, আর সে-ই এখন রক্তের তাড়া খেয়ে তটস্থ এবং রক্ত থেকে বাঁচার জন্য বিদেশ বিভূয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সুতরাং মানুষকে কখনো কাঁদাবেন না। মানুষকে কাঁদানোর জন্য আপনাকে প্রেরণ করা হয়নি। আপনাকে প্রেরণ করা হয়েছে, মানুষের মুখে হাসি ফুটাবার জন্য। মানুষের খুন ঝড়াবেন না, মানুষের ওপর জুলুম করবেন না।

‘পৃথিবীর প্রায় সূচনালগ্ন থেকে একেবারেই অধুনা এ ধরনের বহু উদাহরণ আপনার চোখের সামনে ঘটেছে। তাহলে দেখতে পাবেন না কেন? বাচঁতে হলে, মুক্তি পেতে হলে আপনাকে দেখতেই হবে এবং নিজের কর্মনীতি ও কর্মপন্থা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা আল কুরআনে এ ধরনের জালিমদের কি পরিণতি হয়েছে; তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন।

“কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমার আযাব অকস্মাত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বেলায় অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল। আর যখন আমার আযাব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল তখন তাদের মুখে এ ছাড়া আর কোন কথাই ছিল না যে, ‘সত্যিই আমরা জালেম ছিলাম’।” (সুরা আল আরাফ ৪-৫) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেছেন: “পুর্ববর্তী ইবরাহিমের জাতি এবং আদ, সামুদ ও নুহের জাতি সমুহ এবং মাদায়েনবাসী ও মুতাফিকাতধারীদের ইতিহাস কি তারা জানে না? তাদের কাছে নবীরা সুস্পষ্ট নির্দেশমালা নিয়ে এসেছিলো। আল্লাহ তাদের ওপর জুলুম করেননি বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল। পক্ষান্তরে ঈমানদার নারী-পুরুষেরা পরস্পরের মিত্র ও সহযোগী। তারা ভাল কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে।” (তাওবা : ৭০-৭১)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রায় সারা কুরআনেই ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির ইতিহাস বিশ্ববাসীর শিক্ষা গ্রহনের জন্য উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহ বলেন: “তাদের প্রত্যেককে আমি দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়েছি এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেককে ধ্বংস করে দিয়েছি। আর সে জনপদের ওপর দিয়ে তো তারা যাতায়াত করেছে, যার ওপর নিকৃষ্টতম বৃষ্টি বর্ষণ করা হয়েছিল। তারা কি তার অবস্থা দেখে থাকেনি ? প্রকৃতপক্ষে এরা পরকালে ফিরে যেতে হবে তা চিন্তা করে না।” (সুরা ফুরকান : ৩৯-৪০ ) “জনপদের লোকেরা কি এখন এ ব্যাপারে নির্ভয় হয়ে গেছে যে, আমার শাস্তি কখনো অকস্মাত রাত্রিকালে তাদের ওপর এসে পড়বে না, যখন তারা থাকবে নিদ্রামগ্ন ? অথবা তারা নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে যে, আমার মযবুত হাত কখনো দিনের বেলায় তাদের ওপর এসে পড়বে না, যখন তারা খেলা-ধুলায় মত্ত থাকবে ? এরা কি আল্লাহর কৌশলের ব্যাপারে নির্ভীক হয়ে গেছে? অথচ যে সব সম্প্রদায়ের ধ্বংস অবধারিত তারা ছাড়া আল্লাহর কৌশলের ব্যাপারে আর কেউ নির্ভীক হয় না।” (সুরা আরাফ : ৯৭-৯৯)

জালিমের পরিণতি : রাসুল (স.) বলেন, “আল্লাহ তা’আলা জালিমকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন : তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদ সমুহকে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রনাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য।” (বুখারী-৪৬৮৬, কিতাবুত তাফসীর, বাবু কাউলিহি, সুরা হুদ১০২, আ:প্র: ৪৩২৫, ইফা:৪৩২৬, মুসলিম ও তিরমিযি) রাসুল (স.) আরো বলেন,“কেউ যদি তার কোন ভাই-এর সম্মান হানি কিংবা কোন জিনিসের ক্ষতি করে থাকে, তবে আজই তার কাছ থেকে তা বৈধ করে নেয়া উচিত এবং সেই ভয়াবহ দিন আসার আগেই এটা করা উচিত, যেদিন টাকা কড়ি দিয়ে কোন প্রতিকার করা যাবে না, বরং তার কাছে কোন নেক আমল থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ হিসাবে মজলুমকে সে নেক আমল দিয়ে দেয়া হবে এবং অসৎ কাজ না থাকলেও উক্ত মজলুমের অসৎ কাজ তার ওপর বর্তাবে।” (বুখারী : ২৪৪৯, কিতাবুল মাজালিম, বাবু মানক কানাত মাজলামাতুন........, আ;প্র: ২২৭০,ইফা : ২২৮৭ ওতিরমিযি) একটি দীর্ঘ হাদিসে কুদসীতে রাসুল (স.) বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “হে আমার বান্দারা ! আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পরের ওপর জুলুম করো না।” (মুসলিম : ৬৩৩৮, কিতাবুল বিররী ওয়াস সিলাহ, বাবু তাহরিমিয যুলুম, তিরমিযি)

যে অসহায় মানবতার প্রতি জুলুম করা হলো সে মযলুম মানবতা আর জালেমের রক্ত-মাংস একই উপাদান দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। কারণ একজন মানুষ থেকে সমস্ত মানুষের উৎপত্তি এবং রক্তমাংস ও শারীরিক উপাদানের দিক থেকে তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের অংশ। প্রথমে এক ব্যক্তি থেকে মানবজাতির সৃষ্টি করা হয়। তাঁর থেকেই এ দুনিয়ার মানব বংশ বিস্তার লাভ করেছে। সুতরাং মানুষ মানুষের ওপর কখনো জুলুম করতে পারে না। চাই সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম।

জনৈক আরব কবি বলেছেন, ‘ক্ষমতা থাকলেই জুলুম করো না, জুলুমের পরিণাম অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু নয়। জুলুম করার পর তুমি তো সুখে নিদ্রা যাও, কিন্তু মযলুমের চোখে ঘুম আসেনা। সে সারা রাত তোমার জন্য বদ দোওয়া করে, এবং আলাহ তা শোনেন। কেননা তিনিও ঘুমান না।”

কথিত আছে, ‘ক্ষমতা হারানোর পর রাজা খালেদ বিন বারমাক ও তার ছেলে কারাবন্দী হলে তার ছেলে বললো: আব্বা, এত সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকার পর এখন আমরা কারাগারে? খালেদ বললেন: হ্যাঁ,বাবা! প্রজাদের ওপর জুলুম চালিয়ে আমরা যে রজনীতে তৃপ্তির সাথে নিদ্রা গিয়েছিলাম, আল্লাহ তখন জাগ্রত ছিলেন এবং মজলুমদের দোয়া কবুল করেছিলেন। জুলুম ভয়াবহতা সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে আরো অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। এ জন্য রাসুল (স.) নিত্যদিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় এ দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমি জুলুম ও মাজলুম উভয় থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে এবং আমাদের জালিম শাসকদেরকে জুলুম নামক মারাত্বক কাজ থেকে বিরত রাখুন।

রক্ত ঝড়ানোর পরিণাম: ইসলামে মানুষ হত্যা জঘন্যতম মহাপাপ। আনাস (রা:) হতে বর্ণিত। নবী (স.) বলেছেন: কবীরা গুনাহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সাথে শরীক করা, প্রাণ হত্যা করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া আর মিথ্যা বলা কিংবা বলেছেন মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। (বুখারী : ৬৮৭১, কিতাবুদ দিয়াত, বাবু কাউলিহি তা’আলা, ইফা:৬৪০৫, আ.প্র: ৬৩৯২) অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বপ্রথম হত্যা সুংক্রান্ত মামলার নিস্পত্তি করবেন। শিরকের পর নরহত্যা ছাড়া এর চেয়ে বড় গুনাহ নেই। আলাহর রাসুল (স.) বলেন “মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর নিকট সমস্ত পৃথিবী ও তার যাবতীয় বস্তু নিশ্চয়ই ধ্বংস হয়ে যাওয়া ততটুকু ক্ষতিকর নয়, যতটুকু ক্ষতিকর একজন মুসলমান নিহত হওয়া। এমনি ভাবে হত্যা তো দুরের কথা একজন মুসলমানকে কষ্টও দেয়া যাবেনা। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করে দিয়েছেন, সত্য ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না। আর যে ব্যক্তি মজলুম অবস্থায় নিহত হয়েছে তার অভিভাবককে আমি কিসাস দাবী করার অধিকার দান করেছি। কাজেই হত্যার ব্যাপারে তার সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়, তাকে সাহায্য করা হবে।” (সুরা বনী ইসরাইল : ৩৩)

হত্যা ব্যাপারে সীমা অতিক্রম বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। এ সবই নিষিদ্ধ। যেমন: প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে উন্মত্তের মতো অপরাধী এবং অপরাধী ছাড়া অন্যদেরকেও হত্যা করা। অথবা অপরাধীকে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করে হত্যা করা কিংবা মেরে ফেলার পর তার লাশের ওপর নির্তন কীর্তন করে মনের ঝাল মেটানো। বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড, মিথ্যা দোষারূপে হত্যা, গুম ও গুপ্ত হত্যা। এ সবই সীমা লংঘনপুর্বক হত্যাকাণ্ড।

লেখক : ব্যাংকার।