গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের ধ্বংসলীলা অব্যাহত রয়েছে এবং বিশ্ব মোড়লরা বলতে গেলে এ আগ্রাসন বন্ধে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু করছে না। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়েই আবার লিখতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইসরাইলী আগ্রাসনে গাজায় নিহতের সংখ্যা ৫৪ হাজার ছুঁয়েছে। আর স্থল অভিযান শুরুর কারণে গাজা ইসরাইলী দখলে চলে যেতে পারে মর্মে শংকা দেখা দিয়েছে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণের একটি ক্ষীণ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ইসরাইলী বাহিনীর নতুন সামরিক অভিযান ও মানবিক সহায়তা বন্ধের জেরে ইহুদীবাদী বর্বর এ দেশটির বিরুদ্ধে ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা। এক যৌথ বিবৃতিতে এ হুঁশিয়ারি দেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি। বিবৃতিতে তিন নেতা বলেছেন, ‘আমরা ইসরাইলের সামরিক অভিযান সম্প্রসারণের বিরোধিতা করছি ও এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। সে সঙ্গে গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে’। পাশাপাশি তারা পশ্চিম তীরে অবৈধ ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ ও ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি সম্পর্কেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিন নেতা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, যদি ইসরাইল মানবিক সহায়তা অবরোধ তুলে না নেয়, তাহলে তাদের ওপর টার্গেটেড নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।
কথা হচ্ছে এমন ‘কঠোর’ পদক্ষেপ কবে নাগাদ কার্যকর হবে তার কোন টাইমফ্রেম নেই। ফলে এটা নিয়ে বিশ্লেষরকা খুব বেশি আশ্বস্ত হতে পারছেন না। আলোচনায় যাবার আগে কিছু তথ্য। ৭ অক্টোবর, ২০২৩ এ হামাসের আকস্মিক হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরাইলী নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এর জবাবে ইসরাইল শুরু করে ব্যাপক সামরিক অভিযান। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হামাস ইসরাইল যুদ্ধ শুরুর দেড় বছর পর গত ১৯ জানুয়ারি থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। পরে ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার হামলা শুরু করে ইসরাইল। এ সময়ের মধ্যে ৩৮ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল হামাস। ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য গত ১৫ জানুয়ারি ইসরাইল এবং হামাস একটি যুদ্ধবিরতি এবং বন্দী বিনিময় চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল এবং ১৯ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হয়। প্রস্তাবটি প্রথম খসড়া করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিসর এবং কাতারের মধ্যস্থতাকারীরা। হামাস ৫ মে ২০২৪-এ এতে সম্মতি দেয়। গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় ২ মার্চ। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে আবারও গাজায় নির্বিচার হামলা চালায় ইসরাইল। এ চুক্তির আওতায় ৩৮ জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। বিনিময়ে ইসরাইলী কারাগার থেকে প্রায় ২ হাজার বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়।
দেখা যাচ্ছে, ১৫ মাসের যুদ্ধ শেষে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও মার্চেই তা ভেঙে পড়ে; এরপর ইসরাইল নতুন করে গাজা ভূখণ্ডে অভিযানে নামে। সে অভিযান চলমান।
আবার তিন দেশের কঠোর পদক্ষেপ প্রসঙ্গ। এ নিয়ে কী ভাবছে ফিলিস্তিনী সরকার? এ নিয়ে যুক্তরাজ্যে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত হুসাম জুমলট আল জাজিরাকে বলেন, ‘এ তিন দেশের করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে ইসরাইলের ওপর পুরোপুরি অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা’। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্য কিছু অস্ত্র রপ্তানি স্থগিত করলেও তা যথেষ্ট নয়। একে সম্পূর্ণ ও ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা হতে হবে। তারা অবশ্যই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে সাহায্য করতে হবে’।
আর জাতিসংঘ এবং ইউরোপ কী ভাবছে? এ বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদনকারী ফ্রানচেস্কা আলবানিজ বলেছেন, ‘নিষেধাজ্ঞা কীভাবে ‘টার্গেটেড’ হবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ইসরাইলী নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর নয়, বরং পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে’। পশ্চিমা তিন নেতা বিবৃতিতে নেতানিয়াহুর প্রায় তিন মাস পর মাত্র কিছু ট্রাক ঢোকানোর সিদ্ধান্তকে ‘অপর্যাপ্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন। তারা সতর্ক করে বলেছেন, এর মাধ্যমে ইসরাইল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে পারে। এ নিয়ে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ-নোয়েল বারো মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ইসরাইলের অবরোধ আংশিকভাবে তুলে নেওয়া সম্পূর্ণরূপে অপ্রতুল’। তিনি ফরাসি রেডিওতে বলেন, ‘ইসরাইলী হামলা ও অবরোধের ফলে গাজা একটি মৃত্যুকূপ হয়ে গেছে। সেখানে ইসরাইলের অন্ধ সহিংসতা ও মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া জনগণকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে’। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ‘৮০ দিন টিভিতে সম্প্রচারিত অনাহার আর নির্মমতার পরও চাপ সৃষ্টি করতে এতো দেরি হওয়া নৈতিকভাবে নিন্দনীয়’। শুরুতে যে কথা বলছিলাম তার প্রতিধ্বনি মেলে অ্যামনেস্টির বক্তব্যে।
গাজায় যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার অভিযোগ এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও উচ্চস্বরে আলোচিত হচ্ছে এটা একটা আশার কথা। এত মৃত্যু এত ধ্বংসের মধ্যেও এ আশার আলো আমাদের একটু আশান্বিত করে। আর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও জাতিসংঘের অভ্যন্তরেও নীতিগত অবস্থানে স্পষ্ট পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন রয়ে গেছে, এ হুমকিগুলো বাস্তবায়ন হবে কিনা, নাকি এগুলোও অতীতের মতো নিঃসার হয়ে যাবে।
এরই মধ্যে ইসরাইলের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। রয়র্টাস ও ওয়াশিংটন পোস্ট জানাচ্ছে, গাজায় যুদ্ধ শেষ করতে ব্যর্থ হলে ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ সতর্কবার্তা ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারকে দেওয়া হয়েছে। আলোচনার বিষয়ে জানেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একটি সূত্রের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, ট্রাম্পের প্রতিনিধিরা ইসরাইলকে জানিয়েছেন, যদি তারা গাজা যুদ্ধ শেষ না করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে পরিত্যাগ করবে। ওই সূত্র বলেছে, ট্রাম্পের লোকজন ইসরাইলকে জানিয়ে দিয়েছে, ‘যদি আপনারা এ যুদ্ধ শেষ না করেন, তাহলে আমরা আপনাদের পাশে থাকব না।’ হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিটও বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও গাজা যুদ্ধের অবসান চান।’ গত সপ্তাহে ইসরাইলী বংশোদ্ভূত মার্কিন সেনা এডান আলেকজান্ডারকে মুক্তি দেওয়ার পর এ কথা বলেছিলেন প্রেস সচিব লেভিট। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়েছিলেন। এবারের সফরে তিনি সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরব দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় ট্রাম্প বলেছেন, গাজায় বহু মানুষ অনাহারে রয়েছেন।সেখানে ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটছে।’
ট্রাম্প প্রশাসন ইসরাইলের ব্যাপারে কতখানি যাবে তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে কেউ কেউ মনে করেন, মধ্যপাচ্য সফরকালে তিনি গাজার মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা যে উপলদ্ধি করেছেন তা ইতিবাচক। এর একটা ফল হয়তো হতে পারে।
অপর এক খবরে বলা হয়েছে, গাজায় চলমান সামরিক আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্য। পাশাপাশি দেশটির রাষ্ট্রদূতকেও তলব করেছে লন্ডন। সম্প্রতি হাউজ অব কমন্সে দেওয়া এক বক্তব্যে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি এই ঘোষণা দেন। (সূত্র বিবিসি) তিনি জানান, যুক্তরাজ্য ও ইসরাইলের মধ্যে একটি নতুন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ‘২০৩০ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রোডম্যাপ’ অনুযায়ী দু’দেশের সহযোগিতা পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ল্যামির ভাষায়, নেতানিয়াহু সরকারের কার্যকলাপ এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে যুক্তরাজ্যকে। গাজায় মানবিক সহায়তার ওপর আরোপিত অবরোধের বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরে ডেভিড ল্যামি বলেন, ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র দপ্তরে ডেকে জানানো হয়েছে যে, ত্রাণ সহায়তার পথ রুদ্ধ করা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেন, গাজার পরিস্থিতি এখন ‘অন্ধকারের একটি নতুন ধাপে’ প্রবেশ করেছে। যুক্তরাজ্যের এ উদ্যোগকে বিশ্লেষকরা একটি ভাল অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন।
এতসব আয়োজন সত্ত্বেও ইসরাইলের সামরিক হামলায় আরও ২০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজায় ইসরাইল যে নৃশংসতা চালাচ্ছে, তার বড় শিকার শিশুরা। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯ মাস ধরে চলা হামলায় উপত্যকাটিতে নিহত হয়েছে ১৬ হাজারের বেশি শিশু। সে হিসাবে প্রতি ৪০ মিনিটে একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া হিসাব মতে ইসরাইলের হামলায় নিহত মোট শিশু ১৬ হাজার ২৭৮ জন। এর মধ্যে ৯০৮ জন একেবারে ছোট শিশু এবং ৩১১ জন নবজাতক রয়েছে। এ হিসাব কয়েক দিন আগের। ফলে প্রতিনিয়ত তা বেড়েই চলেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এ সময়টাতে সেখানে মোট ৫৩ হাজার ৫৭৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৫২ ফিলিস্তিনি। বহু মানুষ এখনো নিখোঁজ। এ হত্যালীলা কবে বন্ধ হবে তা অজানা। আর তিন দেশের উদ্যোগ কাজে দেবে কি না ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথার কোন প্রতিক্রিয়া হয় কি না আগামী দিনগুলোতে তা পরিস্কার হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।