ফারুক আহাম্মদ

অপরাজনীতি আমাদের কোনভাবেই পিছু ছাড়ছে না। সে ধারাবাহিকতায় বর্তমান সময়ে ট্যাগিং রাজনীতি আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। কোন ব্যক্তি বা দলকে মিথ্যা লেবেল দিয়ে তার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়া, সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং তাকে দমন নীপিড়ন করাকে জায়েজ মনে করার নাম ট্যাগিং। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ভিন্ন মতকে দমন করতে সারাদেশে ব্যপক জনপ্রিয় টার্ম ছিল ট্যাগ। জি হুজুর বলতে দেড়ি হলেই চলত রাজাকার, আল-বদর, জঙ্গি, জামায়াত কিংবা বিএনপি। যা ছিল আওয়ামী অপরাজনীতির মূলধন।

স্মরণযোগ্য যে, বিগত পতিত সরকারের প্রিয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের স্বার্থবিরোধী কথা বলার কারণেও অনেকে প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। ভারতের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে পোস্ট দেয়ায় জীবন দিতে হয়েছে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে। ভিন্নমতের সন্দেহে হত্যা করা হয়েছে বিশ্বজিৎ নামে এক অমুসলিমকে। সবই করেছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ আর তার দোসররা। রাষ্ট্রীয় বাহিনী দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে অপরাধীর পরিবর্তে ভিকটিমকে গুম, খুন, নির্যাতন এবং কারাগারে পাঠানো হতো নিয়মিত কাজ। বিগত তিনটি নির্বাচনের আগে বিরোধী দল, মত এবং তার অনুসারীদের পুলিশ দিয়ে হয়রানী রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছিল । নির্বাচনের দিন সরকার দলীয় ক্যাডাররা থাকতো মারমুখো মুডে। ভোট কেন্দ্র তারা যা করবে সবই বৈধ হিসাবে মেনে নিলে মিলত গিফ্ট, উপরি আর কথিত পার্টি প্রদত্ত পারিশ্রমিক। আর যদি তাদের প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করতো কেউ-তাকে দেয়া হতো জামাত, শিবির জঙ্গি ট্যাগ। এমন অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় উত্তরবঙ্গে এক প্রিজাইডিং অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।বরাবরই অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে পুরষ্কৃত করা হতো আর ভিকটিম এবং তার পরিবারকে করা হতো হয়রানি।

কোটা আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীরা যখন মাঠে নামলো স্বয়ং পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনোদলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে ট্যাগ দিয়ে এদের দমনকে জায়েজ ঘোষণা করলেন। ভেবেছিলেন ছাত্ররা ভয় পেয়ে আন্দোলন থেকে সরে যাবে। কিন্তু প্রতিবাদী ছাত্ররা হয়ে ওঠে আরও প্রতিবাদী। ওরা শ্লোগান তোলে-‘‘তুমি কে, আমি কে ? রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’’। তখন শুরু হলো ফ্যাসিবাদ হটানোর এক দফার আন্দোলন। ভীষণভাবে চটে যান শেখ হাসিনা । তার মসনদ টিকিয়ে রাখার জন্য যা করতে হয়, তাই করতে বললেন।

রাষ্ট্রের সব বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। দলবলসহ ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দেশে থেকেও অনেক নেতাকর্মী ফেরারি জীবন যাপন করছে। আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম, শান্ত, তাহির, রিয়াদ, জাফর, আসিফ, শাকিল, রুদ্রসহ সহস্রাধিক জীবনের বিনিময়ে ছাত্রজনতার বিজয় অর্জিত হয়।

ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আশা করা হয়েছিল যে, দেশ অন্যায়-অত্যাচার, ঘুষ-দুর্নীতি মুক্ত হবে। মানুষ স্বাধীনভাবে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। শহীদের রক্তে রঞ্জিত এদেশটি আর ভারতের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হবেনা। মানুষ বারবার ঠকবে না। দেশের নাগরিকরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছে ঘুষ না দিয়ে সেবা পাবে। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই সে আশা ম্রিয়মান হতে চলেছে। ঘুষ-দুর্নীতি আগের মতই চলছে, দুর্বলের উপর সবলের দাপট আগের মতই চলছে। চাঁদাবাজি, মাস্তানি চলছে আগের মতই। শুধু নাম বদলেছে, কিংবা মানুষ বদলেছে।

রাজনীতিতে ট্যাগের চর্চা চলছে আগের মতই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একটি সংগঠনকে পুরোনো কায়দায় ট্যাগ দেয়া, হয়রানি করা, হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। অবশ্য সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে ভিকটিম সংগঠনের পজেটিভ কর্মকাণ্ডের কারণে। যার ফলাফল দাঁড়িয়েছে -ট্যাগ দাতারা ছাত্র সমাজের কাছে উপেক্ষিত হয়েছে, আর যাদের বিরুদ্ধে ট্যাগ দেয়া হয়েছিল তাদেরকে ছাত্র সমাজ বুকে টেনে নিয়েছে।

জাতীয় রাজনীতিতে এখন জুলাই বিপ্লবের পক্ষের দলগলোর মধ্যে এখন চলছে সন্দেহ, অবিশ্বাস, প্রতিহিংসা, কাঁদা ছোড়াছুড়ির নোংড়া চর্চা। জুলাই সনদে স্বাক্ষর এবং এর বাস্ববায়ন বিষয়ে দলগুলো একমত হতে পারছে না। সর্বশেষ প্রতিফলন দেখা গেছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সাথে অনুষ্ঠিত সভায় বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি নির্বাচন কমিশন ও বিভিন্ন উপদেষ্টা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। কেউ কোন দলের কথামত কাজ না করলেই তার বিরুদ্ধে অন্য দলের হয়ে কাজ করছে বলে নালিশ দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল এ মতপার্থক্যকে গনতন্ত্রের সৌন্দর্য হিসাবে দেখছে। কেউ কেউ বলছেন-রাজনৈতিক দলগুলোর কথামত এখন নির্বাচন কমিশন এবং উপদেষ্টা পরিষদ পরিবর্তন করা হলে নতুনরা এসে দেশের নির্বাচনী ট্রেনকে কতদূর সচল করতে পারবে? পরিবর্তন করতে গিয়ে পারস্পরিক অনাস্থা আরও বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন কোন কোন বিশ্লেষক।

গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ইদানীং আগামী সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে সে পুরোনো কায়দায় বড় দলগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট দলের নেতাকর্মীদের দমিয়ে দেয়ার জন্য নানাভাবে হয়রানি, হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলা এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। কেন্দ্র দখলে নিয়ে পুরোনো কায়দায় ভোট করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে কিছু দল। তারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের শক্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জাহির করার চেষ্টা করছে।

এখন থেকেই অমুক ব্যক্তি/দলের কেউ কেন্দ্রে আসলে মাথা থাকবে না, অমুককে কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হবেনা-এমন নানা কথা বলা হচ্ছে। গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে এ প্র্যাকটিস। ফলে দীর্ঘ সতের বছর পর মানুষের ভোটাধিকার প্রযোগ করার সুযোগ আসলেও ফ্যাসিবাদি কায়দায় তা ভন্ডুল করে দেয়ার পায়তারায় লিপ্ত হয়েছে দলের মধ্যে কিছু দুষ্কৃতকারী।

পলাতক ফ্যাসিস্ট এবং তার দেশে পালিয়ে থাকা দূসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে বারবার। সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে ওরা সুবিধা করতে পারছে না।

আমরা এর অবসান চাই। প্রত্যেক নাগরিক যেন নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সে নিশ্চয়তা চাই। বাংলাদেশে ট্যাগিং আর ভয়-ভীতির রাজনীতি যেন আর মাথাচাড়া দিতে না পারে সে জন্য কার্যকর পদক্ষেপ চাই। আসন্ন নির্বাচনে যেন সবার জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত হয় সে প্রত্যাশা করি।

লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা ও প্রাবন্ধিক