॥ অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান ॥

বাংলাদেশের চরম দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী অতিবাহিত হলেও ইনসাফভিত্তিক গণতন্ত্রের বুনিয়াদী মূল্যবোধ এখনও পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনি। ক্ষমতার পালাবদল, শাসক ও শোষকের যাতাকলে শাসিতরা শুধুমাত্র মানবাধিকার থেকে বঞ্চিতই হয়নি, পাশাপাশি নানা ধরণের বঞ্চনার শিকার হয়ে জীবনাতিবাহিত করতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবে দুর্বৃত্তায়ন, অনাচার, অবিচার, বিভক্তি, শ্রেণিসংগ্রাম, জুলুম, নির্যাতন, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, খুন, গুম ও প্রতিহিংসার ছোবলে সাধারণ জনগণ কখনও স্বস্থির নিশ^াস ফেলতে পারেনি। তবে এবারের ডাকসু নির্বাচনের ঘোষিত ফলাফল অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মোড় ঘুরাতে পারে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন দেশের সুশীল সমাজ ও বিজ্ঞজনেরা। তারা মনে করছেন, ডাকসুর এ নির্বাচন স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মুল্যবোধ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে টেকসই হওয়ার সম্ভাবনাকে তরান্বিত করবে।

অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীরা গণতন্ত্রের বুনিয়াদী সংজ্ঞা আদতে কতটুকু জানেন এবং বুঝেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাকস্বাধীনতা ও নিজেদের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশের চর্চা যখন ব্যাহত হয় তখন সে অবস্থাকে গণতন্ত্র না বলে স্বৈরতন্ত্র বা এনায়কতন্ত্র বলাই যুক্তিযুক্ত। এদেশে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে যারাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তারা অল্পদিনের ব্যবধানে স্বৈরতন্ত্রের দানবের রুপ ধারণ করেছে।

ফলে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার বিপন্ন হয়ে পড়েছে। শুরুটা হয়েছে বাকশাল কায়েমের মধ্যদিয়ে। এরপর অর্ধশত বছর যাবত যারাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তারই সময়ের ব্যবধানে ফ্যাসিবাদের শাসন চর্চা শুরু করেছে। ফলে এদেশে বার বার রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে চলাফেরা, কথা বলা, মতামত পেশ করা থেকে শুরু করে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধাগ্রস্থ হয়েছে।উৎসব মুখর পরিবেশে নির্বাচন ও অবাধসুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনেকাংশে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসনে চলে গেছে। স্বপ্নের গণতন্ত্র ও বাস্তবতা দীর্ঘদিন হলো আকাশ-পাতাল ফারাক। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। এরপর ১৯৮৬-৮৮, ২০১৪ ও ২০১৮সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। এসব নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টাস অন হিউম্যান রাইটস্ প্রাকটিসেস শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারনা, তুলনামূলক ১৯৭৯, ১৯৯৬, ১৯৯১ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেকাংশে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে অনেকে মতামত দিয়েছেন।

আমরা যদি পিছনের দিকে তাকাই তাহলে বিষয়টি অনায়াসেই খোলাশা হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা চলছে ৫৪ বছর যাবত। খন্ডিত চাঁদ তারকার পরিবর্তে লাল সবুজের পতাকা যেদিন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে উড়তে শুরু করেছে তখন থেকেই মূলত বেশিরভাগ বছরগুলোতে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কখনও বাকশাল, কখনও সামরিক শাসন, কখনও স্বৈরতন্ত্র, কখনও তত্বাবধায়ক সরকার এ দেশ শাসন করেছে।

দেশের অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকগণ তাদের অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে জানান, আওয়ামীলীগের ১৫ বছর ৮ মাসের শাসনকালে ক্ষমতায় টিকে থাকতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে যথেষ্ট ব্যবহার করা হয়েছে। নৃশংস হত্যার ঘটনায় অনেক মামলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল পুলিশের ওপর । এর ফলে পুলিশ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও থেকেছেন জবাবদিহিতার বাইরে। আওয়ামীলীঘ তার দল ও ব্যক্তিগত স্বার্থে বিরোধী দল-মত-অনুসারীদের দমন-পীড়নে বেশি সময় পার করেছে। আইন ও বিচার বিভাগ আওয়ামী প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে তাদের উপর রাষ্ট্রীয় অর্পিত দায়িত্ব পালনের নামে যা ইচ্ছে তাই করতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ শোষণ, বৈষম্য দূর করে দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য একটি মুসলিম অধ্যুসিত রাষ্ট্রকে দি-খন্ডিত করা হয়েছিল। পরিনামে কালের ব্যবধানে এ দুটি রাষ্ট্র মূলত গণতন্ত্রকে অনেকাংশে হত্যা করে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে হতে চলেছে। এতে করে ইসলামের চিরশত্রু ভারতই বেশি লাভবান হয়েছে এবং হচ্ছে বলে সুশীল সমাজের ধারণা। এতে করে প্রমাণিত হয়েছে মানচিত্র ,পতাকা, সংবিধান আর ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই বুনিয়াদী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব এবং সভ্য জনতার প্রয়োজন পড়ে। আমরা আদতে সে যোগ্যতা অর্জনে কতটা সক্ষমতা অর্জন করতে পেয়েছি? এটিই এখন জাতীয় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সে সাথে বিগত দিনে এক শ্রেণির জ্ঞানপাপি সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবি, সংস্কৃতি কর্মীসহ উল্লেখিত পদের ব্যক্তিবর্গ, স্বৈরাচার সরকারের পক্ষে কী পরিমাণ তোষামোদি করে নিজ নিজ আখের গোছানোর জন্য কী পরিমাণ ফায়দা লুটেছেন, তার পরিসংখ্যাণ জাতির সামনে পেশ করাশুরু হয়ে গেছে। পতিত সরকারের তাবেদার আমলা, মন্ত্রী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান ও শীর্ষনেতাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির পর্যালোচনার সময় এসেছে। আশার কথা হলো সংস্কারের ধারাবাহিকতায় সে সব খতিয়ান প্রকাশিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় বর্তমান সরকারের শাসনামলে নানাবিধ সংস্কার চলছে। পতিত সরকারের শাসনামলে যে সব আমলা, মন্ত্রী, নেতা এবং রাঘব বোয়ালেরা অবৈধ পন্থায় জনগণের অর্থ লুটপাট করে বৈভবের পাহাড় গড়েছে, তাদের ও তাদের সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে সরকার। একে একে বের হচ্ছে তাদের কা- কীর্ত্তি ও থলের কালো বিড়াল।। দেশের বাযু দূষণ, শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, আর্সেনিক দূষণ, পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণে যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ায় বাস যোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে, তেমনি অদক্ষ, অযোগ্য, অসৎ, স্বার্থপর প্রকৃতির রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের অপরাধের দৌরাত্ব বেড়ে গিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে পড়েছে।

৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ এবং অত:পর ২৪ এর স্বৈরাচারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে গঠনে যাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তাঁদের উত্তরসুরী হিসেবে শহীদদের জীবনের বদলা নিতে এবং তাদের রক্তের ঋণ শোধ করতে এদেশের যুবসমাজ ও সাধারণ মানুষদের নতুন করে জেগে উঠতে হবে। এবার আসন্ন জাতীয় সংসদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেশের সুশীল সমাজ ও যুবসমাজ কোন ধরণের নেতৃত্বের হাতে দেশের ক্ষমতা অর্পণ করেন সেটির দেখার অপেক্ষা মাত্র। ২৪ এর গণআন্দোলনের ন্যায় সুষ্ঠু নির্বাচনী যুদ্ধ যত বেগবান হবে, ততই এদেশের এ দেশের প্রজারা জালিমের জুলুম আর মজলুমের ফরিয়াদ থেকে মুক্তি পাবে। মুক্তহবে মৃতপ্রায় গণতন্ত্র। কায়েম হবে আম জনতার দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত মানবতা,মানবাধিকার ও ন্যাবিচার।

লেখক : প্রাবন্ধিক।