গত ৮ এপ্রিলে একটি দৈনিকে শিরোনাম দেখলাম যে, ‘সরকারি ফার্মেসি চালু- ২৫০ ধরনের ওষুধ ৩ ভাগের ১ ভাগ দামে পাবে জনগণ’। এ খবরটি স্বস্তির এবং আশার আলো জাগিয়েছে। সত্যিকার অর্থে যদি এ উদ্যোগ কার্যকরী হয় তাহলে চিকিৎসা খাতের চিত্র পাল্টে যাবে। মানুষের ওষুধ ক্রয় করার ভোগান্তি কমবে। এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়- সারাদেশের প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল চত্বরে ফার্মেসি চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এর মাধ্যমে ২৫০ ধরনের ওষুধ ৩ ভাগের ১ ভাগ দামে পাবেন সাধারণ মানুষ। গুণগত ও মানসম্পন্ন ওষুধ সবার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরও বলেন- সরকারের উদ্যোগটি সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় উপকারিতা বয়ে আনবে। আমাদের লক্ষ্য হলো ওষুধের খরচ কমিয়ে স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের কাছে আরও সহজলভ্য করা। সরকারি ফার্মেসি চালু হলে এর মাধ্যমে ৮৫ শতাংশ রোগীর চিকিৎসা সম্ভব হবে, যা স্বাস্থ্য খাতের জন্য একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ। তবে সরকারি ফার্মেসি সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করতে ওষুধ চুরি ঠেকানোর চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা মোবাবিলা করতে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে বলেও জানিয়েছেন। এগুলো সবই ভালো উদ্যোগ। তবে সরকারি হাসপাতালে ফার্মেসি চালু করার আগে দেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান বাড়ানো জরুরী।

মানুষের শরীরে কত রকমই না অসুখ বাসা বাঁধে। কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো গোপনে। আমরা যখন অসুখে আক্রান্ত হই তখনই কেবল একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। আর চিকিৎসা সেবা বলতে আমরা শুধু হাসপাতাল, ডাক্তার আর নার্সকেই বুঝি। অথচ একজন ফার্মাসিস্টও চিকিৎসা সেবার অংশ। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস পালিত হয়। ২০১০ সাল থেকে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয়। কিন্তু প্রচার-প্রচারণা কম থাকায় এ দিবসের তাৎপর্য দৃশ্যমান নয়। ফলে এ দিবসটি মানুষের অজান্তেই চলে যায়। উন্নত বিশ্বে ফার্মাসিস্ট দিয়ে ওষুধের দোকান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে মুদির দোকানেও ওষুধ বিক্রি হয়। অনেকে মনে করে ওষুধের নাম পড়তে পারলেই বুঝি ওষুধের দোকান দেয়া যায়। কোন ফার্মাসিস্টের প্রয়োজন নেই। অথচ রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছাড়া যেমন কেউ প্রেসক্রিপশন লিখতে পারে না, তেমনিভাবে ফার্মাসিস্ট ছাড়া কেউ ওষুধের দোকান দিতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে আইনের তোয়াক্কা না করে কিছু মানুষ যেনতেন উপায়ে মুদির দোকানের মত ওষুধের দোকান দিয়ে বসে পড়ে। একজন ফার্মাসিস্টও ওষুধ বিশেষজ্ঞ। তাঁকে অবজ্ঞা করা যায় না। একজন চিকিৎসক শুধুমাত্র ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ লিখে দেন। আর একজন ফার্মাসিস্ট সে প্রেসক্রিপশন মোতাবেক রোগীকে ওষুধের ব্যবহারবিধি সর্ম্পকে পরামর্শ দেন। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নেই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারাদেশে প্রায় ২ লাখ ১৬ হাজার ৭৯১টি ওষুধের ফার্মেসি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৯৩টি ফার্মেসির নিবন্ধন মেয়াদোত্তীর্ণ। যদিও নিয়ম আছে ফার্মাসিস্ট ছাড়া ফার্মেসির নিবন্ধন পাওয়া যায় না। অথচ ওষুধের দোকানগুলোতে কতজন ফার্মাস্টিট আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। যারা আছে তারা নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই যততত্র অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি করছে। আমরা প্রায়ই খবরে কাগজে দেখি যে, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বাড়ছে। অ্যান্টিবায়োটিক এর যথেচ্ছ ব্যবহার বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ যততত্র ফার্মেসি গড়ে ওঠা। এক সময় থানা সদর কিংবা বাজার ছাড়া ওষুধের দোকান হারিকেন জ¦ালিয়েও পাওয়া যেত না, কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হত। আর এখন হাত বাড়ালেই ওষুধের দোকান পাওয়া যায়। গ্রামে এমনও দেখা গেছে নিজের নাম লিখতে গিয়ে কলম ভেঙে ফেলে, সে লোকও ওষুধের দোকান দিয়ে বসে আছে। মাথা ব্যথার মতো সামান্য বিষয়েও তারা দেদারছে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে দিচ্ছে। দেশে অনিবন্ধিত ও অবৈধ ফার্মেসির ছড়াছড়ি। অনেক ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঝে-মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কিছু টাকা জরিমানা করে। ওই পর্যন্তই শেষ! সুষ্ঠু তদারকি না থাকায় ওইসব ওষুধের দোকান বছরের পর বছর ফার্মাসিস্ট ছাড়াই চলছে। ফলে রোগীদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। অধিকাংশ ফার্মেসিতে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ সংরক্ষণ ও বিক্রয় নীতিমালা মানা হয় না। যে তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করার কথা সে তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয় না। ফলে ওষুধের গুণগত মান বজায় থাকে না। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে নিয়ম অনুযায়ী দু বছর পরপর ফার্মেসির নিবন্ধন নবায়ন করতে হয়। ওষুধ আইন অনুযায়ী নিবন্ধনের মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্মেসিতে ওষুধ মজুত, প্রদর্শন ও বিক্রয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

দেশের মানুষের চিকিৎসাসেবার অন্যতম জায়গা হচ্ছে সরকারি হাসপাতাল। কিন্তু সব সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা জুটছে না। সরকারি হাসপাতালে যথাযত চিকিৎসা সেবা পাওয়া গেলে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ছুটে যেত না। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান না বাড়িয়ে শুধু সরকারি ফার্মেসি চালু করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ অসুস্থ মানুষের আগে চিকিৎসার প্রয়োজন। সঠিকভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করতে না পারলে শুধু ফার্মেসির ওষুধ দিয়ে কী করবে? ফার্মেসি চালু করার আগে দেশের রাজধানী শহর থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসক সংকট ও জনবল সংকট দূর করা প্রয়োজন। বেসরকারি হাসপাতালে সরকারি চিকিৎসক যেভাবে চেম্বার করে সেভাবে সরকারি হাসপাতালে রুটিন মাফিক চিকিৎসক বসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এখনো রাজধানীর বেশ কয়টি হাসপাতালে ১০ টাকায় টিকিট কেটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো যায় যেমন : ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল।

সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন রোগী দেখার ব্যবস্থা করা দরকার। রোস্টার ভিত্তিক চিকিৎসকদের ডিউটির ব্যবস্থা করা এবং অফডেতে যারা ডিউটি করবে তাদের সম্মানির ব্যবস্থা করা গেলে রোগীদের উপকার হবে। পাশাপাশি দেশের সকল সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেন টেস্ট করানোর জন্য বেসরকারি হাসপাতালে ছুটতে না হয়। প্রয়োজনবোধে জাতীয় বাজেটের বরাদ্দ বাড়ানো হোক। তাও যদি করা সম্ভব না হয় তাহলে সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয় করার জন্য একটি ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। এ ফান্ড সরকার করজে হাসানা হিসেবে দেবে অথবা স্থানীয় ব্যাংক থেকে করজে হাসানা হিসেবে অর্থ নেয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের চাহিদা অনুসারে যন্ত্রপাতি ক্রয় করার জন্য যতটুকু অর্থ দরকার ঠিক ততটুকু অর্থ দেয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। টেস্ট থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে করজে হাসানা পরিশোধ করা হবে। কোন রোগী যখনই টেস্ট করাবে সাথে সাথে বিলের টাকাটা ব্যাংকের হিসাবে জমা হয়ে যাবে। এ টাকা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উত্তোলন করতে পারবে না।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেয়া সময় অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও গ্রামীণ হাসপাতালে দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও ওষুধের দোকানের জন্য গ্র্যাজুয়েট ফার্মাস্টি নিয়োগ করা।

লেখক : প্রাবন্ধিক