আমাদের দেশে যতগুলো সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে মাদক একটি অন্যতম প্রধান ও ভয়াবহ সমস্যা। বিশেষ করে আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর ভবিষ্যত প্রজন্মকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তারাও জেনেশুনে বিষপান করছে। কিন্তু পরিণতি কী তা একবারও ভাবছে না। মাদক কারও কল্যাণ বয়ে না; বরং এক নিষ্ঠুর ঘাতকের মতো পরিবারের সুখ-শান্তি কেড়ে নেয়। কেড়ে নেয় মানুষের প্রাণ। অথচ মাদকের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ দেশে এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে মাদকের বিস্তার নেই। শহর হোক বা গ্রাম-সব জায়গায় মাদকের হটস্পট। মাদক মস্তিস্কের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। ফলে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। আইনগতভাবে বলতে গেলে, গাঁজা, হেরোইন, কোকেন, তামাক, অ্যালকোহলসহ অনেক কিছুই মাদকদ্রব্য হিসেবে চিহ্নিত। আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত। অথচ একটি দেশের সম্ভাবনা ও উন্নতির প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে তরুণসমাজ। আধুনিক প্রযুক্তি ও শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণরাই পারে একটি জাতিকে সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে, তারই প্রমাণ-জুলাই ছাত্র গণঅভ্যুত্থান, যেখানে তারুণ্যের বিজয় ঘটেছিল। কিন্তু আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। মাদক একজন ব্যক্তির মস্তিষ্ক ও শ্বাসযন্ত্র ধ্বংস করে দেয়। নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের ভয়াবহ অবক্ষয় দেখা দেয়। ফলে নেশার টাকা দিতে না পেরে সন্তানের হাতে কখনো বাবা, কখনো মা, কখনো ভাই, কখনো চাচা খুন হচ্ছে। পত্রিকার পাতায় চোখ ভুলালেই এ ধরনের নিষ্ঠুর খবর তাড়িয়ে বেড়ায়। অথচ এমন একটা সময় ছিল পুলিশ মাদকের গন্ধ পেলেই অভিযান চালাতো, এখন পুলিশের নাকের ডগায় কিশোর-তরুণরা প্রকাশ্যে দিন দুপুরে মাদক সেবন করে। রাজধানী ঢাকায় চলার পথে বিভিন্ন ফুটওভারব্রিজ, পরিত্যক্ত মাঠ কিংবা পার্কে শিশু কিশোর, তরুণরা মাদক সেবন করছে। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। এর আশু অবসান কাম্য!
সম্প্রতি দেশের কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় মাদকের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। পত্রিকার ভাষ্যনুসারে দেশের ২৯টি সীমান্তবর্তী জেলার ১৬২টি রুট দিয়ে ইয়াবা, আইস, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, টপেন্টাডল, কোকেনের মতো ভয়াবহ মাদক দেদারছে দেশে প্রবশে করছে। এটা শুধু আইন প্রয়োগ করেই হবে না, মাদকের প্রবেশের ১৬২টি সীমান্ত রুট বন্ধ করতে হবে। সীমান্ত সুরক্ষায় বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয়; বরং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। মাদকের সহজলভ্যতা, পারিবারিক কলহ, হতাশা ও বেকারত্বের কারণে মাদকাসক্তির হার বাড়ছে। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এর বিস্তার ঘটেছে। রাজনৈতিকভাবে মাদকের প্রসারও অস্বীকার করা যায় না। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সাবেক সংসদ সদস্য বদিকে মাদকের গডফাদার বলা হয়।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৮৫ জন গডফাদার এবং ১২৩০ জন মাদক কারবারির তালিকা হালনাগাদ করার নির্দেশ দিয়েছে-যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক এক সাক্ষ্যাতকারে বলেন- বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না সত্ত্বেও দেশের সর্বত্র মাদকের সয়লাব। এতে বোঝা যায় সীমান্ত পথে অথবা আকাশপথে এসব মাদক দেশে প্রবেশ করছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সীমান্ত সুরক্ষায় বিচ্ছিন্ন কোনো কার্যক্রম পরিচালনা না করে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। নয়তো মাদকের লাগাম টানা সম্ভব হবে না। আগে শহরের অলিগলিগুলোতে মাদক বেচাকেনার স্পষ্ট হলেও এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পবিত্র স্থান মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা মাদকের নীল ছোবলে জেনেশুনে বিষ পান করছে।
মাদক শুধু নিজের ক্ষতি করেই ক্ষান্ত হয় না। দেশের অর্থনীতিকেও পঙ্গু করে দেয়। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থার ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৪৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা) মাদকের কারণে পাচার হয়ে যায়। মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। জাতিসংঘ ১৯৮৭ সালে ৭ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত নেয় , প্রতিবছর ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস পালন করা হবে। তারপর থেকে বিশ্বব্যাপী নানা দেশে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশেও ২৬ জুন এ দিবসটি পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘শৃঙ্খল ভাঙার আহবান: সবার জন্য প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিরাময়’- এই স্লোগান যেন কেবল প্রতীকী না থেকে বাস্তব রূপ লাভ করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইন রয়েছে। বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ অনুযায়ী ইয়াবা, সিসা, কোকেন, হেরোইন ও পেথিড্রিন জাতীয় মাদকের ব্যবহার, সেবন, বহন, আমদানি-রপ্তানি বা বাজারজাত করার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সৌদিআরবে মাদক বিক্রি করার অপরাধে মৃত্যুদন্ড হতে পারে।
পত্রিকার ভাষ্যনুসারে দেশে বর্তমানে মাদাকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ। এর মধ্যে ৬১ লাখ গাঁজায়, ২৩ লাখ ইয়াবা এবং ২০ লাখ ২৪ হাজার মানুষ মদ্যপানে আসক্ত। ফেনসিডিল, হেরোইন, ঘুমের ওষুধ ও আঠা সেবনকারীর সংখ্যাও লক্ষণীয়। ৩৯ হাজার মানুষ শিরায় মাদক গ্রহণ করে। ২০২২ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ৫৮% পথশিশু মাদকে আসক্ত, ৩১.৭% গাঁজা সেবন, ১৫.২% ড্যান্ডিতে আসক্ত এবং ১৪% শিশু ১০ বছর বয়সের আগেই মাদক সেবন করে। মুসলিম প্রধান দেশে হিসেবে মাদকের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় থাকার কথা, সেখানে মাদকের ছোবলে আমাদের কলিজার টুকরা সন্তানগুলো ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না। না পারছি, ধর্মীয় শিক্ষায় সন্তানকে মানুষ করতে, না পারছি ইসলামের অনুশাসন পরিবারে বাস্তবায়ন করতে। ইসলামে মাদক গ্রহণ হারাম। হাদিসে রাসূল (সা.)-এ বর্ণিত হয়েছে, ‘‘মদ পান করো না, কারণ তা সব অনাচারের চাবিকাঠি।’’ (ইবনে মাজা)। হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের কিছু নিদর্শন হলো ইলম লোপ পাওয়া, অজ্ঞানতার বিস্তার, মদ্যপান ও মাদকের প্রসার, ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়া। (বুখারি) কুরআনে বলা হয়েছে- ‘‘শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শক্রতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদিগকে আল্লাহর স্মরণে ও নামাজে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না? (সুরা: মায়েদা, আয়াত : ৯১)
জন্মের পর পরই কেউ মাদকাসক্ত হয়ে উঠে না। মাদকাসক্ত হয়ে উঠার পেছনে কেউ না কেউ দায়ী। যাদের প্ররোচনা কিংবা যাদের কারণে মাদকের সংখ্যা বাড়ছে, সেসব কীটদের সবার আগে ধরা প্রয়োজন। যারা মাদক সেবন করে তারা আমাদেরই সমাজের অংশ, তারাও দেশের সম্পদ। তাদের ও চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু অনেকের ভাগ্যে সেবাটুকু জুটছে না। ফলে কেউ কেউ বিনা চিকিৎসায় দিনপাত করছে। তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন। কারণ অসুস্থ জাতি কখনো উন্নয়নের রোল মডেল হতে পারে না। সুতরাং দেশের স্বার্থে মাদকাসক্ত প্রত্যেকটি মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন নিরাময় কেন্দ্র বাড়ানোর। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এর ভাষ্যনুসারে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ৩৮৭ টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। নতুন করে সরকারিভাবে ঢাকায় ২৫০ শয্যার এবং দেশের বাকি ৭টি বিভাগে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট আরও ৭ পূর্ণাঙ্গ মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ।
তবে এসব প্রতিষ্ঠানে রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা সেবা পাবেন কিনা সে বিষয়টি আগেই নিশ্চিত করতে হবে। দেশের যুব সমাজকে মাদকমুক্ত রাখতে সামগ্রিকভাবে মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যারা মাদক গ্রহণ বা বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত, তাদের রাষ্ট্রীয় সেবার ক্ষেত্রে ‘‘মাদক সংশ্লিষ্ট নয়’’ এ মর্মে চারিত্রিক সনদ বাধ্যতামূলক করা দরকার। আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার বাড়ানো প্রয়োজন। প্রয়োজন সামাজিক বয়কট, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করা। গ্রামের গ্রাম্য পুলিশ, আনসার, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, স্কুল কলেজের শিক্ষক মন্ডলী, ইমাম ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলতে হবে। জীবন মোদের একটাই! তাই জীবনকে ভালোবাসুন! মাদক থেকে দূরে থাকুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক