॥ মোসা. মিশকাতুল ইসলাম মুমু ॥
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর- কোথাও বাস উল্টে গেছে, কোথাও ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেছে পথচারীর, আবার কোথাও রিকশাচালক চাপা পড়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ঈদ বা অন্য কোনো উৎসব কিংবা লম্বা কোনো ছুটির সময়ে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে যায়। বেপরোয়া গতির যানবাহন, নিয়ম ভঙ্গের সংস্কৃতি, ফিটনেসবিহীন যান, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং দায়িত্বশীল মহলের উদাসীনতা মিলে দেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এমন ভয়াবহতা কতদিন চলবে? কেন আমাদের সড়ক ব্যবস্থা এতটা বিপর্যস্ত? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়Ñ সমাধান কী?
সড়ক দুর্ঘটনা এক অবর্ণনীয় দুঃখের প্রতিচ্ছবি, যা মুহূর্তের মধ্যে জীবনকে বদলে দেয়; ছিন্নভিন্ন করে দেয় হাজারো সুখের মুহূর্ত। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর ছড়িয়ে পড়ে এক ভয়ানক শোকের স্তব্ধতা, যে শোক কখনোই মুছে যায় না। এক মায়ের বুকফাটা কান্না, এক বাবা বা স্ত্রীর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা, যা শব্দহীন এক বিপর্যয়ের সাক্ষী। ছোট্ট শিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায়, তার পৃথিবী আচমকা অন্ধকার হয়ে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনা শুধু শারীরিক ক্ষতি নয়, তা এক হৃদয়বিদারক যন্ত্রণার সৃষ্টি করে, ফলে একটি পরিবারের স্বপ্নগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। আহতদের চোখে যে শূন্যতা থাকে, তা কোনো কথায় বোঝানো সম্ভব নয়। এমনকি একটি প্রাণ হারানো কষ্টের চেয়ে বড় যে বেদনা, তা হলো সে প্রাণ হারানোর পর যে নিঃসঙ্গতা ও শূন্যতা সংশ্লিষ্ট পরিবারের মধ্যে অবশিষ্ট থাকেÑ যা কখনো পূর্ণ হয় না, কোনো দিন ফিরে আসে না।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান ভয়াবহ। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন এবং আহত হচ্ছেন আরও বেশি। বিগত বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৬০৮ জন আহত হন। এরমধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ২ হাজার ৫৭০ জনের, যা এককভাবে মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৪৩.৬৩ শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬২১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৬০৮ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ৫৯৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫৭৮ জন। নারী ও শিশুরাও এই প্রাণহানির তালিকায় রয়েছে। মার্চ ও এপ্রিল মাসেও দুর্ঘটনার হার ঊর্ধ্বমুখী। শিক্ষার্থী, শ্রমিক, পথচারী কিংবা পরিবহন চালকÑ নিরাপত্তাহীনতার এই দুষ্টচক্র থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। প্রতিদিনের এসব মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের নিরাপত্তাহীনতার গভীর সংকটে ফেলে দিচ্ছে, যা রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে, যা মূলত প্রশাসনিক দুর্বলতা, অবকাঠামোগত ত্রুটি, আইনের শিথিল ও দুর্বল প্রয়োগ ও পরিবহন খাতের চরম বিশৃঙ্খলার এর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। দেশের সড়কে প্রতিনিয়ত বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলের চালকরা যেন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অধিকাংশ চালকই যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই অথবা ঘুষ দিয়ে অর্জিত লাইসেন্স নিয়ে সড়কে নামেন। এর পাশাপাশি মাদকাসক্ত চালকের সংখ্যা যেমন উদ্বেগজনক, তেমনি বেপরোয়া ওভারটেকিং প্রবণতাও ভয়াবহ দুর্ঘটনার অন্যতম উৎস। রাস্তার অবস্থা অনেক জায়গায় বেহালÑ খানা-খন্দে ভরা, পরিকল্পনাহীন ফ্লাইওভার, সংকীর্ণ মোড় ও সিগন্যালবিহীন ক্রসিং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। উপরন্তু মহাসড়কের পাশে অবৈধ দোকান, হাট ও স্ট্যান্ড যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং তাৎক্ষণিক থামতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এসব কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয় আইন প্রয়োগের দুর্বলতা। অনেক সময় অপরাধী চালকরা শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যান, কারণ ট্রাফিক ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও ঘুষ লুকিয়ে রয়েছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর আধিপত্য এমন যে, তারা অপরাধী চালকদের রক্ষায় সরব হয়, আন্দোলন করে, ফলে প্রশাসন অনেক সময়ই চাপের মুখে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রিত গণপরিবহনের অভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি ও অনিয়ন্ত্রিত পরিবহনের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে, যার ফলে সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট ও বিশৃঙ্খলা। প্রতিযোগিতামূলক বাস চালনা, যাত্রী তুলতে গিয়ে বেপরোয়া গতি, আর ফিটনেসবিহীন গাড়ির দৌরাত্ম্যÑ সব মিলিয়ে প্রতিটি দিনই যেন মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পথ চলা।
সড়ক দুর্ঘটনা শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি কাঠামোগত সমস্যা, যার প্রভাব ব্যক্তি জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে গভীরভাবে পড়ে। প্রতিবছর হাজারো প্রাণহানিতে অসংখ্য পরিবার আর্থিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত যাঁরা হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। তাঁদের মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ পরিবারের জন্য দুঃসহ ট্র্যাজেডি, রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায় এবং এটি জাতীয় উৎপাদনশীলতায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের খরচ, বীমা ও ক্ষতিপূরণের বোঝা অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলে। দুর্ঘটনার কারণে যানজট, গণপরিবহনে অনীহা এবং যানবাহনের ক্ষয়ক্ষতিও বেড়ে যায়। অপরদিকে, বিচারহীনতা, দুর্বল আইন প্রয়োগ ও পরিবহন সংগঠনের চাপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। মানুষ ট্রাফিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারায় এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এসব কারণে দেশে প্রায়ই বিক্ষোভ ও অস্থিরতা তৈরি হয়,যা সামগ্রিকভাবে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও বাস্তবমুখী উদ্যোগ, যেখানে ব্যক্তিগত সচেতনতা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সবকিছু অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রথমত, জনসচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি- স্কুল, কলেজ, গণমাধ্যম ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত ট্রাফিক আইন ও নিরাপদ চলাচলের বিষয়ে প্রচার চালাতে হবে। চালকদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা যাচাই করে লাইসেন্স প্রদান নিশ্চিত করতে হবে, এবং মাদকাসক্ত বা লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। পাশাপাশি রাস্তার খানা-খন্দক সংস্কার, নিরাপদ জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ, ও ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহন খাতে প্রতিযোগিতামূলক বাস চালনা বন্ধ করে রুটভিত্তিক শৃঙ্খলিত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন-সিসিটিভি, স্পিড ক্যামেরা ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি, দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আইন ভঙ্গকারীরা ভয় পায় এবং নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য হয়। এভাবে সচেতনতা, আইন, অবকাঠামো ও নৈতিকতা- এই চারটি স্তম্ভের ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে একটি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা।
সড়ক দুর্ঘটনা একটি জাতীয় সংকট। জীবনহানি, অর্থনৈতিক ক্ষতি, অব্যবস্থাপনা ও জনমানসে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি এ সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। এ সংকট নিরসনে এখনই সড়ক পরিবহন আইনের কঠোর প্রয়োগ, সমন্বিত ও কার্যকর কৌশল গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে, সাধারণ মানুষকে আইন মেনে চলায় উৎসাহিত করাই হতে পারে একটি নিরাপদ ও উন্নত সড়ক ব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।