আসিফ আরসালান
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান প্রধান উপদেষ্টাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি গুজবের প্রতি মনোযোগ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘পুরো সেনাবাহিনী সরকারের সব উদ্যোগ ও কর্মসূচি সফল করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সব ধরনের গুজব ও রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনী সতর্ক রয়েছে।’
গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে এ কথা বলেন সেনাপ্রধান। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের অবদান অব্যাহত রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীর এ ভূমিকা আরও সুসংগঠিত করা জরুরি। এর মধ্যে স্পষ্ট কমান্ড কাঠামো ও সব বাহিনীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান গত সোমবার প্রথমে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সাক্ষাৎকালে সেনাপ্রধান তার সাম্প্রতিক চীন সফরের বিভিন্ন বৈঠকের অভিজ্ঞতা ও আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন। পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং তা উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
আলোচনায় সেনাপ্রধান আশ্বস্ত করেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। এ ছাড়া সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ চলমান উন্নয়নমূলক কার্যক্রমসহ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন বলে জানিয়েছে আইএসপিআর।
গুজব সম্পর্কে সেনাবাহিনী এবং জেনারেল ওয়াকারের পুরো বক্তব্যই আমরা এখানে তুলে দিলাম। কিন্তু তার পরেও কথা থেকে যায়। গুজবের উৎপত্তি হচ্ছে কেনো? কারা ছড়াচ্ছে এসব গুজব? এসব গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর যদি সেগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে সে মিথ্যা গুজবের জন্য এপর্যন্ত কতজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে? আমি যেসব প্রশ্ন এখানে তুললাম সেসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর ও সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত এসব গুজব ঠেকানো যাবে না। আমি এখন দু’একটি উদাহরণ দিচ্ছি। তারপর আমার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও মন্তব্য দেব।
গত ২ সেপ্টেম্বর একটি ভিডিও দেখলাম। এ্যাঙ্কর হলেন সুলতানা রহমান। তার কয়েকটি ইউটিউব ভিডিও দেখলাম। এ ভদ্র মহিলার ভিডিওতে আলোচক হিসাবে খুব ঘন ঘন রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে ডাকা হতো। কলিমুল্লাহ সাহেব আবার তার নামের আগে লে. কর্ণেল যোগ করতেন। অর্থাৎ তার নাম প্রকাশ করা হতো এভাবে, ‘লে. কর্ণেল ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ’। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করবো, সুলতানা রহমানের গত ৬ মাসের ভিডিও গুলো দেখুন। সেগুলোতে ড. কলিমুল্লাহর বক্তব্য দেখুন। তিনি ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে অসংখ্য বার বলেছেন যে ড. ইউনূস এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের মধ্যে দিনের পর দিন দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। কলিমুল্লাহ সাহেব যে ঐ ভিডিওর মাধ্যমে কতবার ড. ইউনূসকে হটিয়ে মার্শাল ল’ আনলেন তা গুণে শুমার করা যাবে না। তিনি নাকি রাত ৪টা পর্যন্ত প্রতিদিন দেশি বিদেশী টেলিভিশন ও ইউটিউব চ্যানেল দেখেন। আর সেগুলো দেখে সুলতানা রহমানের চ্যানেলটিতে যা মনে হয় তাই বলে যান।
সুলতানা রহমান নিউইয়র্ক থাকেন। সেখানে তার ওঠাবসা আওয়ামী লীগের সাথে। এরাই তাকে ফিন্যান্স করে। তাদের অর্থেই তিনি বলতে গেলে প্রতিদিন একটি করে ভিডিও আপলোড করেন। আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয় অথবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অথবা আইএসপিআর এতদিন কী করলেন? শেষ পর্যন্তও তো তারা এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেননি। অবশেষে যখন দুর্নীতির অভিযোগে কলিমুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয় একমাত্র তখনই তিনি থামতে বাধ্য হন। তার আগে তাকে থামানো যায়নি।
কলকাতা থেকে একাধিক চ্যানেলে হররোজ বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এগুলো বলতে গেলে রীতিমতো উন্মাদ প্রচারণা। দ্যা রিপাবলিক টিভি এবং তার সঞ্চালক ময়ূখ চৌধুরী তো বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালাতে গিয়ে এমন নর্তন-কুর্দন করতেন যে তার পুরো শো টাই পচে গেছে । প্রথম প্রথম বাংলাদেশের কিছু মানুষ কৌতুহলবশত সেই বস্তাপচা ভিডিওগুলো দেখতেন। তারপর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিটিআরসিকে আর কিছু করতে হয়নি। মানুষ এ মিথ্যার বেসাতি দেখে ঐ চ্যানেলটি দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন।
কিন্তু কলকাতার ‘দি ওয়াল’ নামক বাংলা পত্রিকা এবং একই নামের টেলিভিশন চ্যানেল সপ্তাহে অন্তত ৫টি করে অনুষ্ঠান করছে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর। আর সে সব বয়ান দিচ্ছেন অমল সরকার নামের ভারি গলার এক ব্যক্তি। বাংলাদেশ সরকার তো বলেছেন যে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ বা কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের বক্তব্য প্রচার করলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু যারা ওয়াল দেখেন তারা তো দেখছেন যে, ঐ পত্রিকাটি এবং চ্যানেলটি আওয়ামী লীগের লিফলেট এবং মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। এরাও যখন তখন সেনাবাহিনীতে উত্তেজনা আবিষ্কার করেন। যখন তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির খবর সৃষ্টি করেন। আওয়ামী লীগের তো বাংলাদেশে কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশনের দরকার নেই । ঐ ওয়াল থাকলেই তো হলো।
আর একটি চ্যানেল আছে । সেটির নাম ‘ক্যালকাটা ডায়ালগ’। পরিচালক জনৈক মনোজ দাস। আমি অনুরোধ করবো, সেনা প্রধান, প্রধান উপদেষ্টার টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তির বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম প্রমুখ যেনো এ মনোজ দাসের দু’একটি অনুষ্ঠান দেখেন। কি ছাইভষ্ম না আছে সেখানে? তাদের অনুষ্ঠান দেখে মনে হবে, শেখ হাসিনাকে ফেরত এনে ক্ষমতায় বসানোর জন্য যে কোনো দিন ভারত আক্রমণ করবে বাংলাদেশ। তাদের রণকৌশল কী হবে তাও ওরা জানিয়ে দিচ্ছে। ওরাই তো বলছে যে, ভারতের দুর্বলতা যেমন ‘চিকেন নেক’, বাংলাদেশের দুর্বলতা তেমন ’ফেনী নেক’। এ ফেনী নেক দখল করতে ভারতের নাকি ১২ ঘন্টা সময়ও লাগবে না। এটি দখল করতে পারলেই ফেনী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের রঙ্গিন ফানুস যে কতো নিঃসীম নীলিমায় উড়ে যায় সেটি ঐ চ্যানেলটি না দেখলে বোঝা যায় না। আমার প্রশ্ন, এসব চ্যানেল এদেশে দেখতে দেওয়া হয় কেনো? যেখানে সরাসরি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এবং ইন্টারিম সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করা হয় এবং যেখানে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের খবর সব সময় প্রচার করা হয় সেটিকে বন্ধ করলে কেউ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করবেন না। বরং আওয়ামী লীগ ছাড়া ১৮ কোটি জনগণ সে ঘটনায় উল্লসিত হবেন।
গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সমাবেশ বা মিছিলে কে বা কারা গুলি চালিয়েছে এবং সে গুলিতে ৫ জন মানুষ মারা গিয়েছেন সেকথা আমরা কেউ জানতাম না। কিন্তু তার পরের দিনই ভারতে বড় বড় পত্রিকা, টেলিভিশন এবং যেসব বিশেষ পত্রিকা ও চ্যানেলের নাম উল্লেখ করলাম সেগুলোতে সেই খবর দেওয়া হলো। তাহলে এখানে গুজব ছড়াচ্ছে কারা?
নবনীতা চৌধুরী আগে বাংলাদেশে ছিলেন। সম্ভবত সবশেষে ডিবিসি টেলিভিশনে ছিলেন। এখন তিনি নবনীতার বয়ান বলে সপ্তাহের অন্তত ৪ দিন আদা-ঘন্টা থেকে ৪০ মিনিটের অনুষ্ঠান প্রচার করেন। পশ্চিমবঙ্গে নর্থ ইস্ট বলে একটি পত্রিকা পাওয়া যায়। আমি জানি না, এ পত্রিকাটি নর্থ ইস্টের ৭ রাজ্যের কোনো রাজ্য থেকে প্রকাশিত হয় কিনা। এখানে চন্দন নন্দী বলে এক ভদ্রলোক প্রায়শই বাংলাদেশের ওপর এক্সক্লুসিভ স্টোরি লেখেন। এগুলো তো কোনো স্টোরি হয় না, এগুলো হয় গার্বেজ বা আবর্জনা। আর আজ যা নর্থ ইস্টে ছাপা হয় বা চন্দন নন্দী বলেন , কাল সেগুলো নবনীতা চৌধুরীর বয়ানে আসে। এধরনের চ্যানেলকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয় কেনো?
অনেক কথাই বলার আছে। সর্বশেষ ঘটনা দিয়ে শেষ করছি। আমি প্রতিদিন ৭টি দৈনিক পত্রিকা নিজ খরচে সাবস্ক্রাইব করি। এছাড়াও পেশাগত কারণে সময় পেলেই ইন্টারনেটে যাই। আমি মোবাইল নেট ব্যবহার করি না। আমি ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ ব্যাবহার করি। গত পরশু দেখলাম, একদল সাংবাদিক আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে প্রশ্ন করছেন। ‘স্পাইস টিভি’ নামের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক মহিলা সাংবাদিক আসিফ নজরুলকে জিজ্ঞেস করছেন যে, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সাথে দেখা করেছেন কেনো? আইন উপদেষ্টা সরাসরি জবাব দেন যে, এধরনের কোনো সাক্ষাৎ বা বৈঠকের খবর সম্পর্কে তিনি অবগত নন। ঐ প্রশ্ন থেকেই আমি প্রথম জানলাম যে ঐ ধরনের একটি গুজব ছড়িয়েছে।
এরপরে জানা গেলো যে, ৩/৪ দিন আগেই নাকি ভারতীয় গণমাধ্যমে এধরনের খবর প্রচারিত হয়েছে। সে সাথে আরো কিছু খবর, যেগুলোতে জড়িয়ে আছে সেনাপ্রধান, প্রেসিডেন্ট, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি প্রমূখের নাম। যেসব গুজব ছড়িয়েছে সেগুলো অত্যন্ত টাচি বা স্পর্শকাতর। আমি বলছি, আপনারা অর্থাৎ ইন্টারিম সরকার, সেনাবাহিনী সকলে মিলে ঐসব গুজববাজ ভারতীয় চ্যানেল গুলো বন্ধ করুন। দেখবেন ৮০ শতাংশ গুজব তাৎক্ষণিক বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের যেসব শীর্ষ কান্ডারীর কথা বললাম , তারাও শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন। তবে এখানে ড. ইউনূসের ঐ রূঢ় সত্য কথাটি বলতে চাই। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের জন্য দেশী বিদেশী গুজব ও নাশকতা চলছে এবং আগামী দিনেও চলবে এবং ভবিষ্যতে তা আরো জোরদার হবে। সুতরাং এখন থেকেই সরকারকে Pre-emptive এ্যাকশন নিতে হবে।
Email: [email protected]