প্রজ্ঞা দাস
একটি সমাজের মানদণ্ড পরিমাপ করার অন্যতম উপায় হলো তার বৃদ্ধদের প্রতি আচরণ। বাংলাদেশের রাস্তায়, হাসপাতালের বারান্দায়, এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারের দেয়ালের আড়ালে অসংখ্য বৃদ্ধ মা-বাবা তাদেরই সন্তানদের দ্বারা উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত ও পরিত্যক্ত হবার যে নির্মম চিত্র প্রতিনিয়ত ঘটছে, তা আমাদের সমষ্টিগত নৈতিক পতনের চূড়ান্ত দলিল। সন্তানের হাতে মা-বাবার অবহেলা শুধু ব্যক্তিক ব্যর্থতা নয়, এটি গোটা সমাজব্যবস্থার ভিত্তিমূলেই প্রবল ফাটল। যে সমাজ একসময় পিতৃ-মাতৃ ভক্তিকে সর্বোচ্চ নৈতিক মূল্য হিসেবে গণ্য করত, সে সমাজই আজ প্রবীণদের বোঝা মনে করছে। যদিও এ পরিবর্তনের পেছনে কাজ করছে একাধিক কারণ । তবে নগরায়নের প্রভাবে একদিকে পারিবারিক বন্ধনের অবক্ষয় ও ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রসার, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বলয়ের অনুপস্থিতি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রবীণদের জন্য কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাব, এ দুইয়ের সম্মিলিত প্রভাবে বাংলাদেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী আজ চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৫% (প্রায় ১.৪ কোটি) মানুষ ষাটোর্ধ্ব। কিন্তু এ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বড় অংশকেই বার্ধক্যে ভুগতে হচ্ছে অসহায়ত্ব, স্বাস্থ্যঝুঁকি, আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং সবচেয়ে দুঃখজনকভাবে সন্তানদের উপেক্ষার করাল ছায়ায়।
বাংলাদেশের পরিবারব্যবস্থা ঐতিহ্যগতভাবে যৌথ পরিবারে গড়ে উঠেছিল। যেখানে দাদা-দাদি, নানা-নানি, পিতা-মাতা, সন্তান সবাই একই ছাদের নিচে থাকতেন। বার্ধক্যে মা-বাবার দায়িত্বগ্রহণ ছিল সন্তানদের স্বাভাবিক কর্তব্য। কিন্তু দ্রুত নগরায়ণ, কর্মব্যস্ততা, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন এ চর্চার পরিসমাপ্তি টেনেছে। বর্তমানে শহুরে পরিবারগুলো একক পরিসরে আবদ্ধ। বৃদ্ধ বাবা-মার জায়গা সেখানে সংকুচিত, তাদের প্রয়োজন সেখানে ‘বোঝা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্তানদের জীবন গতি পেয়েছে, কিন্তু মানবিকতা হারিয়েছে দিকভ্রষ্ট হয়ে।ঢাকার আশেপাশে ও অন্যান্য শহরাঞ্চলে ক্রমাগত গড়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। এর পেছনে একটি অনস্বীকার্য সত্য হলো বাড়তে থাকা পারিবারিক অবহেলা। বহু বৃদ্ধাশ্রম স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়েই আশ্রয় দেন বাবা-মাকে। সন্তানরা জানিয়ে দেন, তাদের জীবনে বাবা-মায়ের জন্য আর জায়গা নেই।বৃদ্ধাশ্রমে অশ্রুসিক্ত নয়নে একেকজন মা-বাবা সন্তানদের স্মৃতিতে ভাসেন। খোঁজ নেয় না, ফোন দেয় না, উৎসব অনুষ্ঠানেও আসে না।
২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি যুগান্তকারী আইন প্রণয়ন করেন। “পিতা-মাতা ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩”, যা ২০১৩ সালে সংসদে পাস হয়। এ আইনে বলা হয়েছে, কোনো সন্তান যদি ইচ্ছাকৃতভাবে তার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ না করেন, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এ আইন যেন ঘুমিয়ে থাকা ফাইলে বন্দী। বহু বাবা-মা সামাজিক লজ্জা, সন্তানদের প্রতি দুর্বলতা বা আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে মামলা করতে চান না। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চুপ থাকেন। কেননা সন্তানদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায় না বৃদ্ধ মা বাবার ভিতরে থাকা মাতৃ কিংবা পিতৃ সত্তা। হয়তো ভেতরে ভেঙে পরেন, অসুস্থ হন, নিঃসঙ্গতায় প্রাণ ত্যাগ করেন তবু আইনের দরজায় যান না। আবার যারা সাহস করে আইনের দ্বারস্থ হন, তারা ভোগেন দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া, মনস্তাত্ত্বিক লজ্জা এবং সামাজিক চাপের ভেতর। বস্তুত এ সমাজে শিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা সবই রয়েছে, কিন্তু চর্চা নেই। এমন চরম সামাজিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন তীব্র আইনি প্রয়োগ এবং সামাজিক পুনর্জাগরণ। জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে, মানুষকে ভাবাতে হবে যে বার্ধক্য কোনো ‘বিষম’ নয়, বরং এটা জীবনের একটি পবিত্র অধ্যায়, যেখানে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সবচেয়ে প্রয়োজন।
পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ববোধ বিষয়ক নৈতিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিশুরা যেন ছোটবেলা থেকেই জানে বৃদ্ধ মা-বাবাকে অবহেলা করা নয়, তাদের সাথে একসাথে থাকা এবং তাদেরকে যথাযথ সম্মান করাই স্মার্টনেস। সমাজে একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কেউ মা-বাবাকে উপেক্ষা করলে লজ্জিত হবেন, প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। ঠিক যেমন অন্যান্য সামাজিক অন্যায়কে আমরা প্রতিদিন তিরস্কার করি, তেমনি এ অবহেলাকেও যেন সমাজ তিরস্কারের চোখে দেখে।নাটক, সিনেমা ও সংবাদমাধ্যমে নিয়মিতভাবে পারিবারিক দায়িত্ব ও মূল্যবোধ তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে । আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেক থানায় ‘বৃদ্ধ নির্যাতন প্রতিরোধ ডেস্ক’ চালু করতে হবে, এবং প্রতিটি অভিযোগ গ্রহণ করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। আদালতকে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ায় সন্তানদের দায়বদ্ধ করতে হবে। বৃদ্ধ ভাতা নয়, স্বাভাবিক সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। সে উদ্দেশ্যে মাসে ৫০০ বা ৭৫০ টাকার ‘বৃদ্ধ ভাতা’ নামক লোকদেখানো উদারতার পরিবর্তে বরং পরিবারে বৃদ্ধদের জন্য বাধ্যতামূলক সম্মান ও ভরণপোষণ কঠোরভাবে আইনি বাধ্যবাধকতার আওতায় আনতে হবে। দরকার হলে সন্তানদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা নির্ভর করবে তাদের মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনের ওপর।বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারভিত্তিক যত্নকে প্রাধান্য দিতে হবে।
সরকার ও এনজিওগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে পরিবারভিত্তিক যত্নব্যবস্থা গড়ে তুলতে। বৃদ্ধাশ্রম যেন বিকল্প নয়, বরং শেষ আশ্রয়স্থল হয়। একটি রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক উন্নয়নও সমানভাবে জরুরী।একটি সভ্যতা তখনই সভ্য যখন বৃদ্ধের হাত ধরে শিশুর হাঁটা শেখানো হয়। আর যে সমাজে বৃদ্ধের হাতে পাত্র থাকে ভিক্ষার, সেখানে সকল উন্নয়নই এক নিষ্ঠুর ঠাট্টা। বাংলাদেশে যে হারে পারিবারিক অবক্ষয় বেড়েছে, তাতে এখন আর নীরব থাকা আত্মঘাতী। সন্তানদের বিবেককে জাগাতে হলে সমাজকে চাবুক হতে হবে। রাষ্ট্রকে হতে হবে রক্ষাকবচ, বিচার ব্যবস্থাকে হতে হবে মানবিক। একজন বৃদ্ধ মা-বাবার কান্না যদি এ রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবতাবাদীদের নরম বালিশে ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে আমাদের এ সভ্যতা শুধুই ফাঁপা বস্তুতে পরিণত হবে।
বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ, সমাজের মানবিক জাগরণ, এবং সবচেয়ে বড়ো কথা মানবতার আত্মার পুনর্জন্ম। আজকের সন্তানদের হাতে যেমন রয়েছে প্রযুক্তির আগুন, তেমনি রয়েছে আগামীর সভ্যতা গড়ার চাবিকাঠি। সেই সভ্যতার মেরুদন্ড হলো আমাদের প্রবীণ সমাজ। যদি মা-বাবার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে না আনা হয় তাহলে উন্নয়ন হবে শুধুই ইট-কাঠের, আত্মা থাকবে অনাথ। যা কোন প্রগতিশীল জাতির জন্য কাম্য নয় এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের পথে অন্তরায়।
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।