বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গত বুধবার দুটি অপতৎপরতার খবর দিয়েছে দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রিকা। দুঃখজনক খবর হলো চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থানার সুলতানপুর সীমান্তে বিএসএফএর গুলীতে এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হয়েছে। আর মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাল্লাথল সীমান্ত দিয়ে আরও ৪৮ জনকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। খবরে বলা হয়েছে, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থানার সুলতানপুর সীমান্তে বিএসএফএর গুলীতে ইব্রাহিম হোসেন বাবু (৩০) নামের এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হয়েছে। নিহত ইব্রাহিম হোসেন বাবু চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থানার ঝাঁঝাডাঙ্গা গ্রামের মাদরাসা পাড়ার নুরুল ইসলামের ছেলে। ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিট থেকে ১টা ১০ মিনিটের মধ্যে। বিজিবি প্রতিবাদ করে পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে। নিহতের পরিবার ও তার পিতা নূরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান- আমার ছেলে মোঃ ইবরাহিম বাবু বেলা সাড়ে ১২টার দিকে গরুর ঘাস কাটার জন্য সীমান্ত সংলগ্ন গালার মাঠে যায়। এ সময় ভারতের নদীয়া জেলার গেদে ক্যা¤েপর বিএসএফ ৭৯ পিলারের কাছে তাকে লক্ষ্য করে গুলী ছুড়লে সে গুলীবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পরে শুনতে পাই আমার ছেলের লাশ বিএসএফ সদস্যরা ওপারে নিয়ে গেছে। সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়- লাশ বর্তমান শক্তিনগর হাসপাতালের মর্গে আছে।

মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়ে আরও ৪৮ জনকে বিএসএফের পুশইন শীর্ষক আরেকটি খবরে বলা হয়েছে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাল্লাথল সীমান্ত দিয়ে আরও ৪৮ জনকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। ৩ জুলাই ভোরে তাদের আটক করা হয়। এ নিয়ে মৌলভীবাজার জেলায় পুশইনের ঘটনায় ৪৫২ জন বিজিবির হাতে আটক হয়েছেন। এর মধ্যে বড়লেখা উপজেলা দিয়ে ৩৪১ জন, জুড়ী উপজেলা দিয়ে ১০ জন, কুলাউড়া উপজেলা দিয়ে ২১ জন, শ্রীমঙ্গল উপজেলা দিয়ে ১৯ জন ও কমলগঞ্জ উপজেলা দিয়ে ৬১ জন। পুশ ইনের নামে বাংলাভাষীদের সীমান্তে ঠেলে দেয়ার ঘটনা অনেক দিন ধরেই চলছে।

আমরা সীমান্তে এ হত্যার ঘটনায় উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই, প্রতিবাদ জানাই পুশ ইনের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার। আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যার সে পুরনো ধারা ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিএসএফ অব্যাহত রেখেছে। বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী সরকার ভারতের সাথে সদ্ভাব রেখে চলার পরও সীমান্তে প্রতিনিয়তই বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ঘটেছে ফেলানী হত্যার মতো নিন্দনীয় ও অত্যন্ত গর্হিত ঘটনাও। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তের খিতাবেরকুঠি এলাকায় ০৭ জানুয়ারি ২০১১ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর সদস্যরা ফেলানী খাতুন নামের এক কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করে। ফেলানীর লাশ পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে ছিল। এ ঘটনা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

বিগত সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এবং ‘বর্ডার ভায়োলেন্স’ নিয়ে শক্ত অবস্থান না থাকায় সীমান্ত নিয়ে পৃথক আইন থাকার পরও বাংলাদেশিদের হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় রূপ নিয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট ২০২৪ এ উক্ত স্বৈরাচারী সরকার বিদায় নেয়ার পরও বিএসএফের নিন্দনীয় এই সীমান্ত হত্যা থামেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কিছু কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিলেও হত্যা এখনো বন্ধ হয়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে বিএসএফ-বিজিবি ডিজি পর্যায়ে আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হত্যা বন্ধের অনুরোধে ভারত সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কার্যকর হয়নি। চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে বাবু হত্যার ঘটনা তার প্রমাণ। বৈঠকের পরের দুমাসে নিহত হয় ৮ জন।

সীমান্তে গত ২৫ বছরে দেড় হাজারেও বেশি বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জানুয়ারি ২০০৯ থেকে নভেম্বর২০২৪ পর্যন্ত ৫৮৮ জন বিএসএফের হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০২৪ সালে ৫৭টি ঘটনায় বিএসএফের হাতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত ও ২৫ জন আহত হয়েছেন। চলতি সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সীমান্তে ১২ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা ও কর্মকর্তারা হত্যা বন্ধের আহ্বান জানালেও দেখা যাচ্ছে সীমান্ত হত্যা চলছেই। আমরা মনে করি বিষয়টির উপর আরো জোর দেয়া উচিত। সীমান্তে হত্যা ও পুশ ইন বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে আরো জোরালো পদক্ষেপ নেয়া দরকার।