মনসুর আহমদ

Science is the human study in the laws of Allah. বিজ্ঞান আল্লাহ প্রদত্ত নিয়মাবলী নিয়ে গবেষণা করে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে মহাবিশ্বের অনেক তত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। সে সব তত্ত্বের অন্যতম মহাবিশ্ব সদা সম্প্রসারিত হয়ে চলছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আকাশমণ্ডল, আমরা তাদের শক্তি দিয়ে তৈরি করেছি এবং অবশ্যই আমরা এটিকে প্রসারিত করছি। ’ (সূরা আজ -জারিয়াত-৪৭) এ আয়াতের উত্তম ব্যাখ্যা এসেছে আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায়। এ বিষয়টির উপরে সামান্য আলোচনা করা যাক।

এখন পর্যন্ত জানা তত্ত্বের মধ্যে বিগব্যাং তত্ত্ব মহাবিশ্বের শুরু নিয়ে আলোচনা করে। মহাবিশ্বের শুরু মানবজাতির জন্য চরমতম রহস্য ঘেরা একটি বিষয়, যা পুরাণ-বিজ্ঞান (Mythology), দর্শন ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাকে তৎপর করেছে। সৃষ্টিজগতের আদিম অব্যবস্থা সম্পর্কে মহাজাগতিক পৌরাণিকী কথা বর্ণনা করা থেকে আরম্ভ করে জটিল অংক ও কোয়ান্টাম ফিজিক্সের হিসাব নিকাশের মাধ্যমে সমসাময়িক মহাজাগতিক চিন্তা, কীভাবে বিশ্ব অস্তিত্বে এসেছে, সময়ের ব্যাপ্তিতে জন্ম নিয়েছে। এই বিবর্তন আমাদের আস্তিত্ব ও আমাদেরকে ঘিরে রাখা মহাজগৎ রহস্য উন্মোচনে আমাদের কৌতুহল, কল্পনা ও সংকল্প ব্যাখ্যা করে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা যতই মহাজাগতিক গতিবিদ্যার গভীরে প্রবেশ করি, আমরা এর বিশালতা, জটিলতা এবং দীপ্তিতে বিনীত হই, যা সর্বদা বিস্তৃতি ঘটমান মহাজগতের রহস্য ব্যাখ্যা করে। সমস্ত মহাজাগতিক মতবাদ হোক তা বিগব্যাং, মহাজাগতিক স্ফীতি অথবা প্রকৃতভাবে অবস্থিত বহুজগতের ধারণা আমাদেরকে মহাজগতের সৃষ্টি ও বিবর্তনের মুগ্ধকর পরিপ্রেক্ষিত পরিবেশন করে। যা কৌতুহল, বিস্ময়ের উদ্রেক করে এবং তা ব্যতিত মহাজগতের সাথে একটি গভীর সম্পৃক্ততার এবং ভূপৃষ্ঠে একের সাথে অপরের আত্মীয়তার অনুভূতি জন্ম দেয়। তাই আমাদের উচিত মহাবিশ্বকে জানার কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং লক্ষ করা সত্য আমাদেরকে কোথায় উপনীত করে।

মহাবিশ্বের রহস্য আলোচনা শেষ হওয়ার নয়। মহাবিশ্বের মহারহস্যের সীমাহীন সমুদ্রের ক্ষুদ্রতম বালুকণাসমও নয় এ আলোচনা। তারপরেও একটু ভাবতে ক্ষতি কী? পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব কিছু বস্তু নিয়ে গঠিত। গোটা মহাবিশ্বের সামান্যতম গোলাকার একটু এলাকা মাত্র যা পৃথিবী থেকে দেখা যায়। সৃষ্টিতত্বের সম্প্রসারণ শুরু করে এ সব বস্তু থেকে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন সৌরজগত ও পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে। মহাবিশ্বকে আইসোট্রপিক (সকল দিকে অভিন্ন) ভেবে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের শেষ সীমানার দূরত্ব মোটামুটি সব দিকে সমান মনে করা হয়। অন্য কথায় বলা চলে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব দ্রষ্টার কাছে একটি গোলাকার স্থান। মহাবিশ্বের প্রত্যেক স্থানের রয়েছে তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব, হতে পারে বা না ও হতে পারে যে, তারা একটি অপরটিকে (Overlap) ঘিরে আছে।

আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যা কোন বস্তু থেকে আলো বা তথ্য প্রাপ্তির কারণে তাকে দৃশ্যমান বলে না। দৃশ্যমান বলতে আলোর গতি দ্বারা সৃষ্ট শারীরিক সীমাকে বুঝায়। কোন সংকেত আলোর গতি অতিক্রম করতে পারে না, তাই সর্বাধিক দূরত্ব যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় পার্টিকেল হোরাইজন (particle horizon) বলা হয়ে থাকে তার বেশি দূরত্বের কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব নয়, কারণ সে দূরত্ব হতে কোন সংকেত পর্যবেক্ষণকারী পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। কোন কোন সময় নক্ষত্র পদার্থতত্ত্ববিদগণ পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব ও আপতদৃশ্য মহাবিশ্বের মধ্যে পার্থক্য করে থাকেন। পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব স্ফীতি যুগ শেষের সংকেত ধারণ করে এবং আপতদৃশ্য মহাবিশ্ব শুধু মাত্র পুনঃসংযোগ পরবর্তী সংকেত ধারণ করে। এ হিসাব অনুযায়ী যে সমস্ত অণু থেকে cosmic microwave background Radiation (CMBR) নির্গত হয়ে ছিল, যা দিয়ে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ পরিমাপ করা হয়,তার পরিমাণ বর্তমান comoving distance (একই দিকে একই গতিতে চলা) প্রায় ৪৫.৭ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের প্রান্ত সীমানার comoving distance ৪৭.৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। অতএব পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ ৪৬.৫ আলোকবর্ষ। মহাবিশ্বের বস্তুর ঘনত্ব এবং ব্যসার্ধের পরিমাণ ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের সাধারণ বস্তুর ভরের পরিমান হিসাব করা হয়েছে যা ১.৫x১০৫৩ কেজি।

যেহেতু মহাবিশ্বের প্রসারণমানতা বেড়েই চলছে তাই পর্যবেক্ষণযোগ্য স্থানীয় গ্যালাক্সি দলের (supercluster) বাইরে অবস্থিত বস্তুসমূহ এক সময় রক্তিম ও অনুজ্জ্বল আলো বিলাতে বিলাতে পরিণামে বিলীন হয়ে যাবে। উদাহরণ স্বরূপ বর্তমানে ৫-১০ রেডশিফট (আলোকে বর্ণালীর লাল অংশের দিকে স্থানান্তর) (redshift) বস্তু ৫-১০ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত দেখা যাবে। অধিকন্তু একটি নির্দিষ্ট (comoving distance) কম্বিং দূরত্বের (প্রায় ১৯ গিগাপারসেক) বাইরের বস্তু থেকে নির্গত আলো কখনই পৃথিবীতে পৌঁছবে না।

সম্প্রসরণশীল মহাবিশ্ব প্রসঙ্গে বলা যায়, এটি স্থান-কালের বৃত্তি মাত্র। মহাবিশ্বের আকার অজানা, হতে পারে তা অনন্ত। মহাবিশ্বের বেশি অংশ এত দূরে অবস্থিত যে, বিগব্যাং সময় থেকে শুরু করে আসা আলো জগতে পৌঁছার প্রক্রিয়া এতকাল পরেও চলমান, আর তাই তা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের বাইরে থেকে গেল। ভবিষ্যতে দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আলো এসে পৌঁছাতে বিশাল সীমার সময় অতিবাহিত হবে। তাই আশা করা যায়, ভবিষ্যতে মহাবিশ্বের আরও অধিক কিছু দৃশ্যমান হবে। দ্রষ্টার থেকে দূরে থাকা অঞ্চল আলোর গতির চেয়ে অধিক (হাবল’স ল দ্বারা অনুমিত) দ্রুত গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে।এই বিস্তৃতির গতি মনে করা হচ্ছে বেড়েই চলছে, যা ব্যাখ্যার জন্য ‘ডার্ক অ্যানার্জি’র প্রস্তাবনা এসেছে।

ধরে নেওয়া হয় যে,‘ডার্ক আ্যনাজির্’ অপরিবর্তনীয় (অপরিবর্তনীয় কসমোলজিক্যাল কনস ্টান্ট) এ জন্য যে, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতার হার বেড়েই চলেছে, রয়েছে একটি ‘ভবিষ্যৎ দৃশ্যমানতার সীমা’ যার বাইরের কান বস্তু পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব সীমায় কখনই প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না, কারণ এ সীমার বাইরের কোন বস্তুর আলো বিকীরণ কখনই পৃথিবীতে পৌঁছতে সক্ষম হবে না। লক্ষ করুন, কারণ হাবল প্যারামিটার সময়ের সাথে হ্রাস পাচ্ছে,হতে পারে যে,একটি গ্যালাক্সি যা আলোর গতির চেয়ে সামান্য বেশি গতিতে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তা সংকেত পাঠাচ্ছে আর তা পৃথিবীতে পৌঁছছে। ভবিষ্যতের এই প্রতীয়মান সীমা comoving distance ১৯ বিলিয়ন পারসেকস (৬২ বিলিয়ন আলেকবর্ষ। যদি ধরে নেওয়া হয় যে,মহাবিশ্বের বিস্তৃতি ঘটতেই থাকবে তা হলে তা ইঙ্গিত প্রদান করে যে, এখন পর্যন্ত যত পরিমাণে গ্যালাক্সি দৃশ্যমান হয়েছে তার চেয়ে অসীম ভবিষ্যতে ২ .৬ গুণ বেশি পরিমাণ গ্যালাক্সি দেখা যাবে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ভবিষ্যতে অনেক গ্যালক্সি পর্যবেক্ষণে আসবে। বাস্তবে গ্যালাক্সি ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে অনেক গ্যালাক্সি বিশ্বসম্প্রসারণের কারণে চরম ভাবে redshifted হয়ে পড়বে, তা এতটা বেশি হবে যে, সে সবকিছু দৃশ্যপট থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একটি নির্দিষ্ট comoving distance এ অবস্থিত গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে অবস্থান করছে বলা যাবে যদি ইতিহাসের যে কোন সময় গ্যালাক্সি থেকে পাঠান সংকেত আমরা গ্রহণ করতে পারি। ধরা যাক একটি গ্যালাক্সি থেকে বিগব্যাং -এর ৫০০ বিলিয়ন বছর পরে একটি সংকেত পাঠান হলো। যেহেতু বিশ্ব প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে তাই এমন একটি সময় আসতে পারে যে, সে সময় একই গ্যালাক্সি থেকে পাঠান সংকেত ভবিষ্যতের কোন সময়ই পৃথিবীতে পৌঁছবে না।উদাহরণ স্বরূপ বিগব্যাং-এর ১০ বিলিয়ন বছর পরে গ্যালাক্সি দেখতে কেমন হবে তা দেখা সম্ভব হবে না; যদিও তখন এটি একই comoving distance এ যদিও তা পর্যবেক্ষণযোগ্য বিশ্বের দূরত্বের চেয়ে কম দূরত্বে অবস্থান করবে। এ সব এক প্রকার cosmic event horizon পৃথিবীর থেকে যার দূরত্ব সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় তার সীমা নিরূপণ করে। যেমন horizon-এর বর্তমান দূরত্ব প্রায় ১৬ মিলিয়ন আলোক বর্ষ। একক্ষণে ইভেন্ট ঘটনা চূড়ান্ত ভাবে পৃথিবীর সন্নিকটে আসবে যদি ইভেন্ট দূরত্ব ১৬ বিলিয়ন আলোক বর্ষের কম হয়। কিন্তু যদি ইভেন্ট আরো দূরে হয় তা হলে সংকেত কখন পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছবে না।

Cosmic event horizon সম্মুখস্থ স্থানকে ‘পৌঁছান সম্ভব স্থান’ reachable universe বলা যেতে পারে, অর্থাৎ এর চেয়ে কম দূরত্বের গ্যালাক্সি পর্যন্ত পৌছানো যেতে পারে যদি আজই আমরা তার দিকে আলোর গতিতে যাত্রা করি; এই নাগালের বাইরের গ্যালাক্সিতে পৌঁছান সম্ভব নয়। সহজ পর্যবেক্ষণ দেখাবে যে ভবিষ্যৎ দৃষ্টিগোচরতার সীমা (৬২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ) নাগালপ্রাপ্তি সীমার (১৬বিলিয়ন আলোকবর্ষ) সমান যার সাথে বর্তমান দৃষ্টিগোচরতার সীমা (৪৬বিলিয়ন আলোকবর্ষ)যোগ করা হয়েছে।

মহাবিশ্বের এ বিশালতা জেনে আমরা বিস্ময়াবিভূত হয়ে যেতে পারি, কিন্তু যখন পবিত্র কুরআনে দেখি ‘সে দিন আকাশমণ্ডলকে গুটিয়ে ফেলব, যেভাবে গুটান হয় লিখিত দপ্তর;’ (সূরা আল-আম্বিয়া-১০৪) তখন তার চেয়ে মহাবিস্ময়কর এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে ভেবে অধিক বিস্ময়াবিভূত হয়ে পড়ি।