জালাল উদ্দিন ওমর

সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মধ্যে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ‘কৌশলগত পার¯পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ (Strategic Mutual Defence Agreement, SMDA) স্বাক্ষরিত হয়। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ রিয়াদের আল-ইয়ামামাহ প্রাসাদে নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিটির খবর প্রকাশের পরপরই তা বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং এটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও বিচার ব্যাখ্যা চলছে। চুক্তিটি মধ্যপ্রাচ্য সহ মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চুক্তিটির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং এর সম্প্রসারণ দেশ দুটি সহ মুসলিম দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটাবে। চুক্তিটি বিশ্বরাজনীতিতে নয়া মোড় এবং নতুন সম্ভাবনার হাতছানি সৃষ্টি করেছে।

চুক্তিতে যা বলা হয়েছে : এটি একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি। চুক্তিটি স¤পর্কে দেশ দুটির যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে-দু’দেশের অভিন্ন কৌশলগত স্বার্থরক্ষা এবং ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারের মাধ্যমে দুই সামরিক বাহিনীর স¤পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হবে। চুক্তিটিতে এক দেশের ওপর হামলাকে উভয় দেশের ওপর হামলা হিসাবে গণ্য করার এবং যৌথভাবে তা মোকাবিলা কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে- এটি একটি ব্যাপকভিত্তিক প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং সব ধরনের সামরিক সহযোগিতা এর অন্তর্ভুক্ত। আরো বলা হয়েছে-নির্দিষ্ট কোন দেশকে উদ্দেশ্য করে নয় বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্যই এটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি কোন আগ্রাসী চুক্তি নয় বরং প্রতিরক্ষা চুক্তি। চুক্তিটির মেয়াদকাল , যৌথ মহড়ার অবকাঠামো, অস্ত্র বিনিময় এবং গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় নিয়ে কোন তথ্য প্রকাশ না করলে ও এটি একটি ব্যাপকভিত্তিক প্রতিরক্ষা চুক্তি হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।

সৌদি-পাকিস্তান সহযোগিতার ইতিহাস : সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিদ্যমান। দেশ দুটি বন্ধুপ্রতিম মুসলিম দেশ। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটে সৌদি আরব বরাবরই আর্থিক সহযোগিতা করে আসছে। বিভিন্ন সময়ে সৃষ্ট পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সৌদি আরব মধ্যস্থতা এবং সংকটের সমাধান করেছে। পাশাপাশি দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকেই সামরিক ক্ষেত্রেও সহযোগিতা বিদ্যমান। দেশ দুটির মধ্যে ১৯৬৭ সালে প্রথম প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন থেকেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিয়মিতভাবে সৌদি আরবের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। দেশ দুটি বিভিন্ন সময়ে একাধিক যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করেছে এবং সৌদি সামরিক বাহিনীর সামগ্রিক অবকাঠামোগত উন্নয়নে পাকিস্তানিরা নিয়মিতভাবে কাজ করে আসছে। তবে দেশ দুটির মধ্যে চলমান এ সামরিক সহযোগিতা পূর্ণাঙ্গ এবং ব্যাপকভিত্তিক ছিল না। এখন দেশ দুটি ব্যাপকভিত্তিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে, যা তাদের মধ্য চলমান সামরিক সহযোগিতার বহুমাত্রিক রূপ।

দেশ দুটির সামগ্রিক কল্যাণে চুক্তিটির ভূমিকা : সৌদি আরব এবং পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ, শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী দেশ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মস্থান, পবিত্র কাবা এবং মসজিদে নববী সৌদি আরবেই অবস্থিত। স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের আলাদা একটা ভাবমুর্তি এবং প্রভাব বিদ্যমান। প্রতি বছর সারা বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান হজ্জ এবং ওমরা পালনে সৌদি আরব সফর করেন। তাছাড়া দেশটি খনিজ তেল এবং গ্যাস সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক স¤পদে সমৃদ্ধ। ফলে সৌদি আরব অত্যন্ত ধনী দেশ এবং তার অর্থনীতি অত্যন্ত শক্তিশালী। অপরদিকে আর্থিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল হলেও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে পাকিস্তান অনেক উন্নত। দেশটি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী এবং নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। নিজেরাই ড্রোন, ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, যুদ্ধ জাহাজ, বিভিন্ন ধরনের বন্দুক এবং গোলাবারুদ তৈরি করছে। দেশটির রয়েছে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। স্বাভাবিকভাবেই সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের নিজস্ব একটা অবস্থান আছে। পাকিস্তানের প্রযুক্তি এবং সৌদি আরবের অর্থ একসাথে মিলে কাজ করলে দুটি দেশই সামগ্রিকভাবে উপকৃত হবে এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।

বৃহত্তর সামরিক জোট গঠিত হতে পারে : সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা চুক্তিটি একটি বৃহত্তর মুসলিম সামরিক জোট গঠনে সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে। অন্যান্য মুসলিম দেশসমূহ ও এই জোটে যোগ দিতে পারে।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, চুক্তিটিতে অন্যান্য দেশ এবং আরব দেশগুলোর যোগদানের সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে ৫৭ টি মুসলিম দেশ ওআইসির সদস্য , তম্মধ্যে ৪৮ টিতে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সব না হলেও এর অর্ধেক সদস্যও যদি এই প্রতিরক্ষা চুক্তিতে যোগ দেয় তাহলে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত সামরিক জোটে পরিনত হবে। ইরান, ইরাক, তুরস্ক, কুয়েত, কাতার, আরব আমিরাত, ওমান, মিশর, সিরিয়া, জর্দান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্থান, তাজাকিস্তান সহ প্রায় সকল মুসলিম দেশই এর সদস্য হতে পারে। দেশগুলোর মধ্যে ইরান, তুরস্ক সামরিক প্রযুক্তিতে অনেক উন্নত। অন্যদিকে কুয়েত, কাতার এবং আরব আমিরাত অনেক ধনী রাষ্ট্র। সবাই যদি একজোট হয় তাহলে বৃহত্তর সামরিক জোট গঠিত হতে পারে , যা দেশসমুহের সামগ্রিক নিরাপত্তা এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনকে নিশ্চিত করবে।

নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হয় : কেউ আপনাকে নিরাপত্তা দিবে না, নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরকেই নিশ্চিত করতে হয়। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ায় পশ্চিমাদের আগ্রাসন, ইরান-কাতারে ইসরাইলী হামলা এবং ফিলিস্তিন, লেবাননে ইসরাইলী হত্যাযজ্ঞ তার জলন্ত উদাহরণ। পশ্চিমা দেশসমূহ তাদের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিত করার জন্য ১৯৪৯ সালে ন্যাটো প্রতিষ্ঠা করে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বর্তমানে ৩২টি দেশ এর সদস্য। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক ৮টি দেশ তাদের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিতে ১৯৫৫ সালে ওয়ারশ জোট প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা সমাজতন্ত্রের পতন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ায় ১৯৯১ সালে বিলুপ্ত হয়। সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, পোলান্ড, রুমানিয়া এক সময় ওয়ারশ জোটের সদস্য হলেও, সমাজতন্ত্র পরবর্তী সময়ে তারা এখন ন্যাটোর সদস্য। অপরদিকে ওয়ারশ জোটের সদস্য পূর্ব জার্মানী পরবর্তীতে পশ্চিম জার্মানীর সাথে একীভুত হওয়ায় সেও এখন ন্যাটোর সদস্য। সুতরাং বতর্মান বিশ্বে ন্যাটোই একমাত্র সামরিক জোট এবং এটি তার সদস্য দেশসমুহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এখন মুসলিম দেশ সমুহের সম্মিলিত সামরিক জোট প্রয়োজন যা মুসলিম দেশসমুহের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে। সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে পারে তার প্রাথমিক পদক্ষেপ।

বিশ্ব রাজনীতিতে নয়া মোড় : সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি বিশ্ব রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। মুসলিম দেশসমূহ এ চুক্তিতে যোগ দিয়ে একটি সামরিক জোট গঠন করলে, পশ্চিমারা আর মুসলিম দেশসমুহের ওপর খবরদারি এবং আক্রমণ করতে পারবে না। তখন মুসলিম দেশসমুহ নিজেরাই একটি শক্তি হিসাবে আবির্ভুত হবে এবং বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত হবে। ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হবে এবং একক বিশ্ব ব্যবস্থার অবসান ঘটাবে। বর্তমানে মুসলিম দেশের সংখ্যা ৫৭টি, মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২০০ কোটি এবং মুসলিম দেশসমুহের টোটাল জিডিপি প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার। তাছাড়া দেশসমুহ ব্যাপক পরিমাণে প্রাকৃতিক স¤পদ এবং বিশাল ভুখন্ডের অধিকারী। এ অবস্থায় মুসলিম দেশসমুহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি প্রতিরক্ষা জোট গঠন করলে, তা দেশসমুহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিরাট ভুমিকা রাখবে। প্রতিরক্ষা এবং সামরিক প্রযুক্তি ক্ষেত্রে স্বয়ংস্ব¤পূর্ণতা ও অর্জন করতে পারে। তার জন্য মুসলিম দেশসমুহকে পার¯পরিক সম্মান জানাতে হবে, একে অপরের বিরুদ্ধে আক্রমন বন্ধ করতে হবে, এক দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণকে পুরো মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে আক্রমন হিসাবে গণ্য করতে করতে হবে এবং সম্মিলিত বাহিনী দিয়ে তা প্রতিহত করতে হবে। নিজেদের মধ্যকার সমস্যাসমূহ আলাপ আলোচনা এবং সমঝোতার মাধ্যমে নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। মুসলিম দেশসমূহের সামনের দিকে এগিয়ে যাবার যে বিশাল সুযোগ এবং সম্ভাবনা রয়েছে , সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি সে পথে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে।

লেখক : প্রকৌশলী ও প্রাবন্ধিক