আসিফ আরসালান

আমি এ কলামটি লিখছি বৃহস্পতিবার রাত ৮টায়। আমার লেখা শুক্রবার বিকেল ৫টার মধ্যে জমা দিতে হয় বলে রাতেই লেখা শেষ করে রাখি। আজ ইচ্ছে ছিলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) এবং হলসমূহের নির্বাচনী ফলাফল এ লেখার শেষ অংশজুড়ে দেবো। লেখার মূল উপজীব্য হলো ডাকসু নির্বাচন। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে জাকসুর ভোটের গণনা সবে মাত্র শুরু হয়েছে। তাই এ মুহূর্তে ডাকসু দিয়েই শুরু করি। বলা হয়েছে যে, শুক্রবার দুপুরের আগে গণনা শেষ হবে না। তাই শুক্রবার দুপুরের আগে ফলাফল জানাও সম্ভব হবে না।

ডাকসুর নির্বাচনে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী ফলাফলে বাম এবং সেক্যুলার এমনকি মধ্যপন্থি ঘরানাও চরম বিস্মিত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে ৪৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। তার আগে অবিভক্ত পাকিস্তানে ইসলামী ছাত্রসংঘ নামে একটি ছাত্র সংগঠন কাজ শুরু করে। সাবেক পূর্ব বাংলায় এ সংগঠনটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আলী। তাকে সহযোগিতা করেন মওলানা আব্দুস সোবাহান এবং ব্যারিস্টার কোরবান আলী। মওলানা আব্দুস সোবাহানকে শেখ হাসিনার স্বৈরাচার মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে তিনি অসুস্থ হন এবং কারাবন্দী থাকা অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিব সংবিধানে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। মুজিব সরকারের পতনের পর ১৯৭৭ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে ইসলামী রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে ইসলামী ছাত্রশিবির গঠন করা হয়।

গতবছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৩ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রশিবিরকে অফিসিয়ালি কোনো সরকার নিষিদ্ধ করেনি। ৩ আগস্ট শেখ হাসিনা এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ সত্ত্বেও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিববাদী ছাত্রলীগ এবং মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন গায়ের জোরে শিবিরের কর্মতৎপরতা নিষিদ্ধ করে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের এ গায়ের জোর খাটানোর কোনো প্রতিবাদ ছাত্রদল করেনি। ফলে সকলের ধারণা হয়েছিলো, ‘মৌনতা সম্মতির লক্ষণ’। বস্তুত ৫ আগস্ট ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত গণবিপ্লবে শেখ হাসিনা তার দলবল সহ ভারতে বিতাড়িত হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর থেকে সরকারী নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তারপর থেকেই ইসলামী ছাত্রশিবির প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করে।

তাই বলে বিগত ৪৮ বছর ছাত্রশিবির হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। যেহেতু সরকারের প্রশ্রয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরব সমর্থনে ছাত্রশিবিরকে প্রকাশ্যে কাজ করতে দেওয়া হয়নি তাই তাদেরকে পরিচয় গোপন রেখেই কাজ করতে হয়। যারা রাজনীতির অন্দরমহলের খবর রাখেন তারা বিলক্ষণ জানতেন যে, পরিচয় গোপন রেখে অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেও শিবির যে কর্মতৎপরতা চালায়েছে তার ফলে দিনের পর দিন এ সংগঠনটির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটতে থাকে।

শেখ হাসিনা প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে জামায়াতের শীর্ষ ৫ নেতাকে জুডিশিয়াল কিলিং অর্থাৎ সাজানো রায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। এ ৫ জন নেতা হলেন, মওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, আব্দুল কাদের মোল্লা এবং কামারুজ্জামান। বাংলাদেশে জামায়াতের শীর্ষ নেতা এবং সকলের মধ্যমণি অধ্যাপক গোলাম আজম এবং মওলানা আব্দুস সোবাহান এবং এ উপমহাদেশের বরেণ্য আলেম মওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী কারারুদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে/কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।

শেখ হাসিনার এ বিচারিক হত্যাকান্ড জামায়াত এবং শিবিরকে দুর্বল করার পরিবর্তে আআরও বহুগুণ শক্তিশালী করে। একদিকে যেমন লক্ষ কোটি জনগণের সহানুভূতি বর্ষিত হয় জামায়াত শিবিরের ওপর, অন্য দিকে বিপুল সংখ্যক নতুন কর্মী দলে যোগদান করেন। আজ আর এ কথা গোপন নয়, পরিচয় গোপন রেখে কাজ করতে করতে শিবির এত শক্তিশালী হয় যে, জুলাই অভ্যুত্থানে সাদিক কায়েম সহ শিবিরের অনেক নেতাকর্মী বিপ্লবের হাল ধরেন এবং এ বিপ্লব করতে গিয়ে তাদের অনেকে শহীদও হয়েছেন। সেকারণেই নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বে¡ও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনার পলায়নের পর রাজনীতিবিদদের যে বৈঠক ডাকেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার সেখানে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সর্ব প্রথম তিনি উচ্চারণ করেন আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের নাম।

বিগত ৪৮ বছর ধরে জামায়াত এবং শিবির আল্লাহর পথে থেকে জালিমদের যে অবর্ণনীয় এবং অমানবিক জুলুমের শিকার হয়েছেন তার প্রতিদান সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাদের দিয়েছেন। তাই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে বলছি, ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী এবং ভূমিধস বিজয়ে কুচক্রী, ষড়যন্ত্রী এবং কায়েমী স্বার্থবাদীরা, ‘অবাক তাকিয়ে রয়’। সারা পৃথিবীকে তাজ্জব করে দিয়ে কেনো এবং কীভাবে এ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন সম্ভব হলো সেটি নিয়ে দেশের সবকটি এবং সব ধরনের গণমাধ্যমে তুমুল জল্পনা-কল্পনা চলছে। একটি অবাক ব্যাপার হলো এ যে, এসব লেখালেখি, টকশো এবং কলাম লেখার মধ্যে শিবির সম্পর্কে নেতিবাচক লেখা খুব কমই রয়েছে। নির্বাচনোত্তর পর্যালোচনা অত্যন্ত সংক্ষেপে নিচে বর্ণনা করছি।

প্রথমত, জুলাই বিপ্লবে শিবিরের ভূমিকা। ৪৭ বছর ধরে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করে শিবির যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সে অভিজ্ঞতাকে তারা বিপ্লবের সফলতা অর্জনে বিপুলভাবে কাজে লাগিয়েছে। বিপ্লব সফল হওয়ার পর পরই নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁঈয়ার পাশাপাশি আর একটি নাম তাৎক্ষণিকভাবে যুগপৎ উচ্চারিত হয়েছে। সে নামটি হলো সাদিক কায়েম। দ্বিতীয়ত, শিবিরের প্যানেল তৈরি করার সময় তারা নজর রেখেছিলেন যে, প্যানেলটি যেনো অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়। অন্য কথায়, নারী, পাহাড়ী, হিজাবী, নন হিজাবী প্রমূখ সর্বশ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদেরকে এ প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জামায়াত ও শিবির নারী বিআরওধী- এই অপপ্রচার রাম এবং বামেরা ৪৭ বছর ধরে চালিয়ে এসেছে। কিন্তু এবার শিবিরের প্যানেল দেখে তাদের অপপ্রচারের বেলুন ফেটে গেছে। তৃতীয়ত, ইসলামী আন্দোলন এবং ইসলামী ছাত্রসংগঠনে শুধুমাত্র মৌলভী মওলানারাই আছেন। তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন, এমন আজগুবি প্রচারও এবার নস্যাৎ হয়েছে। সাদিক কায়েম রা’্রবিজ্ঞান বিভাগে শীর্ষ স্থান অধিকারীদের একজন। শিবিরের প্যানেল থেকে জিএস নির্বাচিত এস এম ফরহাদ অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছেন। প্রথম আলোর রিপোর্ট মোতাবেক এজিএস মহিউদ্দিন খান অনার্স ও মাস্টার্সের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা নাকি সহশিক্ষার বিরুদ্ধে। কিন্তু এবার নারী শিক্ষার্থীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন করার ফলে শিবিরের বিরুদ্ধে ঐ অপপ্রচার ভোঁতা হয়ে গেছে।

অনেক শিক্ষার্থীকে শিবির ট্যাগ দিয়ে অমানুষিক এবং নিষ্ঠুর জুলুম চালানো হয়েছে। এ ভয়াবহ নির্যাতনে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে হত্যাও করা হয়েছে। আবরারকে হত্যা করার কারণ, তিনি ফেসবুকে ভারতবিরোধী একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। আবরার হত্যাকাণ্ডসহ শিবিরের অসংখ্য কর্মীর প্রতি জুলুমের স্টিম রুলার ছাত্র ছাত্রী এবং অভিভাবক নির্বিশেষে সকলের সহানুভূতি অর্জন করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। শেখ হাসিনার ১৫ বছরে জামায়ত এবং শিবিরের প্রতি হাসিনার ভয়ঙ্কর জুলুম তাকে এক প্রতিহিংসাপরায়ণ নারী এবং তার কঠোর সমালোচকদের ভাষায় ডাইনি রূপে প্রতিভাত করেছে। পক্ষান্তরে শেখ হাসিনার এ চণ্ডালিনী রূপ শিবিরের প্রতি আপামর জনগণকে সহানুভূতিশীল করেছে।

শিবিরের এ ভূমিধস বিজয়ের অন্যতম কারণ হলো, ৫ আগস্টের পর বিগত ১৩ মাসে শিবিরের বিরুদ্ধে জুলুম নির্যাতন দখলদারি ইত্যাদি কোনো রকম ইলজাম বা অপবাদ শোনা যায়নি। শেখ হাসিনার পতনের পর স্বভাবতই রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষে উঠে আসে বিএনপি। কারণ হাসিনার শাসনামলে একদিকে ছিলো সরকারি দল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিআরওধী দল ছিলো বিএনপি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিএনপি এবং জামায়াত একসাথে নির্বাচন করলেও শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনীতিটা আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি না হয়ে বিএনপি বনাম জামায়াত রূপ পরিগ্রহ করে। বিএনপি আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বৃহত্তম দল- এমনটা ছিলো পাবলিক পারসেপশন। কিন্তু বিএনপি এ নবলব্ধ সন্মান ধরে রাখতে পারেনি। ঢাকা মহানগরী সহ সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ ওঠে। লঞ্চ টার্মিনাল দখল, বাস টার্মিনাল দখল, জলমহাল দখল থেকে শুরু করে হেন চাঁদাবাজি নাই যার সাথে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নাম জড়িত হয়নি।

সাধারণ মানুষকেও বলতে শোনা যায় যে, এ বিপ্লব করে কী লাভ হলো? শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল এলো। ওরা ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই ডিসি, এসপি, ওসি প্রমুখ সরকারী অফিসারদের হুকুম করা শুরু করে। উদাহরণ স্বরূপ, রংপুর থেকে ঢাকায় একটি মালবাহী ট্রাককে অন্তত ৫টি জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। আগে এই চাঁদা নিতো আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। এখন সে চাঁদা নিচ্ছে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলকে। কিন্তু এ সব অপকর্মের কোনোটির সাথে জামায়াত ও শিবিরের নাম কোথাও জড়িত হয়নি। জুলাই বিপ্লবের পর প্রধানত এই জামায়াত শিবির এবং মাদরাসার ছাত্ররা হিন্দুদের বাড়ি ঘর এবং মন্দির পাহারা দিয়েছেন। জামায়াত শিবির হিন্দুবিরোধী, সেই অপবাদ জুলাই-বিপ্লবের পর মুছে গেছে।

বিএনপি নেতৃবৃন্দÑ মির্জা আব্বাস, ডা. রিপন প্রমুখ এ মর্মে উন্মাদ প্রচারণা চালান যে, ছাত্রলীগের সমস্ত ভোট শিবির পেয়েছে। ড. রিপন ১ ডিগ্রি আগ বাড়িয়ে বলেন যে, জামায়াত শিবিরকে জেতানোর জন্য ১৫ কোটি থেকে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ভোট কেনার জন্য। আর যাহোক, ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা কি একটি উদাহরণ হতে পারে? কিন্তু ১৫ থেকে ২০০ কোটি টাকা- এত বড় ফারাক দেখিয়ে ওরা নিজেদেরই খেলো করেছেন। শিবিরকে এ অপপ্রচারের জবাব দিতে হয়নি। ওরা যে মিথ্যা সেটি জগন্নাথ হলের ভোটিং প্যাটার্ন থেকেই প্রমাণিত হয়। জগন্নাথ হলে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম পেয়েছেন ১ হাজার ২৭৬ ভোট। পক্ষান্তরে সেখানে সাদিক কায়েম পেয়েছেন মাত্র ১০ ভোট। তথাকথিত প্রগতিবাদীরা কি আরও এ ধরনের তথ্য চান? তাহলে কিন্তু থলের সব বেড়াল বেরিয়ে আসবে। সুতরাং সাধু সাবধান!

আমি এ কলামটি লিখছি বৃহস্পতিবার রাত ৮টায়। আমার লেখা শুক্রবার বিকেল ৫টার মধ্যে জমা দিতে হয় বলে রাতেই লেখা শেষ করে রাখি। আজ ইচ্ছে ছিলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) এবং হলসমূহের নির্বাচনী ফলাফল এ লেখার শেষ অংশজুড়ে দেবো। লেখার মূল উপজীব্য হলো ডাকসু নির্বাচন। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে জাকসুর ভোটের গণনা সবে মাত্র শুরু হয়েছে। তাই এ মুহূর্তে ডাকসু দিয়েই শুরু করি। বলা হয়েছে যে, শুক্রবার দুপুরের আগে গণনা শেষ হবে না। তাই শুক্রবার দুপুরের আগে ফলাফল জানাও সম্ভব হবে না।

ডাকসুর নির্বাচনে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী ফলাফলে বাম এবং সেক্যুলার এমনকি মধ্যপন্থি ঘরানাও চরম বিস্মিত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে ৪৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। তার আগে অবিভক্ত পাকিস্তানে ইসলামী ছাত্রসংঘ নামে একটি ছাত্র সংগঠন কাজ শুরু করে। সাবেক পূর্ব বাংলায় এ সংগঠনটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আলী। তাকে সহযোগিতা করেন মওলানা আব্দুস সোবাহান এবং ব্যারিস্টার কোরবান আলী। মওলানা আব্দুস সোবাহানকে শেখ হাসিনার স্বৈরাচার মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে তিনি অসুস্থ হন এবং কারাবন্দী থাকা অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিব সংবিধানে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। মুজিব সরকারের পতনের পর ১৯৭৭ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে ইসলামী রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে ইসলামী ছাত্রশিবির গঠন করা হয়।

গতবছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৩ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রশিবিরকে অফিসিয়ালি কোনো সরকার নিষিদ্ধ করেনি। ৩ আগস্ট শেখ হাসিনা এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ সত্ত্বেও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিববাদী ছাত্রলীগ এবং মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন গায়ের জোরে শিবিরের কর্মতৎপরতা নিষিদ্ধ করে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের এ গায়ের জোর খাটানোর কোনো প্রতিবাদ ছাত্রদল করেনি। ফলে সকলের ধারণা হয়েছিলো, ‘মৌনতা সম্মতির লক্ষণ’। বস্তুত ৫ আগস্ট ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত গণবিপ্লবে শেখ হাসিনা তার দলবল সহ ভারতে বিতাড়িত হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর থেকে সরকারী নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তারপর থেকেই ইসলামী ছাত্রশিবির প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করে।

তাই বলে বিগত ৪৮ বছর ছাত্রশিবির হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। যেহেতু সরকারের প্রশ্রয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরব সমর্থনে ছাত্রশিবিরকে প্রকাশ্যে কাজ করতে দেওয়া হয়নি তাই তাদেরকে পরিচয় গোপন রেখেই কাজ করতে হয়। যারা রাজনীতির অন্দরমহলের খবর রাখেন তারা বিলক্ষণ জানতেন যে, পরিচয় গোপন রেখে অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেও শিবির যে কর্মতৎপরতা চালায়েছে তার ফলে দিনের পর দিন এ সংগঠনটির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটতে থাকে।

শেখ হাসিনা প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে জামায়াতের শীর্ষ ৫ নেতাকে জুডিশিয়াল কিলিং অর্থাৎ সাজানো রায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। এ ৫ জন নেতা হলেন, মওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, আব্দুল কাদের মোল্লা এবং কামারুজ্জামান। বাংলাদেশে জামায়াতের শীর্ষ নেতা এবং সকলের মধ্যমণি অধ্যাপক গোলাম আজম এবং মওলানা আব্দুস সোবাহান এবং এ উপমহাদেশের বরেণ্য আলেম মওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী কারারুদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে/কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।

শেখ হাসিনার এ বিচারিক হত্যাকান্ড জামায়াত এবং শিবিরকে দুর্বল করার পরিবর্তে আআরও বহুগুণ শক্তিশালী করে। একদিকে যেমন লক্ষ কোটি জনগণের সহানুভূতি বর্ষিত হয় জামায়াত শিবিরের ওপর, অন্য দিকে বিপুল সংখ্যক নতুন কর্মী দলে যোগদান করেন। আজ আর এ কথা গোপন নয়, পরিচয় গোপন রেখে কাজ করতে করতে শিবির এত শক্তিশালী হয় যে, জুলাই অভ্যুত্থানে সাদিক কায়েম সহ শিবিরের অনেক নেতাকর্মী বিপ্লবের হাল ধরেন এবং এ বিপ্লব করতে গিয়ে তাদের অনেকে শহীদও হয়েছেন। সেকারণেই নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বে¡ও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনার পলায়নের পর রাজনীতিবিদদের যে বৈঠক ডাকেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার সেখানে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সর্ব প্রথম তিনি উচ্চারণ করেন আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের নাম।

বিগত ৪৮ বছর ধরে জামায়াত এবং শিবির আল্লাহর পথে থেকে জালিমদের যে অবর্ণনীয় এবং অমানবিক জুলুমের শিকার হয়েছেন তার প্রতিদান সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাদের দিয়েছেন। তাই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে বলছি, ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী এবং ভূমিধস বিজয়ে কুচক্রী, ষড়যন্ত্রী এবং কায়েমী স্বার্থবাদীরা, ‘অবাক তাকিয়ে রয়’। সারা পৃথিবীকে তাজ্জব করে দিয়ে কেনো এবং কীভাবে এ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন সম্ভব হলো সেটি নিয়ে দেশের সবকটি এবং সব ধরনের গণমাধ্যমে তুমুল জল্পনা-কল্পনা চলছে। একটি অবাক ব্যাপার হলো এ যে, এসব লেখালেখি, টকশো এবং কলাম লেখার মধ্যে শিবির সম্পর্কে নেতিবাচক লেখা খুব কমই রয়েছে। নির্বাচনোত্তর পর্যালোচনা অত্যন্ত সংক্ষেপে নিচে বর্ণনা করছি।

প্রথমত, জুলাই বিপ্লবে শিবিরের ভূমিকা। ৪৭ বছর ধরে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করে শিবির যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সে অভিজ্ঞতাকে তারা বিপ্লবের সফলতা অর্জনে বিপুলভাবে কাজে লাগিয়েছে। বিপ্লব সফল হওয়ার পর পরই নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁঈয়ার পাশাপাশি আর একটি নাম তাৎক্ষণিকভাবে যুগপৎ উচ্চারিত হয়েছে। সে নামটি হলো সাদিক কায়েম। দ্বিতীয়ত, শিবিরের প্যানেল তৈরি করার সময় তারা নজর রেখেছিলেন যে, প্যানেলটি যেনো অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়। অন্য কথায়, নারী, পাহাড়ী, হিজাবী, নন হিজাবী প্রমূখ সর্বশ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদেরকে এ প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জামায়াত ও শিবির নারী বিআরওধী- এই অপপ্রচার রাম এবং বামেরা ৪৭ বছর ধরে চালিয়ে এসেছে। কিন্তু এবার শিবিরের প্যানেল দেখে তাদের অপপ্রচারের বেলুন ফেটে গেছে। তৃতীয়ত, ইসলামী আন্দোলন এবং ইসলামী ছাত্রসংগঠনে শুধুমাত্র মৌলভী মওলানারাই আছেন। তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন, এমন আজগুবি প্রচারও এবার নস্যাৎ হয়েছে। সাদিক কায়েম রা’্রবিজ্ঞান বিভাগে শীর্ষ স্থান অধিকারীদের একজন। শিবিরের প্যানেল থেকে জিএস নির্বাচিত এস এম ফরহাদ অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছেন। প্রথম আলোর রিপোর্ট মোতাবেক এজিএস মহিউদ্দিন খান অনার্স ও মাস্টার্সের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা নাকি সহশিক্ষার বিরুদ্ধে। কিন্তু এবার নারী শিক্ষার্থীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন করার ফলে শিবিরের বিরুদ্ধে ঐ অপপ্রচার ভোঁতা হয়ে গেছে।

অনেক শিক্ষার্থীকে শিবির ট্যাগ দিয়ে অমানুষিক এবং নিষ্ঠুর জুলুম চালানো হয়েছে। এ ভয়াবহ নির্যাতনে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে হত্যাও করা হয়েছে। আবরারকে হত্যা করার কারণ, তিনি ফেসবুকে ভারতবিরোধী একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। আবরার হত্যাকাণ্ডসহ শিবিরের অসংখ্য কর্মীর প্রতি জুলুমের স্টিম রুলার ছাত্র ছাত্রী এবং অভিভাবক নির্বিশেষে সকলের সহানুভূতি অর্জন করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। শেখ হাসিনার ১৫ বছরে জামায়ত এবং শিবিরের প্রতি হাসিনার ভয়ঙ্কর জুলুম তাকে এক প্রতিহিংসাপরায়ণ নারী এবং তার কঠোর সমালোচকদের ভাষায় ডাইনি রূপে প্রতিভাত করেছে। পক্ষান্তরে শেখ হাসিনার এ চণ্ডালিনী রূপ শিবিরের প্রতি আপামর জনগণকে সহানুভূতিশীল করেছে।

শিবিরের এ ভূমিধস বিজয়ের অন্যতম কারণ হলো, ৫ আগস্টের পর বিগত ১৩ মাসে শিবিরের বিরুদ্ধে জুলুম নির্যাতন দখলদারি ইত্যাদি কোনো রকম ইলজাম বা অপবাদ শোনা যায়নি। শেখ হাসিনার পতনের পর স্বভাবতই রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষে উঠে আসে বিএনপি। কারণ হাসিনার শাসনামলে একদিকে ছিলো সরকারি দল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিআরওধী দল ছিলো বিএনপি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিএনপি এবং জামায়াত একসাথে নির্বাচন করলেও শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনীতিটা আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি না হয়ে বিএনপি বনাম জামায়াত রূপ পরিগ্রহ করে। বিএনপি আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বৃহত্তম দল- এমনটা ছিলো পাবলিক পারসেপশন। কিন্তু বিএনপি এ নবলব্ধ সন্মান ধরে রাখতে পারেনি। ঢাকা মহানগরী সহ সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ ওঠে। লঞ্চ টার্মিনাল দখল, বাস টার্মিনাল দখল, জলমহাল দখল থেকে শুরু করে হেন চাঁদাবাজি নাই যার সাথে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নাম জড়িত হয়নি।

সাধারণ মানুষকেও বলতে শোনা যায় যে, এ বিপ্লব করে কী লাভ হলো? শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল এলো। ওরা ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই ডিসি, এসপি, ওসি প্রমুখ সরকারী অফিসারদের হুকুম করা শুরু করে। উদাহরণ স্বরূপ, রংপুর থেকে ঢাকায় একটি মালবাহী ট্রাককে অন্তত ৫টি জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। আগে এই চাঁদা নিতো আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। এখন সে চাঁদা নিচ্ছে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলকে। কিন্তু এ সব অপকর্মের কোনোটির সাথে জামায়াত ও শিবিরের নাম কোথাও জড়িত হয়নি। জুলাই বিপ্লবের পর প্রধানত এই জামায়াত শিবির এবং মাদরাসার ছাত্ররা হিন্দুদের বাড়ি ঘর এবং মন্দির পাহারা দিয়েছেন। জামায়াত শিবির হিন্দুবিরোধী, সেই অপবাদ জুলাই-বিপ্লবের পর মুছে গেছে।

বিএনপি নেতৃবৃন্দÑ মির্জা আব্বাস, ডা. রিপন প্রমুখ এ মর্মে উন্মাদ প্রচারণা চালান যে, ছাত্রলীগের সমস্ত ভোট শিবির পেয়েছে। ড. রিপন ১ ডিগ্রি আগ বাড়িয়ে বলেন যে, জামায়াত শিবিরকে জেতানোর জন্য ১৫ কোটি থেকে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ভোট কেনার জন্য। আর যাহোক, ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা কি একটি উদাহরণ হতে পারে? কিন্তু ১৫ থেকে ২০০ কোটি টাকা- এত বড় ফারাক দেখিয়ে ওরা নিজেদেরই খেলো করেছেন। শিবিরকে এ অপপ্রচারের জবাব দিতে হয়নি। ওরা যে মিথ্যা সেটি জগন্নাথ হলের ভোটিং প্যাটার্ন থেকেই প্রমাণিত হয়। জগন্নাথ হলে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম পেয়েছেন ১ হাজার ২৭৬ ভোট। পক্ষান্তরে সেখানে সাদিক কায়েম পেয়েছেন মাত্র ১০ ভোট। তথাকথিত প্রগতিবাদীরা কি আরও এ ধরনের তথ্য চান? তাহলে কিন্তু থলের সব বেড়াল বেরিয়ে আসবে। সুতরাং সাধু সাবধান!