মুসফিকা আন্জুম নাবা

বিশ্বনবী হযরতমুহাম্মদ (সা.) সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন নবী ও রাসূল। তার সম্পর্কে পবিত্র কালামে হাকীমের সূরা আল আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘জগৎবাসীর জন্য রহমত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে আমরা আপনাকে রাসূল বানিয়ে পাঠাইনি’। মূলত, তিনি সব নবী ও রাসুলগণের নেতা। রাসূল (সা.)-এর সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি।’ সুরা আল ইনশিরাহ : ৪।

বস্তুত, নবী করিম (সা.) ছিলেন উত্তম চরিত্র ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণের অধিকারী। এ বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ প্রশংসা করে বলেন, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।’ সুরা আল কালাম : ৪. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আমি মহৎ চারিত্রিক গুণাবলির পূর্ণতা দান করার উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছি।’ বায়হাকি।

বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-কে সকল নবী-রাসুলগণের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘ছয়টি দিক থেকে সব নবীর ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। আমাকে ‘জাামিউল কালিম’ তথা ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত বাক্য বলার যোগ্যতা দেয়া হয়েছে, আমাকে ভীতি দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে, গণিমতের মাল আমার জন্য বৈধ করা হয়েছে, আমার জন্য সব ভূমিকে পবিত্র ও সিজদার উপযুক্ত করা হয়েছে, আমি সব মানুষের তরে প্রেরিত হয়েছি এবং আমার মাধ্যমে নবুয়ত পরম্পরা শেষ করা হয়েছে।’ সহিহ মুসলিম : ১১৯৫।

কিয়ামতের কঠিন দিনে আল্লাহর অনুমতিক্রমে নবী করিম (সা.) গোনাহগার উম্মতের জন্য শাফায়াত করবেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি হবো সব আদম সন্তানের নেতা। এতে কোনো গর্ব-অহঙ্কার নেই। আদম থেকে নিয়ে যত নবী-রাসুল আছেন সবাই আমার ঝাণ্ডার নিচে থাকবেন। আমি হচ্ছি প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশই সর্বপ্রথম কবুল করা হবে। এতে কোনো গর্ব-অহঙ্কার নেই।’ ইবনে মাজাহ। মূলত, তিনিই সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী ব্যক্তি হবেন। হাদিসে রাসূল (সা.)-এ এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতের দরজায় আমিই সর্বপ্রথম করাঘাত করব, তখন খাজেন (প্রহরী) জিজ্ঞেস করবে, কে আপনি? আমি বলব, মুহাম্মদ। সে বলবে, আপনার জন্যই খোলার ব্যাপারে নির্দেশিত হয়েছি, আপনার আগে কারও জন্য খুলব না।’ সহিহ মুসলিম

তাই তিনি যেসব বিষয়ে আদেশ করেছেন তা পালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মোমিনের জন্য অবশ্যই কর্তব্য। কেননা, তা ইমানদার হওয়ার অপরিহার্য শর্ত। কালামে পাকে আল্লাহ বলেন, ‘রাসুল তোমাদের যা দেন, তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ সুরা হাশর : ৭. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তোমাদের প্রবৃত্তি আমার অনুসরণ করে।’

আল্লাহতায়ালা বিশ্বনবী (সা.)-এর মর্যাদাকে সমুন্নত করার জন্য দরুদ ও সালাম পাঠের নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহপাক বলেন, ‘আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের তরে দোয়া করো এবং তার প্রতি সালাম প্রেরণ করো।’ সুরা আল আহযাব : ৫৬। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করবে আল্লাহ তাকে দশবার দরুদ পাঠ করেন, দশটি গোনাহ মুছে দেবেন এবং দশটি মর্যাদায় ভূষিত করবেন।’ সুনানে নাসাঈ।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিশ্বনবী (সা.)কে শুধু শ্রেষ্ঠত্বই প্রদান করেননি বরং তা প্রমাণের জন্য নানাবিধ মুজিজাও দিয়েছেন। অলৌকিক কোনো কাজের পারিভাষিক শব্দরূপে মুজিজা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। মুজিজা হলো নবী-রাসুলের নিজস্ব দাবির সমর্থনে এমন অলৌকিক ও আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়ে দেখানো, যা নবী-রাসুল ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে ঘটানো আদৌ সম্ভব নয়। আল্লাহ তা’আলা নবী ও রাসুলদের বিভিন্ন মুজিজা দান করেছেন। যেমন, মুসা (আ.)-এর লাঠি সাপ হয়ে যেত, ঈসা (আ.) মৃতকে জীবিত করতে পারতেন। হযরত সুলাইমান (আ.) বাতাসকে বশীকরণ করতে পারতেন। তিনি পাখি ও পিঁপড়ার ভাষাও বুঝতেন। জিনদের দিয়ে কাজ করাতেন।

বিশ্বনবী (সা.)কেও তার রেসালাত ও নবুয়ত প্রমাণের জন্য নানাবিধ মুজিজা সহ দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়। নিম্নে তার কিছু মুজিজা নিয়ে আলোকপাত করা হলো- হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণীত যে, হুদাইবিয়ায় সাহাবায়ে কেরামগণ (রা.) পিপাসায় ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। রাসুল (সা.) এর সামনে একটি পাত্রে সামান্য পানি ছিল। তিনি তা দিয়ে ওযু করলেন। সাহাবায়ে কেরামগণ আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আপনার পাত্রের এ অল্প পানি ছাড়া আমাদের কারো কাছেই কোনো পানি নেই, যা-দিয়ে আমরা ওজু করবো ও পান করাবো। তখন বিশ্বনবী (সা.) নিজ হাত মোবারক পাত্রের ভিতর রাখলেন। রাসুল (সা.) নিজ হাত পাত্রে রাখার সাথে সাথেই আঙ্গুল মোবারক থেকে পানি প্রবাহিত হতে লাগলো। হযরত জাবের (রা.) বলেন, আমরা সকলেই সে পানি পান করি এবং অজু করি। হযরত জাবের (রা.) কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, আপনারা কতজন ছিলেন? উত্তরে তিনি বললেন যে, এক লক্ষ মানুষ হলেও সে পানি যথেষ্ট হতো। কিন্তু আমরা দেড় হাজার মানুষ ছিলাম।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিযরত করার প্রায় পাঁচ বছর পূর্বে একদিন মক্কার মুশরিকরা মুহাম্মদ (সা.) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললো, যদি আপনি সত্য নবী হয়ে থাকেন তাহলে আকাশের চাঁদকে দু’টুকরো করে দেখান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি যদি মুজিজা দেখাতে পারি, তবে কি তোমরা ইসলাম গ্রহণ করবে? তারা বললেন হ্যাঁ, করবো। রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে নিজ আঙ্গুল মোবারক দ্বারা ইশারা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ দু’ টুকরো হয়ে গেলো। এক টুকরো আবি কুবাইস পাহাড়ে আর অন্য টুকরো কাইকাআন পাহাড়ে পতিত হলো। সেটি ছিল পূর্ণিমা চাঁদ।

একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে একদল সাহাবা উপস্থিত ছিলেন। রাসুল (সা.) তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে একজন খাদেমকে পাঠালেন নিজ ঘরে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ঘরে কিছুই পাওয়া গেলো না। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর চোখে এক বকরি পড়লো। যা এখনো বড় ও হয়নি, বাচ্চা ও দেয়নি। এ বকরি থেকে দুধ দোহন করা কেউ কল্পনা ও করেনি। কিন্তু হুজুর (সা.) এ বকরির বাচ্চা থেকে এক পেয়ালা দুধ দোহন করে স্ত্রীগণের নিকট পাঠালেন এবং পুনরায় সেই বাচ্চা থেকে দুধ দোহন করে সকলে তৃপ্তিসহ পান করলেন।

আরেক দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘরে বসে আছেন। হযরত আবুবকর (রা.) ও হযরত উমর (রা.) এসে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, কিছু খাইনি। রাসুল (সা.) বললেন কেন কী হয়েছে? দু’জনই বললেন, আমরা পেটে পাথর বেঁধে আছি, কয়েকদিন হলো কিছুই খাইনি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমাদের পেটে তো একটি পাথর বাধা রয়েছে। কিন্তু তোমাদের নবীর পেটে দু’টি পাথর বাধা। এরমধ্যেই এক সাহাবী এসে বললেন, আল্লাহর রাসুল, আমি আসরের নামাজের পর হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদের ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তার ঘরে দেখলাম খেজুরের স্তূপ। বিশ্বনবী (সা.) তখন মিকদাদ বিন আসওয়াদের ঘরে গেলেন। তিনি মিকদাদ বিন আসওয়াদকে বললেন, মিকদাদ, আমরা কিছুই খাইনি।

তাই আবুবকর ও উমরকে নিয়ে চলে আসলাম। এ কথা শুনে মিকদাদ বিন আসওয়াদ কাঁদতে লাগলেন, রাসুল (সা.) বললেন হে মিকদাদ তুমি কাঁদছো কেন? মিকদাদ বিন আসওয়াদ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আজ আপনি আমার ঘরে এসেছেন, কিন্তু আমার ঘরে আজ কিছুই নেই। খেজুরের যে স্তূপ ছিল, নামাজের আগেই আমি মদিনার গরীব মিসকিনদের মাঝে বন্টন করে দিয়েছি। এখন আমার ঘরে একটা খেজুর ও নেই। এ আক্ষেপে মিকদাদের চোখে পানি এসে গিয়েছিল, তা দেখে রাসুল (সা.) এর দয়ার সাগরে জোশ এসে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এখানে কি কোনো গাছ আছে? মিকদাদ বললেন, এখানে তো কোন খেজুর গাছ নেই, তবে একটা শুকনো খেজুর গাছ আছে।

রাসুল (সা.) নিজ চাদর দিয়ে বললেন, যাও, শুকনো খেজুর গাছের নিচে এ চাদর বিছিয়ে বলবে, নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তোমার কাছে খেজুর চাচ্ছে। মিকদাদ (রা.) কথামতো চাদর নিয়ে বিছিয়ে বললেন নবী (সা.) তোমার কাছে খেজুর চাচ্ছে। দেখি মুহূর্তের মধ্যে শুকনো খেজুর গাছটি তরতাজা হয়ে গাছ থেকে খেজুর ঝরে পড়তে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই চাদর খেজুরে ভরপুর হয়ে গেল। চাদরটি উঠিয়ে রাসুল (সা.) এর নিকট নিয়ে আসি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে মিকদাদ, তুমি যদি চাদরটি না উঠাতে তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত এ গাছ থেকে খেজুর পড়তে থাকতো। মূলত, রাসূল (সা.) সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ। এ প্রসঙ্গে সূরা আহযাবের ২১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ সূরা আল ক্বলমের ৬৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এবং নিশ্চয় আপনি (মুহাম্মদ সাঃ) মহান চরিত্রের অধিকারী’।

পৃথিবীর প্রায় ৮শ’ কোটি মানুষের পঁচিশ শতাংশ মানুষ বিশ্বনবীর প্রচারিত শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী। পৃথিবীতে এমন কোনও দেশ নেই যেখানে ইসলামের বাণী পৌঁছায়নি। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একজন খ্রিস্টান গবেষক মাইকেল এইচ হার্ট একদল গবেষক নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষের খোঁজ করতে গিয়ে আল্লাহর নবী পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী একশ’ ব্যক্তির তালিকার প্রথম স্থান দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার রচিত Huendred : A Ranking of the Most influential Persons in History বইটি ১৯৭৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হলেও ১৯৯২-এ পুনঃপ্রকাশিত হয়। সে-বারও মাইকেল হার্ট হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্বের একশ সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষের তালিকায় প্রথম স্থানে রেখেছেন। তাই সকল দিক বিবেচনায় বিশ্বনবী (সা.) সর্ব যুগের, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব-এতে কোন সন্দেহ নেই। তার মু’জিজার মাধ্যমেও তা প্রমাণিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, জয়পুরহাট সরকারি মহিলা কলেজ, জয়পুরহাট।