খালিদ হাসান বিন শহীদ
২০২৪ সাল। জুন মাস থেকে ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি বৃহৎ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে জনসমর্থন লাভ করে এবং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে রূপ নেয়। আন্দোলনটি প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকলেও দ্রুতই তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে। শ্রমিক-পেশাজীবী-ব্যবসায়ী-আলেম-ওলামাসহ বিভিন্ন শ্রেণির-পেশার মানুষ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর স্বতঃস্ফূর্ততা এবং সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। জুলাই বিপ্লব নামে পরিচিত দুনিয়া কাঁপানো এ গণঅভ্যুত্থানে ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অগণিত প্রাণ বিসর্জন দেয়ার মধ্য দিয়ে বিগত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। ঐতিহাসিক এ বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এটি পরে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে আরো প্রবল হয়ে উঠেছিল; যা ৫ আগস্ট চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। সরকার প্রথমদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সরকারের দমন-পীড়ননীতি কার্যকর হয়নি। বরং দমননীতিতে একহাত দেখে নিতে জনগণ আরও সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামে। মূল ধারার মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার সরকার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে যতই ক্ষমতা ধরে রাখতে চেষ্টা করেছিল, জনগণের সম্মিলিত শক্তির সামনে সে কৌশল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।
মূলত পুলিশের গুলীতে নিহত রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু এ আন্দোলনে ক্লাইমেক্স তৈরি করে। যে বুক পেতে অপরাজিতের মতো পুলিশের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটা আন্দোলনে আবু সাঈদের মতো কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র আন্দোলনকে আরো বেগবান করে। উদাহরণ হিসেবে আমরা আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে আসাদের মৃত্যু কিংবা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেনের মৃত্যুর কথা বলতে পারি। আবু সাঈদের মৃত্যুর পর রাতারাতি পাল্টে যায় আন্দোলনের দৃশ্যপট। মুহূর্তেই আন্দোলন রূপ নেয় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। ইতিহাসে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন নতুন কিছু নয়। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের ফরাসি বিপ্লব কিংবা ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লব ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সফলতম বিপ্লব। যার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের পতন হয়। এ বিপ্লবগুলো কালের সাক্ষী হয়ে স্বৈরাচারের নির্মম পতনের কথাগুলোকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মানুষও বিভিন্ন সময় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছে। যেমন : ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন অথবা নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু এতসব সফলতম আন্দোলনগুলোর মধ্যেও এ আন্দোলন ছিল অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
শুরুতে এ আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরমধ্যে তখনকার ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেনÑ ‘কোটার বিষয়টি সমাধান হবে আদালতে।’ এক প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে?’ সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তুমি কে আমি কেÑ রাজাকার, রাজাকার’; কে বলেছে কে বলেছেÑ স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’Ñএ স্লোগান উঠলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠে। আন্দোলন দমাতে আলোচনার পথে না গিয়ে সরাসরি গুলী, ডিবি অফিসে ধরে এনে নির্যাতনের মতো পথগুলো বেছে নেয় তৎকালীন সরকার। একদিকে রক্ত ঝরতে থাকে রাজপথে, মৃত্যু আর আহতের ভিড় বাড়তে থাকে হাসপাতালগুলোতে। সে সঙ্গে বড় হতে থাকে আন্দোলনের জমায়েতও। সরকারের তরফে জবাব ছিলÑ গুলী, টিয়ারশেল আর লাঠি; এককথায় কেবলই বলপ্রয়োগ। প্রথমে ফেইসবুক, পরে ইন্টারনেট বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায় সরকার। তাতে হিতে বিপরীত হয়। পুলিশের বুলেটে আবু সাঈদের অটল বিশ্বাসে ভরা বুকটার নিশ্বাস আটকে যায়, মুহূর্তেই তিউনিসিয়ার মোহাম্মদ বোয়াজিজি মূর্তমান হয়ে উঠে আমার বাংলায়। শুরু হলো বাংলা বসন্ত। সরকার বুঝতেই চাইল না ক্ষমতা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। পতঙ্গের পতন এলে সে আগুনের দিকেই ঝুঁকবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপেশাদারিত্ব, মন্ত্রীদের বিতর্কিত বক্তব্য পাল্টে দিলো বিপ্লবের ধারা, বিক্ষোভে ফুঁসে উঠল হাজারো তরুণ। ভাষা এবং শব্দের ব্যবহারে মতাদর্শের প্রতিফলন কীভাবে ঘটে এবং তার প্রতিবাদ কেমন হওয়া উচিতÑ এ প্রজন্মের উদিয়মাণ তরুণরা তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করল। অকুতোভয় ছাত্র–জনতা আলিঙ্গন করতে শিখে নিল মৃত্যুকে, রাজপথে স্লোগান উঠল ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ ধ্বনিতে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা ছিল। তবে এর হার ও ধরন বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ পদে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত ছিল। ওই বছর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করা হয়। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতই বহাল রেখে জারি করা পরিপত্র। ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। গত বছরের ৫ জুন সে আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট। ওইদিনই রায় প্রত্যাখান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখান শিক্ষার্থীরা। এরপর ৯ জুন হাই কোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫ জুন পরবর্তী ৬১ দিনের মধ্যে প্রথম ৪০ দিন দেশের নানা জায়গায় আন্দোলন হলেও জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা, পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে; শুরু হয় ছাত্রজনতার প্রতিরোধ। রচিত হয় নতুন এক অধ্যায়ের। মুক্তির নেশায় মেতে ওঠে আপামর ছাত্র-জনতা।
১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্রতর হতে শুরু করে। ২৯ জুলাই চূড়ান্ত সংঘর্ষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ, আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও পুলিশের হামলা হয়, যা শিক্ষার্থীদের ক্রোধকে আরও অগ্নিস্ফুলিঙ্গে রূপ দেয়। এরই মাঝে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয় সরকার। সারাদেশে ইন্টারনেট প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সরকারের বিরোধিতা করার অভিযোগে প্রায় সকল জেলায় পুলিশ গণগ্রেফতার চালায় ও হাজার হাজার মানুষকে আটক করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন কিছু না কিছু মানুষ নিহত হতে থাকে। কোথাও কোথাও চোরাগোপ্তা হামলা ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। তা সত্ত্বেও অঞ্চলভিত্তিক সমন্বয়কদের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ৫ আগস্ট লাখো মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ‘গণভবন’ এর দিকে যাত্রা করে। শেখ হাসিনা তার পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির নিকট জমা দিয়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় হেলিকপ্টারযোগে ভারতের দিল্লিতে পালিয়ে যান। অবেশেষে ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে এদশের মানুষের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন হয়। বাংলার আকাশে উদিত হয় নতুন স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য...। রক্তপিচ্ছিল খুনরাঙা পথ মাড়িয়ে স্বাধীনতার সেই সূর্য় ছিনিয়ে আনা জুলাই বিপ্লবের মহানায়ক শহীদ আবু সাঈদ-মুগ্ধরা ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকুক যুগ-যুগান্তরে, বাংলার মানুষের হৃদয়দর্পনে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী