উন্নয়ন অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, ব্যাপক উন্নয়ন এবং শূন্য দুর্নীতি একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে কাক্সিক্ষত মডেল হিসেবে গণ্য হতে পারে। এমন কী তুলনামূলক কম উন্নয়ন এবং শূন্য দুর্নীতিও কাক্সিক্ষত কিন্তু অতি উন্নয়ন এবং ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রতিটি দেশের সরকারকেই তাই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সময় লক্ষ্য রাখতে হয় উন্নয়নের নামে যেনো দুর্নীতি প্রশ্রয় না পায়। উন্নয়নের জন্য যে অর্থায়ন করা হয় তার যোগান দেয় রাষ্ট্র। এমন কী বিদেশ থেকে উন্নয়নের নামে যে ঋণ গ্রহণ করা হয় তার দায়ভার শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র তথা জনগণকেই বহন করতে হয়। তাই উন্নয়নের নামে এমন কিছু করা যাবে না যাতে দেশের মানুষ উন্নয়নের কাক্সিক্ষত সুফল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। আমরা প্রায়শই বলে থাকি সরকারি সম্পত্তি বা সরকারি প্রতিষ্ঠান। এ কথাটি আসলে মোটেও ঠিক নয়। সরকার জনগণের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়ভার বহন করে। একই সঙ্গে সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির আমানতদারি করে থাকে। রাষ্ট্রের ৪টি আবশ্যিক উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল এবং একমাত্র পরিবর্তনশীল উপকরণ বা উপাদান হচ্ছে সরকার। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর সরকার পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্য তিনটি উপকরণ যেমন, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, নির্দিষ্ট ভূখন্ড এবং জনসংখ্যা পরিবর্তিত হয় না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও পরিবর্তিত হয় না।
সরকার যদি তার অবস্থান বুঝতে পারে তাহলে সে সরকার দ্বারা জনস্বার্থ বিরোধী কোনো কার্যকলাপ সংঘটিত হতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের মতো দেশের সরকারগুলো নিজেদের জনগণের প্রভু বলে মনে করে। তারা আরো মনে করে, সরকার হিসেবে তারা রাষ্ট্রের সমুদয় সম্পদের মালিক। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা করা হয় প্রতিনিধির মাধ্যমে। অর্থাৎ রাষ্ট্র এখানে স্বয়ং তার সম্পদের ব্যবস্থাপনা করে না। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং দুর্নীতির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বা সম্পদ ব্যবস্থাপনা করেন স্বয়ং মালিক। ফলে সেখানে সততা এবং জবাবদিহিতা থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। যারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন বা কর্মরত থাকেন তারা জানেন একটি নির্দিষ্ট বয়স হলেই তাদের বিদায় নিতে হবে। তাই তারা চেষ্টা করেন কিভাবে নিজের আখের গুছিয়ে নেয়া যায়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার প্রচন্ড অভাব পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির সঙ্গে দুর্ভাগ্য যুক্ত না হলে সাধারণত কারো চাকরি চলে যায় না। কিন্তু সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত আছে।
একটি সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার হাতে দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। সরকার কিভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছরের স্বেচ্ছাচারী শাসনামলে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লুটেরাদের ব্যাপক এবং সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। সে দুর্ভিক্ষের সময় লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হয়েছে, ১৯৭৪ সালে দেশে যে খাদ্য মজুত ছিল তাতে এত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হবার কথা নয়। খাদ্য মজুত সংকট নয়, ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ব্যাপক দুর্নীতি এবং চোরাচালানির মাধ্যমে খাদ্য শস্য সীমান্তের ওপারে পাচার করে দেয়া। আওয়ামী লীগের শাসন কার্যের মূল চিত্র হচ্ছে ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের অর্থ-সম্পদ লুটে নেয়া। ২০০১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) তাদের প্রতিবেদনে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষস্থান দিয়েছিল। সেই সময় অর্থাৎ ২০০১ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সুকৌশলে প্রচার চালায় যে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ক্রমাগত ৫বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কিন্তু তারা একবারও প্রকাশ করেনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ২০০১ সালে দুর্নীতির যে ধারণা সূচক প্রকাশ করেছিল তার ভিত্তি বছর ছিল ২০০০ সাল। অর্থাৎ বাংলাদেশ ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো দুর্নীতির ধারণা সূচকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। মিডিয়ায় এ ব্যাপারে কিছু লেখালেখি হবার পর আওয়ামী লীগ দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিষয়টি নিয়ে আর তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। আওয়ামী লীগ এমন এক রাজনৈতিক দল যারা নিজেরা অপকর্ম করে অপকর্ম করে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপাতে বড়ই পটু। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ভোটার বিহীন নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো সারা দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে। সে আন্দোলনের সময় বাসে আগুন দেয়া শুরু হয়। একটি বিশেষ পরিবহনের বাসে সবচেয়ে বেশি আগুন দেয়া হয়। সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি’র বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের অভিযুক্ত করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে কোনো একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও যে বা যারা সরাসরি আগুন দেবার জন্য দোষি তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তার অর্থ কি এই নয় যে, যারা বাসে আগুন দিয়েছেন তারা বিশেষ বাহিনীর প্রহরায় আগুন দেয়। ফলে তাদের গ্রেপ্তর করা হয়নি।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিশেষ সহানুভুতি লাভ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের নিরাপদে প্রস্থানের সুযোগ দেয়া হবে এই শর্তে নাকি তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর তাদের আচরণ কি ছিল তা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। তারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে সংবিধান থেকে বাদ দেয়া হয়। অথচ এক সময় আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কায়েমের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। আন্দোলনকালে তারা সাধারণ মানুষকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার স্বৈরাচারি সরকারের রূপ পরিগ্রহ করে। গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকার যদি স্বৈরাচারি হয় তাহলে সেটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে।
স্বৈরাচারী সরকারের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা উন্নয়ন সাধনে তৎপর হয়, যাতে সাধারণ মানুষ মনে করতে পারে তারা দেশের জন্য কত কিছুই না করছেন। কিন্তু তাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টার পেছনে মূল উদ্দেশ্য থাকে দেশের অর্থ নিজেদের পকেটে ভরা। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনামলে দৃশ্যমান উন্নয়ন বেশি হয়। বিশেষ করে অবকাঠামোগত খাতে উন্নয়ন বেশি হয়। কারণ অবকাঠামোগত খাতের উন্নয়ন বেশি দৃশ্যমান হয় এবং এখান থেকে অর্থ আত্মসাতের সুবিধা তুলনামূলকভাবে বেশি। গণবিরোধী সরকার আমলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেশি হয়। আমরা সে অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আইয়ুব খানের ১০ বছরের শাসনামলে। বাংলাদেশের যত বড় বড় স্থাপনা তা আইয়ুব খানের আমলে তৈরি। কমলাপুর রেল স্টেশন, জাতীয় সংসদ ভবনসহ আরো নানা স্থাপনা সেই সময় তৈরি হয়। তবে আইয়ুব খানের আমলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও অর্থ লোপাটের ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া যায় না। এরশাদ আমলে ৯ বছরের বেশি সময়ে দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়। দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলেও তার পরিধি ছিল অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনামলে যে উন্নয়ন হয়েছে তা নানা কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে রাস্তা-ঘাটসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করা হয়। উন্নয়নের নামে ব্যাপক হারে রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট করা হয়। প্রতিটি প্রকল্পের বাস্তব ব্যয়ের চেয়ে ৩/৪ গুণ ব্যয় বেশি দেখিয়ে অর্থ লুটে নেয়া হয়েছে। বিগত সরকার আমলে অতি উন্নয়ন অতি দুর্নীতির এক মহাসম্মিলন আমরা প্রত্যক্ষ করি।
উন্নয়ন প্রকল্পের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের দৃষ্টান্ত আওয়ামী লীগ আমলেই প্রত্যক্ষ করা গেছে। ফরিদপুরের বালিশ কান্ডের কথা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। বিগত সরকার আমলে দেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারররে উদ্যোগে শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বিগত সরকার আমলে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর ১ লাখ ৮০হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। পাচারকৃত অর্থের বেশির ভাগই আসে অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে দুর্নীতির মাধ্যমে। তবে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ পুরোটাই যে বিদেশে পাচার করা হয়েছে তা নয়, দেশেও রয়েছে। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত বিপুল পরিমাণ সম্পদ দলীয় সমর্থকদের কব্জায় রয়েছে। এ সম্পদ রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করে তা জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অতিউন্নয়ন, অতিউন্নয়নের কুফল আমরা বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। আগেই বলা হয়েছে, স্বৈরাচারি সরকার আমলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেশি হয়। এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা কথায় কথায় বলেন, বিগত সরকার আমলে যে উন্নয়ন হয়েছে তার সুফল আমরা এখন ভোগ করছি। তাদের বক্তব্য উপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু উন্নয়নর জন্য দেশের মানুষকে কেমন মূল্য দিতে হয়েছে তা কি তারা বুঝেন না? সরকার নিজের অর্থ দিয়ে উন্নয়ন করেন না। তারা উন্নয়নের জন্য জনগণের নিকট থেকে ট্যাক্স আদায় করেন অথবা বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন, যার পুরো দায়-দায়িত্ব বহন করতে হয় সাধারণ মানুষকে। আমি যদি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করি তাহলে সেখানে স্বচ্ছতার তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। কিন্তু জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের অর্থ ব্যয় করার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে বুঝতে পারবো বিগত সরকার আমলে কিভাবে উন্নয়নের নামে অর্থ লোপাট করা হয়েছে। বিগত সরকার আমলে সড়ক এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেশি হয়েছে। ভারতে চার লেন সড়ক নির্মাণে ব্যয় হয় প্রতি কিলোমিটারে ১৪ লাখ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানে একই পরিমাণ সড়ক নির্মাণে ব্যয় হয় ২৯ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। ইন্দোনেশিয়ায় খরচ হয় ২১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। ফিলিপাইনে ব্যয় হয় ১১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। চীনে ৩৯ লাখ মার্কিন ডলার। তুরস্কে ব্যয় হয় ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। আর বাংলাদেশে এক কিলোমিটার চার লেন সড়ক নির্মাণে ব্যয় হয় ৬৩ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। ব্যয়ের এ পরিমাণ কি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে? উন্নয়নের নামে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এভাবে বিপুল পরিমাণ ব্যয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
উন্নয়নের নামে অর্থ আত্মসাতের মানসে প্রকল্প গ্রহণের হিড়িক লক্ষ্য করা গেছে। প্রয়োজন থাকুক আর নাই থাকুক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইকালে সম্ভাব্য রিটার্নকে অতিমূল্যায়ন করে দেখানো হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তুলনামূলক কম ব্যয় প্রাক্কলন করা হলেও পরবর্তীতে দফায় দফায় ব্যয় এবং সময় বাড়ানো হয়েছে। বলা হয়েছিল, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রতিবছর আমাদের জিডিপি’র পরিমাণ ১ থেকে দেড় শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু পরবর্তীতে এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বলা হয়নি। কিভাবে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে দেশকে আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়া হয়েছে তার একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত দেশের প্রথম ট্যানেল নির্মাণকালে আর্থিক রিটার্নের যে কল্প কাহিনী শোনানো হয়েছিল তা অর্জিত হয়নি। নির্মাণ কাজ শেষে ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর এই ট্যানেল যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ট্যানেল নির্মাণে ব্যয় হয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেয়া হয়েছে। এই ট্যানেল চালু হবার পর থেকে গত ১৯ জুলাই পর্যন্ত মোট ২৪ লাখ ২৮ হাজার ৩১৫টি গাড়ি চলাচল করেছে। অথচ এই সময়ে মোট কোটি ৩১ লাখ ২২ হাজার ৬৮১টি গাড়ি চলাচলের কথা ছিল। অর্থাৎ ২১ মাসে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৮ শতাংশ গাড়ি চলাচল করেছে।
প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণকালে জাতিকে কল্পকাহিনী শোনানো হলেও বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনো প্রকল্পই নির্দিষ্ট সময়ে প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এটা অর্থ লোপাটের একটি কৌশল। বারবার প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি এবং সময় বাড়ানো হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারলে তার দায়ভার কেনো রাষ্ট্র বহন করবে? ব্যর্থতার দায় তো বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের। উন্নয়নের মূল উপজীব্য হওয়া উচিত তুলনামূলক স্বল্প ব্যয়ে গুণগত মানসম্পন্ন কাজ নিশ্চিতকরণ। বাস্তবায়নকারী সংস্থা যদি নির্ধারিত সময়ে প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতে না পারে তা হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই তার মাশুল দিতে হবে।
লেখক : সাবেক ব্যাংকার।