ড. বি এম শহীদুল ইসলাম
দীর্ঘ ১৬ বছর যাবৎ দেশ ফ্যাসিবাদের করাল গ্রাসে ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির চাকা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। মানুষের নূন্যতম বেঁচে থাকার অধিকারটুকু নষ্ট হয়ে গেছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা মাটির সাথে মিশে একাকার হয়েছে। হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারি চাকরি হারিয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে গেছে। সময়ের পরিক্রমায় ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফলে ২৪-এর ৫ আগষ্ট ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত হয়। ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। দেশের জনগণ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে। গত বছরের জুলাই মাসে আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলো স্মরণ করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে বিচিত্র আঙ্গিকে। সরকারের পক্ষে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ৫ আগষ্ট ফ্যাসিবাদের পতন দিবস উদযাপনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সকলেই। এরই মধ্যে হঠাৎ করে রাজধানীর আকাশে কালো ধূম্রজাল সৃষ্টি হলো। বিমান বাহিনীর বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অনেক কোমলপ্রাণ শিশু-কিশোরের মৃত্যুর মতো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেল। শিক্ষক-কর্মচারি, অভিভাবক কেউ বাদ যায়নি। এমন অস্বাভাবিক দুর্ঘটনা জাতিকে গভীর শোকের মধ্যে নিমজ্জিত করেছে। শোকে মুহ্যমান সন্তান হারা মা-বাবারা। বিষয়টি নাড়া দিয়েছে দেশবাসীকে, নাড়া দিয়েছে বিশ্ববাসীকে। কারণ বিমান দুর্ঘটনা আবাসিক এলাকায় এটি প্রথম। মর্মান্তিক এ বিমান দুর্ঘটনায় কোমলমতি শিশু-কিশোরদের আত্মত্যাগ জাতিকে ভীত বিহ্ববল করে তুলেছে। আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে দেশের অভিভাবক, মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনদের। হ্যা, বলছি; মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থীদের হারানোর শোকে আর্তনাদে ফেটে পড়েছে গোটা দেশ। আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে বিশ্বময়। এমন একটি সময়ে এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ঘটল যখন গণভ্যুত্থানের বছর পূর্তি অতি সন্নিকটে। এমন একটি হৃদয় বিদারক ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি ফ্যাসিবাদি মহল ভিন্ন দিকে পরিস্থিতি নেয়ার চেষ্টা করছে। গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোকে বিভেদের মধ্যে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। এহেন পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে ইস্পাত কঠিন শিশা ঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
দেশ এবং জাতির প্রত্যাশার বিষয় হচ্ছে- এমনই একটি আহ্বান বলিষ্ঠ কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথায়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও ঘটনা পরম্পরায় দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে গত কয়েক দিনে ১৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে তিনি সকলকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন। ফ্যাসিবাদি শক্তি যাতে নতুন করে কোনো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বাংলাদেশের অতি প্রবীণ ও সত্যের সাহসী গণমাধ্যম দৈনিক সংগ্রামসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। খবরে জোরেশোরে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরে আমাদের আয়োজন ছিল সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে নিয়ে অতীতকে স্মরণ করা, সেজন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলাম। এতে করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের মধ্যে ঐক্যটা দৃশ্যমান হবে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে”। গত ২২ ও ২৩ জুলাই বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ‘মত ও দর্শনগত পার্থক্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যকে আরও দৃশ্যমান করা জরুরি। তা না হলে তারা এটাকে সুযোগ মনে করছে’। বৈঠকে অংশ নেওয়া সকল দল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও গণ ঐক্য অটুট রাখার বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়। তারা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রধান উপদেষ্টাকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান। নেতৃবৃন্দ সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে নির্বাচনকে সামনে রেখে ও ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করতে আরও নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সর্বদলীয় সভা আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, দেশকে ধ্বংসে পরিণত করে পালিয়ে যাওয়া পতিত ফ্যাসিবাদি শক্তি দেশে পরিকল্পিতভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত এবং গোয়েন্দা ও প্রশাসনিক কিছু দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব দুর্বলতা চিহ্নিত করে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে। তারা বলেছেন, সরকারের উচিত প্রশাসনকে আরো কঠোর এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা জোরদার করা, যাতে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো বলেছেন, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের কোনো স্থান থাকবে না। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্য অটুট রাখতে হবে এবং দেশের প্রতিটি শহরে, গ্রামে-গঞ্জে, বন্দরে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, তাহলে অতীতের আন্দোলনের সকল অর্জন বৃথা হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় দেশ নতুন করে ষড়যন্ত্রের মুখে পতিত হবে।
প্রথম দিনের বৈঠকে অংশ নেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী; জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ; জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন ও যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান। দ্বিতীয় দিনে অংশ নেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সৈয়দ হাসিব উদ্দিন হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির মজিবুর রহমান, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) রেদোয়ান আহমেদ, খেলাফত মজলিসের ড. আহমদ আবদুল কাদের, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডির তানিয়া রব, ১২ দলীয় জোটের শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) রুহিন হোসেন প্রিন্স ও গণফোরামের মিজানুর রহমান।
এহেন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দেয় রাজনৈতিক দলগুলো। একই সঙ্গে নেতারা যেখানেই ফ্যাসিবাদ, সেখানেই সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ ও মোকাবিলার ঘোষণাও দিয়েছেন। তাদের এ ঘোষণা জাতিকে আশ্বস্ত করবে বলে গোটা জাতি মনে করে। রাজনীতিতে একে অপরের সমালোচনা করবে এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে তা হতে হবে রুচিশীল,শালীন ও শিষ্টতার ভিত্তিতে। বিধ্বস্ত দেশবাসীর অসহায়ত্ব ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি এবং তাদের দোসররা যেন পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে না পারে সে ব্যবস্থা সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে থাকা অপরিহার্য। তবে গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে যদি কোনো দল মব সৃষ্টি করে, চাঁদাবাজি করে, টেন্ডারবাজি করে অথবা ফ্যাসিবাদকে গোপনে সমর্থন জানায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিরোধ ও ঐক্য গড়ে তোলা হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্য জোরদারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের যে আহ্বান তাকে আমরা স্বাগত জানাই আমাদের প্রত্যাশা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্য অটুট থাকুক। ফলশ্রুতিতে সংস্কার বিচার এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় উত্তীর্ণ হোক।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট।