॥ সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা ॥

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানবসেবা ও মানবকল্যাণকে কেন্দ্র করেই মানুষের কর্মযজ্ঞ ও কর্তব্য আবর্তিত হচ্ছে। হয়েছে সভ্যতার বিবর্তন; পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন। মূলত, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। একই সাথে একাজ সর্বোৎকৃষ্ট কাজ বিবেচিত হয়ে আসছে। বিষয়টি নিয়ে বাগ্মীদের লম্বা-চওড়া বক্তৃতা শুনে আমরা যেমন পুলকিত হই; ঠিক তেমনিভাবে এ বিষয়ে প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ও বিদগ্ধজনদের অভিজ্ঞান জেনে আমরা প্রেরণা লাভ করি। রাজনীতিকরা তো আমাদের প্রতিনিয়ত মানবসেবা তথা জনসেবার ব্রতের বয়ান শুনিয়ে রীতিমত কৃতার্থ করে থাকেন। তাদের কথাবার্তায় মনে হয় তারা মানবসেবাকেই জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছেন। আর এটাই তাদের একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান ও কর্ম। এমন বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকেই আবর্তিত হচ্ছে আমাদের দেশের প্রচলিত রাজনীতিসহ বৈশি^ক রাজনীতি। কোথাও এর তেমন কোন ব্যতিক্রম বা হেরফের নেই।

কবি-সাহিত্যিকরাও কিন্তু বিষয়টি নিয়ে নিরব থাকেন নি। কারণ, ফুলের জলসায় কবির নিরব থাকার সুযোগ নেই। তাই তারা মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জরা-ক্লেশ নিয়ে বেশ সরব সব সময়। এ কথার প্রমাণ মেলে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার কাব্য ভাবনায়। মূলত, তিনি ছিলেন মানবতাবাদী; স্বপ্নাচারী ও দার্শনিক কবি। কবি আগামী দিনের পৃথিবীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন; সাজােেত চাইতেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। তিনি প্রত্যেক শিশুর জন্য এ পৃথিবীতে ক্ষুধা, দারিদ্র, ক্লেশ ও জরামুক্ত বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু খুববেশী সময় পাননি তিনি বরং মাত্র ১৮ বছর বয়সে কৈশোরেই তাকে পৃথিবীতে বিদায় নিতে হয়েছে। তবে তার উত্তরসূরিরা সে কাজ এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বপ্নাচারী কবি-সাহিত্যিকরা এ পৃথিবীতে বসবাসযোগ্য করার জন্য তাদের বয়ান ও উপদেশ অব্যাহত রেখেছেন। মূলত, কবিরা সব সময়ই স্বপ্নচারী। তারা অবাস্তবকে স্বপ্নের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেন। এসব জ্ঞানী-গুণী ও বিদগ্ধজনরা আগামী নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই ভালোবাসেন। এ বিষয়ে মধ্যযুগের কবি শ্রী মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি তার লেখনির মাধ্যমে এক সুখী, সমৃদ্ধ ও স্বচ্ছন্দপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন। কবি তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঈশ^রী পাটুনীর মুখ থেকে অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে এক হৃদয়গ্রাহী প্রার্থনা পংক্তিমালার বয়ান দিয়েছেন। কবির ভাষায়, ‘করজোরে পাটুনী কহিছে জোর হাতে, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। কবি কঙ্কনের কবিতায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা মানুষের কল্যাণের জন্য যে আকুতি প্রকাশ পেয়েছে, তা আমাদেরকে মানবপ্রেম ও মহাত্মের কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কবি বডু চ-িদাসের কবিতায়ও এমন মানবপ্রেম ও মানবতার বাণী শোনা যায়। তিনি তার কবিতার মাধ্যমে মানুষের মহাত্মের জয়গানই করেছেন। তিনি তার চ-িমঙ্গল কাব্যে আমাদের মত আত্মভোলা মানুষকে আত্মসচেতন করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘শুনহে মানুষ ভাই; সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। যা মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমগ্র বিশ্ব যখন হিংসায় উন্মত্ত; বিবাদ-বিসংম্বাদ ও হানাহানী সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে, তখন এ বাংলার এক কবি বিশ্বকে শুনিয়ে ছিলেন মানবতার অমর বাণী। যা বিশে^র শান্তিপ্রিয় ও আত্মসচেতন মানুষকে বেশ আন্দোলিত করে; আমাদেরকে মানবতাবাদী এক নতুন বিশে^র সন্ধান দেয়।

কবি, লেখক, বাগ্মী, প-িত, দার্শনিকরা সাধারণত স্বপ্ন দেখেন এবং মানুষকে দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা তাদের হাতে থাকে না। এ জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকা এবং তা চর্চার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই বা থাকে না। ক্ষমতা থাকে রাজনীতিকদের হাতে। কিন্তু মানুষের সেবার ক্ষেত্রে তো রাজনীতিকরাও পিছিয়ে নেই বরং তারা এক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে আরো অনেক এগিয়ে। কারণ, তারা যেমন মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, তেমনি সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতাও সংরক্ষণ করেন। বস্তুত, মানবকল্যাণের ব্রতের বৃত্তেই সকল দেশ ও জাতির রাজনীতি আবর্তিত হয়। তাদের ধ্যান, জ্ঞান ও স্বপ্ন সবই মানুষের কল্যাণে। এভাবেই প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে বৈশি^ক রাজনীতি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, হাল আমলে প্রচলিত রাজনীতির রীতিমত কক্ষচ্যুতি হয়েছে। রাজনৈতিক স্লোগান ও মর্মকথাগুলো ঠিক আগের মতই আছে, কিন্তু একশ্রেণির রাজনীতিকের কারণেই রাজনীতি কল্যাণকামী চরিত্র হারিয়েছে। রাজনীতি এখন মানুষের কল্যাণকামীতা থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গিয়ে আত্মস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ, শ্রেণিস্বার্থ, সংকীর্ণ গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার অনুসঙ্গে পরিণত হয়েছে। রাজনীতির কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব চলে গেছে একশ্রেণির দালাল-ফরিয়াদের হাতে। ফলে প্রচলিত রাজনীতি এখন হারিয়েছে ইতিবাচক বৈশিষ্ট। তাই রাজনীতি এখন কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক পণ্য, শ্রেণি ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার অন্যতম অনুসঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছে।

আমাদের দেশের রাজনীতি অনেক আগে থেকে গতিপথ হারাতে শুরু করেছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তনের আশা করা হয়েছিলো, তা কিন্তু হয়নি বরং যে উদার গণতন্ত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিলো, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল দাবিদাররা অতিমাত্রায় ক্ষমতা প্রেমের কারণে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেই হত্যা করেছিলো। গণমাধ্যমের টুটি চেপে কালাকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়েছিলো। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিকমূল্যবোধ এবং স্বাধীন গণমাধ্যম ছিলো এদের শুধুই কন্ঠধ্বনি কিন্তু এসব আদর্শ তারা কখনো হৃদয়ঙ্গন করতে পারেনি বা করার চেষ্টা করেনি। সবকিছুর ওপর ক্ষমতায় স্থান পেয়েছিলো। এভাবেই শুরু হয়েছিলো দেশের রাজনীতির কক্ষচ্যুতি।

রাজনীতি কোন ব্যবসায়িক পণ্য নয় বরং সেবামূলক কাজ। গণমানুষের কল্যাণকামীতার ধারণা থেকে রাজনীতির পথচলা শুরু। আর রাজনীতিকরা প্রতিনিয়তই বলে থাকেন তারা নিজের জন্য নয় মানুষের কল্যাণ ও ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করেন। নির্বাচনের সময় তারা তো জনগণের মঙ্গলের জন্য প্রাণপাত করতেও কসুর করেন না। কিন্তু আমার ক্ষুদ্র জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় যা প্রত্যক্ষ করেছি বা এখনো করছি, তাহলো একশ্রেণির রাজনীতিকরা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করে নিয়েছেন বা এখনো সে বিষয়ে কসরত করে যাচ্ছেন। বারবার ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও জনগণের ভাগেই তেমন কিছুই ঘটেনি। এমন বাস্তবতায় আমার এক শিক্ষক মরহুম ময়েজ উদ্দীন অনেকটা খেদোক্তি করেই বলতেন, ‘ক্লাসে আমার পেছনের কাতারে বসতেন; অনেককেই পরীক্ষায় পাশও করতে পারতেন না, তারা রাজনীতি করে মন্ত্রী, যন্ত্রী, এমপি সহ প্রভূত অর্থ-বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে গেলেন। কথা ছিলো জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হওয়ার। কিন্তু আমার মত ময়েজরা কিন্তু ময়েজ থেকে গেলেন। তাদের ভাগ্যে আর কিছুই জুটলো না’। কথাগুলো সৈয়দ মজতুবা আলীর ‘প-িত মশাই’ গল্পের প-িত বাবুর আত্মগ্লানির কথায় স্মরণ করিয়ে দেয়। যা আমাদের দেশের প্রচলিত রাজনীতির সার-সংক্ষেপ বলা যায়।

আমাদের দেশের রাজনীতির যে কক্ষচ্যুতি ঘটেছে তা স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতির ঘটনা প্রবাহ থেকেই রীতিমত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৮২ সালে যখন বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা কেড়ে নেন, তখন সবে প্রাইমারী পেরিয়ে মাধ্যমিক স্কুলে পদার্পন করেছি। তখন রাজনীতি সম্পর্কে তেমন ভালো না বুঝলেও সে সময়ের কিছু স্মৃতি আজও আমার মানসপটে ভেসে ওঠে এবং ভীষণ পীড়া দেয়। আমার যতটুকু মনে পড়ে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের আত্মপক্ষ ছিলো দেশে দুর্র্নীতি একেবারে লাগামহীন হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রীর বাসা থেকে অপরাধী গ্রেফতারের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছিলো। যেহেতু তদানীন্তন সরকার দেশে সুশাসন বা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে, তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেই তিনি বন্দুকের নলের মুখে একজন জনপ্রিয় ও নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন স্বৈরাচারি এরশাদ। জনগণ তার চটকদার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে সামরিক সরকারকে স্বাগতই জানিয়েছিলো। কিন্তু তাদের আশাহত হতে খুব একটা সময় লাগেনি বরং জেনারেল এরশাদ ও তার সরকার পুরো জাতিকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন দুর্নীতি কত প্রকার ও কী কী? এমনকি গণতন্ত্রকে কীভাবে প্রসহনে পরিণত করা যায় তা প্রমাণে তিনিই প্রথম স্বার্থক হয়েছিলেন। জনগণের অধিকার হরণ ও ভোট চুরির যত প্রকার কলা-কৌশল সবই রপ্ত করেছিলেন ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে পতিত এ সরকার। তবে দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসনের পর এক অনিবার্য বাস্তবতায় এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিলো। ৯ বছরের ক্ষমতা ভোগের পর তিনি তার শাসনকাজে কৃতিত্বের(?) ফল ১০ বছর সাজা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অর্থ-বিত্তে, ভোগ-বিলাসে ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছিলো তার এবং তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি সহ দলীয় ‘খয়ের খাঁ’দের। কিন্তু দেশ থেকে দুর্নীতিও দূর হয়নি; কমেনি অপরাধ প্রবণতাও। নিজেরাই জড়িত হয়ে পড়েছিলেন নানাবিধ কেলেঙ্কারীরা। নাপাকি দিয়ে যেমন নাপাকি দূর করা যায় না, ঠিক তেমনি ঘটেছিলো আমাদের ভাগ্যেও। ফলশ্রুতিতে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি জনগণের বরং আমরা যে ‘ময়েজ’ ছিলাম সে ময়েজই রয়ে গেছি।

১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর আমাদের দেশের রাজনীতিতে নতুন করে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিলো। মনে করা হয়েছিলো কক্ষচ্যুত ও বিচ্যুত রাজনীতি নিজ কক্ষে ফিরবে। কিন্তু এক শ্রেণির রাজনীতিকের কারণেই আমাদেরকে হতাশ হতে হয়েছে। ১৯৯১ সালে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্মরণকালের অধিকতর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি অধিক সংখ্যক আসন লাভ করলেও সরকার গঠনের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় আসন ছিলো না। ফলে জামায়াতের সমর্থন নিয়েই তাদেরকে সরকার গঠন করতে হয়েছিলো। আশা করা হয়েছিলো যে, আমাদের রাজনীতি অতীতের বিভেদের নেতিবাচক বৃত্ত থেকে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরষ্পর আস্থা ও সৌহার্দ গড়ে ওঠবে। গড়ে উঠবে আদর্শ ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। কিন্তু অপরাজনীতির কারণে সে সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি বরং রাজনীতিকদের কাছে দেশ, জাতি ও মানুষের পরিবর্তে ক্ষমতাই মূখ্য হয়ে ওঠেছে। জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করার পর ১৯৯২ সালে দলটির তদানীন্তন মহাসচিব এবং পরবর্তীতে আমীর শহীদ মতিউর রহমান নিজামীকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সন্ত্রাসীরা নাজেহাল করে। কিন্তু বিএনপি সরকার এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের শীর্ষনেতা এসব চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সাথে বৈঠক করে প্রমাণ করেন তাদের কাছে আইনের শাসন ও মানবতা বড় কথা নয় বরং ক্ষমতাই তাদের কাছে মূখ্য।

এভাবেই জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠনের পর উভয় দলের মধ্যে নানা কারণে তিক্ততা সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার ইস্যুতে সে তিক্ততা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে। অথচ দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সে সময় জামায়াত-বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেশের চিত্রটা অন্তত আজকের মত হতো না বরং আমাদের জন্য নতুন এক সম্ভবনার সৃষ্টি হতো। কিন্তু দেশ ও জাতির কল্যাণ চিন্তার পরিবর্তে বিএনপির কাছে ক্ষমতাই প্রাধান্য পেয়েছিলো। ফলে ১৯৯০ গণঅভ্যুত্থানের সুফল আমরা ধরে রাখতে পারিনি। মহল বিশেষের ক্ষমতালিপ্সার কারণেই দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিলো।

জামায়াতকে আওয়ামী লীগ সব সময় জান-প্রাণের শত্রু বলেই মনে করে এসেছে। অথচ কোন রাজনৈতিক শক্তিকে একেবারে স্থায়ী প্রতিপক্ষ বানানো মোটেই কাক্সিক্ষত ও যৌক্তিক নয়। কিন্তু ক্ষমতান্ধ আওয়ামী লীগ সে কাজটি করেছিলো। তার খেসারতও তাদেরকে দিতে হচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতার মোহে মদমত্ত হয়ে তারা নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের দাবি আদায়ের জন্য জামায়াতের সাথেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেছিলো। সে আন্দোলনে তারা সফল ও ক্ষমতায় আসতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পরই জামায়াত তাদের কাছে অচ্ছুত-অপয়া হতে সময় লাগেনি। প্রয়োজন শেষে আবারো তাদের নামে রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধীসহ নানাবিধ তকমা লাগানো হয়েছে। এক্ষেত্রে বিএনপিও কোন ভাবেই পিছে থাকেনি। ২০০১ সালে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন, একসাথে সরকার গঠন, পরবর্তীতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম, ২০১৮ সালে একই প্রতীকে নির্বাচনের পরও জামায়াতের শরীর থেকে অচ্ছুত-অপয়ার দুর্গন্ধ মুছে যায়নি।

আমাদের দেশ সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ। তাই রাজনীতিতে ভিন্নমত ও মতভিন্নতা স্বাভাবিক। কারণ, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক কর্মসূচি ও আদর্শ সম্পূর্ণ আলাদা। সংবিধান অনুযায়ি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে রাজনৈতিক পক্ষগুলো স্ব স্ব রাজনৈতিক আদর্শ ও সংস্কৃতি প্রচার এবং তাদের অনুকূলে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চালাতে কোন দোষ নেই। এতে গঠনমূলক সমালোচনাও থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সমালোচনা করতে গিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে একেবারে জান-প্রাণ বা ব্যক্তিগত শত্রুতে পরিণত করা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেমনটি আমাদের দেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে লক্ষ্য করে দেখা যাচ্ছে।

জামায়াত-বিএনপির সখ্যতা নতুন কিছু নয় বরং দীর্ঘ দিনের। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে জামায়াত সহ ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও স্বাধীনতা পরবর্তী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্যই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তিনি হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি শিশু রাষ্ট্রে বিভেদের রাজনীতি কোনভাবেই কল্যাণকর নয়। সে ইতিবাচক চিন্তা থেকেই তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তার সুফলও পেয়েছিলো বিএনপি। বিএনপি যতবারই ক্ষমতায় এসেছে, ততবারই তাদেরকে জামায়াতের সমর্থনকে কাজে লাগাতে হয়েছে। এতে দেশ ও জাতিও উপকৃত হয়েছে। বিএনপি পেয়েছে ক্ষমতার উষ্ণ পরশ।

জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর আমাদের মধ্যে নতুন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু একশ্রেণির রাজনীতিকের ক্ষমতাকেন্দ্রীক অপরাজনীতির কারণে আমাদের সে অর্জনও রীতিমত ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াত-বিএনপি এখনো মুখোমুখি অবস্থানে। সংস্কার, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান হওয়া, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সহ বিভিন্ন ইস্যুতে জামায়াত অতীত মিত্রদের গঠনমূলক সমালোচনা করলেও ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে সাবেক মিত্ররা কোন রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ভব্যতার মানদ- রক্ষা করছে না বরং কখনো দেশে দক্ষিণ পন্থার উত্থান, জামায়াতকে ’৭১-এর পরাজিত শক্তি, রাজাকার-আল বদর, স্বাধীনতা বিরোধী সহ নিষিদ্ধ করারও জিগির তুলছে। অথচ জামায়াত ছিলো তাদের দীর্ঘদিনের জোট সঙ্গী। কিন্তু দেশের এ উদায়মান শক্তি যখন আগামী দিনের ক্ষমতার জন্য অন্যতম দাবিদার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, তখনই মহল বিশেষের নেতাদের মুখে খৈ ফুটতে শুরু করেছে।

একটি দলের কোন কোন নেতার অসংলগ্ন কথা-বার্তায় মনে হচ্ছে, তারা দেশ, জাতি, মাটি ও মানুষের পরিবর্তে নিজেদের ক্ষমতাকেই অধিকতর প্রাধান্য দিচ্ছেন। সম্প্রতি দলটির মহাসচিব ঠাকুরগাঁওয়ে এক বক্তৃতায় বলেছেন, তাদের দল ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সকল মামলা প্রত্যাহার করে নেবে। আবার কোন কোন নেতা তো শেখ হাসিনার বিচারপক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে দেশের মানুষ এ বার্তাই পাচ্ছেন যে, তারা নিজেদের ক্ষমতাকে নির্বিঘœ করার জন্য পতিত আওয়ামী লীগের সমর্থন আদায় করতে চাচ্ছে। তাই তারা এখন বুড়ো চ-িদাসের আপ্তবাক্যে আশ^স্ত থাকতে পারছেন না। তাই কিছুটা খেদোক্তি করে বাস্তবতার আলোকেই বলতে হচ্ছে, ‘সবার ওপরে ক্ষমতা সত্য তাহার ওপরে নাই’। আমরা আর কতদিন অবচেতন থাকবো?