সোহেল মো. ফখরুদ-দীন

আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র অধ্যাপক ড. আবদুল করিম। ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি শুধু আমাদের নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছে বাংলার ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁর গবেষণা, বিশ্লেষণ এবং লেখনী মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে দৃঢ়।

আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমি তাঁর স্নেহ, উৎসাহ এবং ভালোবাসা পেয়েছি। বিশেষভাবে, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র গঠনের পেছনে তাঁর দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ ছিল অতুলনীয়। তিনি সবসময়ই মনে করতেন, প্রান্তিক জনপদের ইতিহাস চর্চা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ইতিহাস সংরক্ষণে। আমাদের কেন্দ্রের বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করে তিনি শুধু ইতিহাস আলোচনা করতেন না, চট্টগ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্যকে নতুনভাবে উন্মোচিত করতেন।

আমাদের সভায় যখন জানানো হতো যে অধ্যাপক ড. আবদুল করিম স্যার উপস্থিত থাকবেন, তখন বিশেষভাবে অধ্যাপক ড. মঈনুদ্দিন আহমদ খান, অধ্যাপক ড. আব্দুর রশিদ, অধ্যক্ষ মো. হোসেন খান, অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু, আহমদ মমতাজ, মুহাম্মদ আশরাফ খান, বেগম রুনু সিদ্দিকী, ফাহমিদা আমীন, শামসুন নাহার রহমান পরানসহ বহু বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদ উপস্থিত থাকতেন। সভাগুলো সাধারণত অনুষ্ঠিত হতো আন্দরকিল্লা মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি অডিটোরিয়ামে। অডিটোরিয়ামের অবস্থান কিছুটা উঁচু হলেও, স্যারের আগমনের কথা শুনে সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসতেন এবং গভীর মনোযোগে তাঁর বক্তব্য শুনতেন।

আজকের দিনে সভা-সেমিনারে যখন কেউ বক্তব্য দেন, তখন অনেকেই মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকেনÑএটি এক দুর্ভাগ্যজনক সংস্কৃতি। অথচ স্যারের সময়ে এ ধরনের অশোভন আচরণ ছিল অকল্পনীয়। আমরা যেন সভ্যতার নামে অসভ্যতার দিকে না ধাবিত হইÑএমন আত্মসমালোচনাই এখন সময়ের দাবি।

অধ্যাপক ড. আবদুল করিম ছিলেন চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের উপদেষ্টা ও আমাদের অভিভাবক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরের অপেশাদার গবেষক ও লেখকদেরও তিনি আন্তরিকভাবে উৎসাহ দিতেন, যা তাঁর উদার চিন্তা ও একাডেমিক নেতৃত্বের পরিচায়ক।

তিনি ১৯২৮ সালের ১ জুন চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার চাপাছড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS) থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

তাঁর গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র ছিল মধ্যযুগীয় বাংলাÑবিশেষ করে সুলতানি ও মুঘল আমলের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ইতিহাস। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইতিহাস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং পরবর্তীকালে ‘প্রফেসর এমেরিটাস’ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: Social History of the Muslims in Bengal, Murshid Quli Khan and His Times, Corpus of the Muslim Coins of

Bengal, Banglar Itihas: Sultani Amal, Dhaka the Mughal Capital.

বাংলা, ইংরেজি, আরবি ও ফারসি ভাষায় দক্ষ অধ্যাপক করিম শতাধিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও বই রচনা করেছেন। ১৯৯৫ সালে তিনি ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এছাড়াও ভারতীয় নুমিজম্যাটিক সোসাইটি প্রদত্ত ‘অকবর সিলভার মেডেল’ এবং এশিয়াটিক সোসাইটি প্রদত্ত ‘প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল’-এ ভূষিত হন।

২০০৭ সালের ২৪ জুলাই তিনি চট্টগ্রাম নগরীতে ইন্তেকাল করেন এবং খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (রাহ.) মাজারসংলগ্ন কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন।

আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এই ইতিহাস সাধককে। তাঁর আলোকিত পথ অনুসরণ করেই আগামীর প্রজন্ম ইতিহাসকে জানবে, চিনবে এবং লিখবে নতুনভাবে।

লেখক : সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র