ড. মো. মুনিরুল ইসলাম

গণদাবি উপেক্ষা করে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের আয়োজনের ঘোষণা জাতির নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি। জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজন এক সংকটময় বিভ্রান্তির খসড়া এবং তা গণতন্ত্রের জন্য এক নতুন বিভ্রান্তির অধ্যায় হিসেবে সংযোজন হতে পারে। তখন এর দায় কি তারা নিবেন? দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অদ্ভুত উত্তাপ জমে উঠেছে। জনগণের দাবিকে উপেক্ষা করে বিশেষ কোনো দলকে সুবিধা দানের মানসে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের সরকারি ঘোষণা যেন সমাজের নানা স্তরে আলোচনার আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত যে জাতির নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নিÑতা স্পষ্ট। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুটি আলাদা ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে একত্রিত করা মানে জনমতের গুরুত্বকে দুর্বল করে দেওয়া। তাই অনেকেই বলছেন—এটা অনেকটা “এক টিকেটে দুই সিনেমা দেখার মতো”Ñযেখানে দুটোই দেখার আনন্দ কমে যায়, আর শেষে কোনোটার গল্পই মাথায় থাকে না। সমাজের সহজ-সরল ব্যাখ্যাই কখনো কখনো সবচেয়ে গভীর রাজনৈতিক মন্তব্য হয়ে ওঠে। “এক টিকেটে দুই সিনেমা”Ñউক্তিটি প্রথমে হাস্যরসের মতো শোনালেও এর পেছনে লুকিয়ে থাকা ব্যঞ্জনাটি খুবই গুরুতর।

নির্বাচন একটি জাতির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অনিবার্য প্রক্রিয়া। অন্যদিকে গণভোট কোনো নির্দিষ্ট জাতীয় ইস্যুতে জনগণের প্রত্যক্ষ রায়ের বহিঃপ্রকাশ। দু’টি প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য, কাঠামো, প্রচারণার ধরন-সবই ভিন্ন। সেগুলোকে একই দিনে সংঘটিত করা মানে এক ধরনের প্রশাসনিক শর্টকাট নেওয়া, যার ফলাফল সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। জনগণের ভেতরে তাই প্রশ্ন-এত তাড়াহুড়ো কেন? কেনই বা এতো দ্রুততা? এ অন্যায্য দ্রুততার নির্বাচন কি নিজের গুরুত্বটুকু ধরে রাখতে পারবে? গণভোট কি নিজের প্রয়োজনীয় ভাবমর্যাদা অর্জন করতে পারবে? ইতোমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেছেন, “একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

তিনি আরো বলেন, এমন পরিস্থিতিতে আগের কোনো নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে হয়নি। অন্য একজন নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেছেন- ‘‘বাড়তি অর্থ অপচয় না করে একদিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করা সমীচীন। এক সাথে সংসদ ও গণভোট আয়োজন করতে সক্ষম নির্বাচন কমিশন।” নির্বাচনের দিনে কমিশনের অভিক্ষিপ্ত সক্ষমতা (Projected capacity) যদি ফেইল করে তাহলে আন্দাজ করা যায় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ভিন্ন ধরণের উত্তাপ ছড়াবে যা অতীতে কখনো ছড়ায়নি। সে উত্তাপ আমাদের সকলের গায়েই লাগবে, বিশেষ করে সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং যাদের জন্য ঐ অনুরোধের আসর বসানো হবে তারা হয়ত আগুনের ফুলকিতে অঙ্গার হয়ে যাবেন! এজন্য আবেগ পরিহার করে দূরদৃষ্টির আলোকে সিদ্ধান্তই নেয়া দরকার। অর্থ অপচয় না করে সাশ্রয়ী হওয়ার থিওরী তখন কোনো কাজে আসবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।

যে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন কেন্দ্রীভূত বিতর্ক, দলীয় কর্মসূচি, নীতি বিশ্লেষণ এবং প্রার্থীদের ভাবমর্যাদা পর্যালোচনার সুযোগ। অপরদিকে গণভোটে দরকার নির্দিষ্ট প্রশ্ন নিয়ে গভীর আলোচনার পরিবেশ। কিন্তু একই দিনে দুটি বিশাল প্রক্রিয়া চালাতে গেলে ভোটারদের মনোযোগ বিভক্ত হওয়া স্বাভাবিক। নির্বাচনের ব্যালটে প্রার্থী বাছাই; আর গণভোটে একটি জাতীয় প্রশ্নে হ্যাঁ-না-এ দু’সিদ্ধান্ত একই দিনে নেওয়া ভোটারদের ওপর একপ্রকার মানসিক চাপও তৈরি করতে পারে। ফলে যে সিদ্ধান্তগুলো গভীর চিন্তার দাবি করে, তা তাড়াহুড়োর রায়ে ভিন্ন কিছু প্রতিফলিত হতে পারে, যা জাতি সত্ত্বার জন্য এমন নতুন ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে যার উপশম হওয়া সময় সাপেক্ষ। তাছাড়া নির্বাচন ও গণভোট-উভয় ক্ষেত্রেই ব্যালট ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, গণনা, পর্যবেক্ষণ প্রভৃতি কাজে ব্যাপক আয়োজন প্রয়োজন হবে। দু’টি প্রক্রিয়া একদিনে করলে ব্যবস্থাপনার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে। এতে ভুল, অনিয়ম বা বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এগুলো গণতান্ত্রিক বিশ্বাস যোগ্যতাকে আঘাত করে। জাতি এমনিতেই নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতায় ভুগছে। তার ওপর আবার গণভোটের মতো স্পর্শকাতর সাংবিধানিক প্রশ্নকে একই দিনে জুড়ে দিলে সন্দেহ আরও গভীর হয়।

সাশ্রয়ী হওয়ার থিওরী যে ভাষাতে যতই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি বেশ সহজভাবে ধরা পড়ে, তাহলো- দু’টি বড় সিদ্ধান্ত একই দিনে নিলেÑদুটোরই গুরুত্ব কমে যায়।

নির্বাচন ও গণভোটের মতো জাতির ভবিষ্যত নির্ধারণকারী সিদ্ধান্তগুলো এমন হালকাভাবে নেওয়া যায় না। গণদাবি যদি সত্যিই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হয়, তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত জনগণের বার্তাকে গুরুত্ব দেওয়া। নির্বাচনের আলাদা মর্যাদা, গণভোটের আলাদা প্রয়োজনÑদুটিই রক্ষা করতে হবে। এগুলোকে একই দিনে গুঁজে দেওয়া কোনো যুক্তি নয়, বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অশ্রদ্ধা। দেশ আজ আরও বেশি স্বচ্ছতা, আরও বেশি জবাবদিহি, আরও বেশি আস্থার রাজনীতি চাইছে। দু’টি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে একই দিনে আয়োজন করে সেই সংকট দূর হবে না-বরং নতুন বিভ্রান্তি, নতুন অবিশ্বাস সৃষ্টি হবে।

নির্বাচন ও গণভোট-উভয়ক্ষেত্রেই দরকার নিখুঁত ব্যবস্থাপনা। ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্স, ভোটকেন্দ্র প্রস্তুতি, নিরাপত্তা, গণনা, পর্যবেক্ষণ-সবকিছুই একটি বিশাল প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এখন কল্পনা করুন- একই দিনে দু’ধরনের ব্যালট, দুই ধরনের গণনা, দু’ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, দু’ধরনের পর্যবেক্ষণ। এটি শুধু চাপ বাড়ায় না; বরং ভুল, বিভ্রান্তি ও অনিয়মের সম্ভাবনাও দ্বিগুণ করে। বহু পর্যবেক্ষক আশঙ্কা করছেন, গণভোটের ব্যালট নির্বাচন ফলাফলের আড়ালে চাপা পড়ে যাবে, অথবা নির্বাচন সংক্রান্ত বিশৃঙ্খলা গণভোটের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। অথচ গণভোটের মতো একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া কোনোভাবেই “সাইড শো” হতে পারে না।-

উপরের আলোচনা হতে এ উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট দুটি ভিন্ন উদ্দেশ্য, ভিন্ন কাঠামো ও ভিন্ন গণতান্ত্রিক তাৎপর্যের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। সেগুলোকে প্রশাসনিক সুবিধা, ব্যয়ের যুক্তি বা রাজনৈতিক কৌশলের পরিখায় ফেলে একই দিনে আয়োজনের সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতি এক ধরনের অবহেলা হিসেবেই প্রতিভাত হয়। জনগণের মতামত জানার প্রক্রিয়াকে যতটা স্বচ্ছ, গুরুগম্ভীর এবং বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালনার প্রয়োজন, একই দিনে দু’ধরনের ভোটগ্রহণ সে মানদণ্ডকে দুর্বল করে। এতে ভোটারের মানসিক চাপ বাড়ার পাশাপাশি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ফলত যে প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার কথা, সেখানে নতুন বিভ্রান্তি, অবিশ্বাস ও অস্থিরতার সম্ভাবনা জন্ম নেয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যই হলো-প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত তার নিজস্ব মর্যাদা ও গুরুত্ব নিয়ে আলাদা আলোচনার সুযোগ পায়। নির্বাচন ও গণভোটকে একসঙ্গে আবদ্ধ করা তাই কেবল গণদাবির প্রতি উদাসীনতা নয়; বরং গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার ওপর প্রশ্ন তোলে। রাষ্ট্র পরিচালনার দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে প্রয়োজন দূরদৃষ্টি, পরিমিতি ও জনমতের প্রতি স্পষ্ট শ্রদ্ধা-শর্টকাট নয়।

লেখক : চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক।