একথা অনস্বীকার্য যে, মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তন ঘটছে। এক সময় যা মানুষের কাছে অসাধ্য মনে হতো, তা এখন অনেক ক্ষেত্রেই হাতের মুঠোয়। যদিও এখন পর্যন্ত অনেক কিছুই মানুষ করায়ত্ব করতে পারেনি। তবে সভ্যতার এমন ক্রমবিবর্তন চলমানই রয়েছে এবং আগামী দিনে তা অব্যাহত থাকবে। তবে সভ্যতা যে সকল ক্ষেত্রে কল্যাণ বয়ে আনছে এমন নয় বরং কোন কোন ক্ষেত্রে এর অকল্যাণও বেশ দৃশ্যমান। যা মানবসভ্যতাকে কিছুটা হলেও সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
রোমান সাম্রাজ্য বৃহত সভ্যতার একটি উদাহরণ। এটি রোম নগরী থেকে সরকারিভাবে পরিচালিত হতো। এ সাম্রাজ্য এককালে স্কটল্যান্ডের সীমান্ত থেকে উত্তর আফ্রিকা ও উত্তর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাদের নিজস্ব ভাষা ছিল ল্যাটিন। রোমান সভ্যতা মোট ১ হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। কিন্তু প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা টিকে ছিল বেশি দিন। রোমান এবং মিসরীয়গণ অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এতে রোমানরা জয়ী হওয়ায় মিসর রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
মূলত, সংগঠিতভাবে বসবাসের ক্রমোন্নত স্তরই সভ্যতা (Civilization)। অধিকাংশ সভ্যতারই নিজস্ব কৃষিব্যবস্থা এবং রাজতন্ত্র বা নির্বাচন ব্যবস্থার ন্যায় সরকারপদ্ধতি ছিল বা রয়েছে। প্রত্যেকটি সভ্যতারই নিজস্ব ভাষা, নির্দিষ্ট ধর্ম ও শিক্ষাব্যবস্থাও থাকতে পারে। সুমেরীয় ও মিসরীয় থেকে শুরু করে সকল সভ্যতারই নিজস্ব লিখন পদ্ধতি ছিল। এ লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে তারা তাদের জ্ঞান সংকলন ও সংরক্ষণ করত। আর এভাবেই প্রত্যেকটি সভ্যতার বিবর্তন ঘটেছে।
সভ্যতা নগরায়ন, সামাজিক স্তরবিন্যাস, যোগাযোগ প্রণালী, স্বতন্ত্র পরিচয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নিয়ন্ত্রণের গুণাবলী দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। সভ্যতায় ক্রমবিবর্তনমূলক জীবনপ্রণালী এবং রাজতন্ত্র বা নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত সরকার পদ্ধতি; ভাষা, ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতিও ক্রিয়াশীল। সুমেরীয় ও মিশরীয় থেকে শুরু করে বিশ্বের সকল সভ্যতারই নিজস্ব লিখন পদ্ধতি ছিল। এ লিখন পদ্ধতির মাধ্যমেই জ্ঞানের আহরণ, সংকলন ও সংরক্ষণ করা হতো। আর এসবই হচ্ছে সভ্যতার শেকড়; ভিত্তিমূল।
সাধারণভাবে কোন জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ও জ্ঞানই হচ্ছে সংস্কৃতি। ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার-আচরণ, সঙ্গীত, চিত্রকলা ও শিল্পকলাও সংস্কৃতির অন্তর্ভূক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ অন ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন’ সংস্কৃতির একটি অতিচমকপ্রদ সংজ্ঞা দিয়েছে। সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘সামাজিক আচরণ, মিথষ্ক্রিয়ার ধরন, জ্ঞানীয় গঠন এবং সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে যে উপলব্ধি অর্জিত হয় তা-ই সংস্কৃতি’।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে একটা অলিখিত সখ্যতাও রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের মতে, ‘আমরা যা করি তাই আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের যা আছে তাই আমাদের সভ্যতা’। মূলত, সংস্কৃতি হলো মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রণালী এবং সভ্যতা হলো সে জীবন প্রণালীর বাহ্যিক রূপ। আর সভ্যতা বিকাশের পূর্বশর্ত হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির জন্ম ও টিকে থাকার মাধ্যমে একটি সভ্যতা পূর্ণতা লাভ করে এবং বিকশিত হয়।........’।
মানবজীবনের ক্রমবিবর্তন যখন ইতিবাচক ধারায় সূচিত হয় তখনই তা সভ্যতা হয়ে ওঠে। এর বিপরীত দিকটাই হচ্ছে সভ্যতার সঙ্কট। যার বাস্তব প্রমাণ সাম্প্রতিক বিশ্ব। কারণ, ইদানিং যাদেরকে সভ্যতার প্রতিভূ বলে মনে করা হয় তারাই এখন এর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে মানবসভ্যতা স্বকীয়তা হারাতে বসেছে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও পৃথিবীর সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রগতিশীলতা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য বা আন্তরিকতা দেখাতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপান জি-সেভেন নামে যা করছে তা মানবসভ্যতাকে রীতিমত হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছে। ন্যাটো বাহিনী ব্যবহৃত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের গণহত্যা ও আগ্রাসী যুদ্ধের কাজে। ফিলিস্তিনে আগ্রাসনে জায়নবাদী ইসরাইলকে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রগুলোও উন্নত বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে ইতিবাচক নয় বরং অনাকাঙ্খিত লেজুরবৃত্তির বৃত্তেই আটকা পড়েছে। সমাজপতি, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, বৈজ্ঞানিক ও চিন্তাবিদরা এক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছেন না।
এসব প্রবণতা থেকে আমরাও মুক্ত নই বরং ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। আমাদের রাষ্ট্রাচারের ক্রমবিবর্তন ইতিবাচক হিসাবে প্রচার পেলেও সার্বিক পরিস্থিতি মোটেই ইতিবাচক নয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি সর্বোপরি জাতীয় জীবনে। ফলে আমাদের ‘সংস্কৃতি’ এখন ‘অপসংস্কৃতি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। নিকট অতীতে রাজনৈতিক বিরোধ ও সমস্যার রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে সমাধান করা হয়নি বরং শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত সংস্কৃতি এবং নানা অপবিশেষণের ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মোকাবেলা করার অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে সভ্যতা, ভব্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের তোয়াক্কা করা হয়নি। মূলত, মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অনুপস্থিতির কারণেই আমাদের দেশে ধর্ষণের সংস্কৃতি, হত্যা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের সংস্কৃতি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংস্কৃতি, সিন্ডিকেট সংস্কৃতি, জুলুম-জবরদস্তির সংস্কৃতি, মিথ্যাচারের সংস্কৃতি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সংস্কৃতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ঘুষ-দুর্নীতির সংস্কৃতি, ভোট চুরির সংস্কৃতি, মূল্যস্ফীতির সংস্কৃতি, পেশিশক্তি প্রদর্শনের সংস্কৃতি, স্বেচ্ছাচারিতার সংস্কৃতি এবং নারী নির্যাতনের সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। ফলে স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো অনেকটাই অধরাই রয়ে গেছে।
মূলত, সভ্যতার ক্রমবিকাশ এমন সব কাজের মধ্য দিয়ে হয়, যেগুলো ইতর প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। যেমন আগুন ও পানির ব্যবহার। মানুষ জলবায়ু ও প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে সফলতা দেখিয়েছে। মানুষ পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাষ্ট্র গঠন করে। তারা বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্রের আছে প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা। মানুষের আছে প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য; সর্বোপরি রাজনীতি ও অর্থনীতি। এসবেরই মধ্যে আছে নৈতিক চেতনা, ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত ও ন্যায়-অন্যায়ের উপলব্ধি। মানুষের বিবেক আছে। বিবেক আর সত্য, ন্যায় ও সুন্দর হলো সভ্যতার মর্মগত অবলম্বন। কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব ও মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয়ের কারণে এসব ক্ষেত্রে আমাদের বিচ্যুতি রীতিমত উদ্বেগজনক পর্যায়েই পৌঁছেছে।
সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সূচনা মানুষের হাত ধরে হলেও তা কলঙ্কিত হচ্ছে আবার মানুষের অপকর্মের মাধ্যমেই। সে ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সারাবিশ্বেই অনাকাক্সিক্ষতভাবে যুদ্ধবিগ্রহ বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্বব্যবস্থার কল্যাণকামীতারও ঘটেছে বড় ধরনের বিচ্যুতি। আগুন-পানি ও প্রকৃতির ব্যবহার, বৃহত শক্তিগুলো এমনভাবে করে চলছে যে প্রকৃতি মানুষের প্রতিকূল হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন শুধু ক্রমবর্ধমানই নয় বরং তা এখন উদ্বেগজনক পর্যায়েই পৌঁছেছে। সমুদ্রে পানির উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর স্থলভাগের এক-তৃতীংয়াশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিচ্যুতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। কায়েমি স্বার্থে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক বৈশিষ্টগুলো নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের অপব্যবহার বর্বরতা ও ধ্বংসের পালেই হাওয়া দিচ্ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি ব্যবহৃত হচ্ছে শ্রেণি, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি স্বার্থে। সাধারণ মানুষ সব রকম অন্যায়-অবিচার, জুলুম-জবরদস্তি ও মিথ্যাচারকে মেনে নিয়েছে বা নিতে বাধ্য হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই সমাজ-রাষ্ট্রে যারা কর্তৃত্ব করছে তারা অন্ধকারের শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে।
প্রত্যেক জাতির ইতিহাস এক ও অভিন্নও নয়। তবে কিছু বিষয়ে সব জাতির মধ্যে মিলও রয়েছে। তাই সভ্যতার সঙ্কট মোকাবেলায় বহুজাতিক ঐক্যের আবশ্যকতার বিষয়টিও অনস্বীকার্য। তবে সেক্ষেত্রে কোনো জাতিরই নিজস্ব সঙ্কটকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই বা আন্তর্জাতিক কোনো শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকাও উচিত নয়। সেক্ষেত্রে নিজ নিজ সমস্যা নিজ উদ্যোগেই সমাধান করে নেয়া উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় যে অবস্থা চলছে তাতে বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী শক্তিগুলোকে দেখা যাচ্ছে বৈশ্বিক সরকারের ভূমিকা পালন করছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাও প্রশ্নাতীত থাকেনি। চীন ও রাশিয়া কখনো কখনো ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইতিবাচক কিছু করার চেষ্টা করছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।
সভ্যতার সঙ্কট ও বৈশ্বিক রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে আমরাও মুক্ত নই। নিকট অতীতেই আমাদের দেশে চলেছে বিরাজনীতিকরণ ও বিরাষ্ট্রকরণের কার্যক্রম। দেশকে কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা থেকে আমরা যোজন যোজন দুরেই অবস্থান করেছি। রাজনৈতিক শক্তিগুলো রাজনীতিকে করে ফেলেছিলো বৃহত শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস অভিমুখী, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্ক অভিমুখী। বিচারব্যবস্থার বিচ্যুতিও জনদুর্ভোগের কারণ হওয়ার অভিযোগও ছিলো বেশ জোরালো। গণপ্রশাসন ঘুষ-দুর্নীতি ও লাগামহীন স্বেচ্ছাচারে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে বসেছিলো। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এসব কথা সংবিধানে লেখা ছিলো ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলনটা খুবই গৌণ। কিন্তু আমাদের চরম ব্যর্থতা যে, রাজনৈতিক শক্তিগুলো এসব সমস্যার সমাধান করতে পারেনি বরং জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে এসব অপচর্চার সাময়িক অবসান হয়েছে। আর এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলো আমাদের নতুন প্রজন্ম। আশা করা হয়েছিলো যে, জুলাই চেতনাকে ভিত্তি ধরে আমাদের দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু নেতিবাচক ও স্বার্থান্ধ রাজনীতির কারণেই আমাদের জুলাই বিপ্লবের অর্জন হাতছাড়া হতে বসেছে। রাজনৈতিক অনৈক্য আবার নতুন করে মাথাচাঁড়া দিতে শুরু করেছে।
মূলত, মূল্যবোধহীন ধর্মবিবর্জিত সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতিই মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিশ্বে যতগুলো ফলপ্রসূ সভ্যতা ও বিপ্লব এসেছে তার সবই আদর্শ ও মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরেই। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, অষ্টাদশ শতকে ফরাসিদের মধ্যে যে দু’টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যেত, তা হলোÑমূল্যবোধ ও ন্যায্যতা। ফলে তারা একটি সফল ও সার্থক বিপ্লব সাধনে সমর্থ হয়েছিল। সমসাময়িককালে ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা ফরাসিদের সাথে তুলনীয় না হলেও সে সময় ভারতবর্ষে যে মূল্যবোধের চর্চা ছিল না, তা বলা যাবে না। তবে এক রূঢ় বাস্তবতায় মূল্যবোধ ও নায্যতার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থা একেবারে প্রান্তিকতায় এসে ঠেকেছে। যা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যকেই দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বস্তুত, মূল্যবোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাগ্রত হয় না বরং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে এ জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যকতা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রই নাগরিকের সবকিছুই দেখভাল করে, তাই মূল্যবোধের লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। তাই নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের প্রথম কর্তব্য হবে নৈতিকশিক্ষা, মূলবোধের চর্চা ও সুস্থ্যধারার সংস্কৃতি উৎসাহিত করে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। তাহলেই সভ্যতার উৎকর্ষতাকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের চর্চার সাথে রাজনীতির নিবিরতম সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, রাজনীতির পরিসর খুবই বৃহত। রাজনীতি দেশ ও জনগণের আমূল কল্যাণের জন্য আবর্তিত হয়। এতে মূল্যবোধ আর ন্যায্যতার ভিত্তি মজবুত না থাকলে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই হয় বেশি। রাজনীতিকদের যদি মূল্যবোধের স্তর নিম্নমানের হয় তবে তা আর রাজনীতি থাকে না বরং অপরাজনীতি হিসেবে আখ্যা পায়। এর কুপ্রভাবে হাজারো মূল্যবোধ নষ্ট হয়। ব্যক্তির মূল্যবোধ নষ্ট হলে ক্ষতি শুধু একজনের কিন্তু শাসক শ্রেণির মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
মূলত, সভ্যতার সঙ্কট, সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মবিমুখতা, ধর্মের অপব্যবহার ও ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা, ক্ষমতালিপ্সা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের মতো আরো কিছু বিষয়। ধর্মের যথাযথ চর্চা ও অনুশীলন কখনোই ধর্মান্ধতা শেখায় না বরং ধর্মীয় আদর্শের মাধ্যমেই ধর্মান্ধতার অভিশাপ মুক্ত হওয়া সম্ভব। ধর্মই মানুষের জীবনপ্রণালী অন্যান্য ইতর প্রাণী থেকে আলাদা করেছে; মানুষকে সভ্য, সংবেদনশীল ও পরিশীলিত করেছে। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে আমরা ধর্মকে মনে করি এগিয়ে চলার পথের প্রধান অন্তরায়। কিন্তু বাস্তবতা সে ধারণার অনুকূলে কথা বলে না।
মূলত প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটি ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে গড়ে উঠেছে। তাই একটি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গঠন ও অবক্ষয়হীন সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে নাগরিকদের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি, ধর্মীয় আদর্শের সম্প্রসারণ, মূল্যবোধের লালন ও অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। মনীষী সাইয়্যেদ কুতুবের ভাষায়, ‘যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে সে সমাজই সভ্য সমাজ’। মূলত, মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে মানবসভ্যতাকে গতিশীল ও সুস্থ্য ধারার সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব। আর জুলাই বিপ্লব আমাদেরকে নুতন করে সে সুযোগ এনে দিয়েছে। তাই সে বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ এবং দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বোধ-বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতিকে লালন করেই আমাদের আগামী দিনের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় আমাদের গন্তব্য হয়ে পড়বে অনিশ্চিত।
www.syedmasud.com