মানুষ একা বসবাস করে না। মানবসত্ত্বা একাকি বসবাসের উপযোগী নয়। মানুষের শরীর, মন ও আত্মার রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্য মানুষকে সমাজ পরিবেশে বসবাসে উদ্বুদ্ধ করে। সমাজ-পরিবেশে মানুষ তার সত্ত্বার পূর্ণ বিকাশ চায়। ফলে গঠিত হয়েছে রাষ্ট্র। মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব বর্তায় রাষ্ট্রের ওপর। এ কারণে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক দর্শন জনগণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব বিষয়ে জনগণ কথা বলে, সংগঠন করে, সংগ্রাম করে। মানুষ যে কাজই করুক না কেন, তার একটি পরিবেশ থাকে, প্রতিবেশ থাকে। পবিশে সব সময়ই মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, মানুষও গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশের জন্য। এ বিষয়টিকে আন্তরিকভাবে স্বীকার করে নিতে হবে আমাদের। এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে সংকটের মাত্রাই শুধু বাড়বে। আমরা যখন পরিবেশের কথা বলি, তখন প্রতিবেশীর কথাও আমাদের ভাবতে হবে। ব্যক্তির যেমন প্রতিবেশী ব্যক্তি আছে, তেমনি রাষ্ট্রেরও আছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র। প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে সম্মান করলে, সুখ-দুঃখে সহযোগিতার হাত বাড়ালে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিবেশ উজ্জ্বল ও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় এ ক্ষেত্রে নানা সংকট তৈরি হয়ে গেছে। তবে এ কথা অনেকেই স্বীকার করেন যে, প্রতিবেশীর সাথে প্রতিবেশীর সম্পর্ক নৈতিক চেতনায় ইতিবাচকভাবে গড়ে না উঠলে কাক্সিক্ষত মানবিক সমাজ ও বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে না। নৈতিক উপলব্ধির বাইরে গিয়ে চাতুর্য ও শক্তির ক্যামেস্ট্রি মানবজাতিকে এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। এজন্যই কি মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়েছে? এ প্রশ্নকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। নৈতিক মান ও মেরুদণ্ডহীন বিশ্বনেতারা বর্তমান পৃথিবীকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে? আস্থাহীনতার বর্তমান সভ্যতায় কূটনীতির আড়ালে তাদের সবাই এখন ব্যস্ত মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতায়। অনাকাক্সিক্ষত এই প্রতিযোগিতা থামাতে পারে মানুষের নৈতিক বিবেচনাবোধ। নৈতিক বিবেচনাবোধ অবয়বের মানুষকে উন্নত মানুষে পরিণত করতে পারে। এমন মানুষ প্রতিবেশী হলে সমাজ সুন্দর হয়, এমন মানুষ রাষ্ট্রনেতা হলে আঞ্চলিক বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

বাংলাদেশের মানুষ এক বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। কালান্তরের এমন সময়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রয়োজন মানবিক ও যৌক্তিক পরিবেশ। প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকেও প্রয়োজন মানবিক ও যৌক্তিক আচরণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান বাস্তবতায় তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সবাই অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে চায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র তো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিকাশে সহযোগিতা করার কথা। কিন্তু এখন স্বার্থ আদায়টাই বড় হয়ে উঠেছে। ক্ষতি করে হলেও। অথচ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক মর্যাদা ও সমঝোতার ভিত্তিতে উপকৃত হতে পারে। আদান-প্রদান ও ব্যবসা-বাণিজ্য এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। কিন্তু ইতিবাচক এ পথে না গিয়ে প্রতিবেশী বড় রাষ্ট্র ছোট রাষ্ট্রের রাজনীতিতে নাক গলিয়ে একতরফা সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। তাদের আগ্রাসী নীতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রনেতাকে গোলাম বানিয়ে ফ্যাসিস্ট হতে অনুপ্রাণিত করে থাকে। এমন নীতি কি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনীতি কিংবা পররাষ্ট্রনীতি হতে পারে? স্বাধীন-সার্বভৌম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা এখন কি আর কোনো অপরাধ নয়?

আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ দেশ ভারত। অন্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর প্রভাব রাখতে চায় দেশটি। অনেকে বিষয়টিকে ‘দাদাগিরি’ হিসেবে অভিহিত করতে চান। এ ক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো কূটনীতির ভাষাতেই কথা বলবেন। তবে তারা প্রতিবেশী দেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবেন, গতি-প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য রাখেন এবং কোমলে-কঠিনে কথা বলেন। গত ২৩ মার্চ শনিবার ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাথে কথা বলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ভারতীয় সংসদ মাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’র খবরে বলা হয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ‘খোলামেলা’ আলোচনা হয় সেখানে। বৈঠকে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান প্রাধান্য পায়। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। শেখ হাসিনা পালিয়ে গিয়ে এখন ভারতে অবস্থান করছেন। বিষয়টি বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের পছন্দ নয়। হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হাসিনাকে বিচারের জন্য ফেরত চেয়েছে বাংলাদেশ। এ আহ্বানে সাড়া দেয়নি ভারত। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার যে মহাঅভ্যুত্থান, তা পছন্দ হয়নি ভারতের বিজেপি সরকারের। তারা যুগের পর যুগ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে। পাপেট হাসিনার মাধ্যমেই যে তাদের সব স্বার্থ উদ্ধার হয়। হাসিনা যেভাবেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। দিনের ভোট রাতে হলেও আপত্তি নেই। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে হলেও শেখ হাসিনাকে মসনদে রাখা চাই। এমনটাই হলো মোদি সরকারের তথাকতিথ গণতান্ত্রিক চেতনা।

এমন যখন অবস্থা, তখন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পতনকে ভারত সরকার মেনে নেবে কেমন করে? আর অবিশ্বাস্য এ ঘটনায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি বিস্মিতও হয়েছে বৈকি। হাসিনাকে রক্ষায় ব্যর্থতা ভারতের অহংকারেও আঘাত লেগেছে। বিষয়টি হজম করা আসলেই কঠিন। ফলে গত শনিবার পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের কথা জানলেও তার ওপর ‘পর্যাপ্ত প্রভাব’ না থাকায় এ বিষয়ে ভারত কোনো ‘হস্তক্ষেপ’ করতে পারেনি। এখানে ‘পর্যাপ্ত প্রভাব’ এবং ‘হস্তক্ষেপ’-এর তাৎপর্য কী? বিষয়টির ব্যাখ্যায় যাওয়াটা বোধ হয় কারো জন্যই তেমন সুখকর হবে না। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ছাড়াও কংগ্রেসের কেসি বেনুগোপাল, মনীশ তিওয়ারি, উদ্ধবসেনার প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী উপস্থিতি ছলেন।

খবরে বলা হয়, জয়শঙ্কর কমিটির কাছে দাবি করেন, হাসিনার কোনো সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার মতো প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ছিল না দিল্লির। তাকে কেবল ‘পরামর্শ দেওয়া’ যেতে পারতো। বৈঠকে সদস্যরা ভাতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন করেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অসন্তোষের বিষয়ে সরকার কিছু জানতো কিনা? এর জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, ভারত সরকার এ বিষয়ে যথাযথ তথ্য দিয়েছিল কিন্তু শেখ হাসিনা তা অবজ্ঞা করেছেন। উপলব্ধি করা যায় যে, ওই বৈঠকের সবকথা ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি, আর তা প্রকাশিত হওয়ার কথাও নয়। ভারতীয় কর্তপক্ষ যতটুকু প্রকাশিত হওয়া সমীচীন মনে করেছে ততটুকুই প্রকাশিত হয়েছে। তবে এর মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও সার্বভৌম চেতনার প্রতি ভারত সরকারের কোনো শ্রদ্ধা নেই। তাদের শুধু একজন হাসিনা প্রয়োজন। একজন ফ্যাসিস্ট শাসকের জুলুম-নির্যাতন, খুন-গুম, দুর্নীতি, ব্যাংকলুট, ভোটারবিহীন নির্বাচন, কোনো কিছুই ভারত সরকারের কাছে অপরাধ বলে গণ্য হয়নি। হাসিনা সরকারকে তারা তাদের স্বার্থের বরকন্দাজ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এর বাইরে ভাবার মতো কোনো নৈতিক চেতনা মোদি সরকারের ছিল না। প্রতিবেশী যদি এমন হয়, তাহলে তো আর কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয় না।

লেখার শুরুতে পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং প্রতিবেশীর গুরুত্বের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। শেষে এসে বলতে হচ্ছে, কাক্সিক্ষত প্রকৃতির ও মানবিক পরিবেশ থেকেই আমরা শুধু বঞ্চিত নই, বঞ্চিত কাক্সিক্ষত প্রতিবেশী থেকেও। এমন বাস্তবতায় বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা, ভূরাজনীতি ও মারণাস্ত্র প্রতিযাগিতা দিয়ে আমরা কী করবো? প্রশ্ন জাগেÑমানুষ কখন মানুষ হবে? প্রতিবেশী কখন সুপ্রতিবেশী হবে? এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কোনো নৈতিক ভিত্তি আছে কি বর্তমান সভ্যতায়?