আমেরিকার নিউ ইয়র্কে মেয়র নির্বাচনে অবশেষে বিজয় ছিনিয়ে আনলেন মুসলিম প্রার্থী জোহরান মামদানি। নানা সূত্র থেকে কয়েক মাস ধরেই আগাম জানা জাচ্ছিল তার বিজয়ের সম্ভাবনার খবর। মঙ্গলবারের ভোটে তা সত্যি প্রমাণ হলো। আগাম ভোট শুরু হয়েছিল আগেই। ৪ নভেম্বর মঙ্গলবার মূল ভোটগ্রহণ হয়। নির্বাচনে বিভিন্ন জরিপে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোহরান মামদানি এগিয়ে ছিলেন। এ অবস্থায় মামদানির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি মামদানিকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। নানাভাবে নানা ছলে তাকে ঘায়েল করার কোন চেষ্টাই বাকি রাখেননি ট্রাম্প। তবে তা কাজে আসেনি।
মামদানি গাজা যুদ্ধের সময় ইসরাইলের নীতির সমালোচনা করেছেন এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এটা তাকে অনেকখানি এগিয়ে দেয় ভোটের হিসেবে। আমেরিকাতেও গাজার সমর্থনে অনেক বড় বড় বিক্ষোভ হয়েছে। তারা মামদানিকে সমর্থন যুগিয়েছেন। আর তার দল তো পেছনে ছিলই।
গত ৪ নভেম্বর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আনুমানিক ১৭ লাখ মানুষ ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছে শহরের নির্বাচন বোর্ড। গত ৩০ বছরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি। ভোটগ্রহণ শুরু হয় স্থানীয় সময় সকাল ৬টায়। মামদানির নির্বাচনী রাতের আয়োজন রাখা হয়েছে ব্রুকলিন প্যারামাউন্টে। যা ডাউনটাউন ব্রুকলিনের একটি ঐতিহাসিক কনসার্ট ভেন্যু হিসেবে পরিচিত। মামদানি মোট ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে ৮৫ শতাংশ ভোট গণণার পর এ ফল বেসকারিভাবে প্রকাশিত হয়। জোহরান মামদানি সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো ও রিপাবলিকান কার্টিস স্লিওয়াকে পরাজিত করেছেন। মামদানি বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের স্থলাভিষিক্ত হবেন। তিনি সেপ্টেম্বরে পুনর্নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও ব্যালটে নাম রেখেছিলেন।
মামদানির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ট্রাম্প : সিবিএস নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, মামদানি ‘কমিউনিস্ট’। তিনি একজন সমাজতান্ত্রিকের থেকেও বেশি খারাপ। ট্রাম্পের দাবি, আমাদের একজন কমিউনিস্ট আছেন, তার বয়স ৩৩ বছর। তিনি কিছুই জানেন না। সম্ভবত জীবনে এক দিনও কাজ করেননি। মামদানিকে হুমকি দিয়ে ট্রাম্প বলেন, জোহরান জিতলে নিউ ইয়র্কের জন্য তা সমস্যার হবে। মামদানি জিতলে নিউ ইয়র্কের তহবিল কমিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আমি নিউ ইয়র্কে খুব বেশি টাকা পাঠাব না। আমরা আমাদের একটি মহান শহরকে ধ্বংস হতে দেব না। আমরা একে মহান করে তুলব। আমরা প্রায় ৩০ দিনের মধ্যে অপরাধ পরিষ্কার করব।’ তবে এসব কথা কাজে আসেনি। মামদানিও অবশ্য এসব গায়ে মাখেননি। তিনি সস্তায় খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান নিউ ইয়র্কের বাসিন্দাদের জন্য এ তিন প্রতিশ্রুতিই দিয়েছেন । শনিবার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ফোন করেন মামদানিকে। জিতলে তাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য পাশে থাকার আশ্বাসও দিয়েছেন ওবামা।
জরিপে এগিয়ে ছিলেন মামদানি : ভারতীয় বংশোদ্ভূত মা-বাবার সন্তান ও উগান্ডায় জন্মানো মামদানি একজন মুসলিম। তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক গভর্নর যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত অ্যান্ড্রু কুওমোর তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে মামদানির কাছে হেরে যাওয়ার পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েন কুওমো। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এমারসন কলেজ/পিআইএক্স ১১/দ্য হিল জরিপে দেখা গেছে, মামদানি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কুওমোর চেয়ে প্রায় ২৫ পয়েন্ট এগিয়ে। জোহরানের প্রতি সমর্থন ৫০ শতাংশ, কুওমোর ২৫ শতাংশ। রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্ল্লিওয়া কুওমোর থেকে চার পয়েন্ট পিছিয়ে, সমর্থন ২১ শতাংশ। জরিপটি ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।
কে এই মামদানি?
আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ মেয়র পদে এর আগে কোন মুসলিম জেতেননি। ফলে তার প্রার্থী হওয়া থেকে শুরু করে বিজয় অর্জন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায় বিশ্বের সকল দেশের মুসলিমদের উজ্জীবিত করে। তার বাবা মা ভারতীয় বিধায় এশিয়া তথা ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তানসহ দেশগুলোর অভিবাসী ও সাধারণ নাগরিকদের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জোহরান কোয়ামে মামদানির জন্ম ১৮ অক্টোবর, ১৯৯১। একজন আমেরিকান রাজনীতিবিদ যিনি ২০২১ সাল থেকে ৩৬তম জেলা থেকে নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য হিসেবে কাজ করে আসছেন, যিনি কুইন্স পাড়া অ্যাস্টোরিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অফ আমেরিকার সদস্য হিসেবে তিনি ২০২৫ সালের নির্বাচনে নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী। বলতে গেলে এ মনোনয়ন লাভের মাধ্যমে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস জিততে না পারলেও মামদানির জয় আটকাতে পারেনি কেউ।
মামদানি উগান্ডার কাম্পালায় শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানি এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ারের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সে পরিবারটি দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিবাসিত হয় এবং তারপর সাত বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে এবং নিউ ইয়র্ক সিটিতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। মামদানি ব্রঙ্কস হাই স্কুল অফ সায়েন্স থেকে স্নাতক হন এবং ২০১৪ সালে মেইনের বোডোইন কলেজ থেকে আফ্রিকানা স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। জোহরান ২০২১ সালে সিরীয় বংশোদ্ভূত শিল্পী রামা দুয়াজির সঙ্গে পরিচিত হন এবং চলতি বছরের শুরুতে তাকে বিয়ে করেন।
মামদানির মা মীরা নায়ারের জন্ম ১৫ অক্টোবর, ১৯৫৭ সালে ভারতের ওড়িশার রাউরকেলায়।
তার বাবা অমৃত লাল নায়ার ভারতীয় প্রশাসনিক পরিষেবার একজন কর্মকর্তা ছিলেন এবং তার মা প্রবীণ নায়ার একজন সমাজকর্মী ছিলেন। তার পরিবার পাঞ্জাবি বংশোদ্ভূত। মীরা ১৯৭৫ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য চলে যান, যেখানে তার তথ্যচিত্র নির্মাণের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। সমাজবিজ্ঞানের ওপর তার থিসিসের জন্য তিনি তার প্রথম তথ্যচিত্র জামা মসজিদ স্ট্রিট জার্নাল (১৯৭৯) তৈরি করেন, যা একটি ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি রেকর্ড।
মামদানির বাবা মাহমুদ মামদানি ২৩ এপ্রিল ১৯৪৬ ভারতের বোম্বেতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার ভারতীয় প্রবাসীদের অংশ হিসেবে উগান্ডার কাম্পালায় বেড়ে ওঠেন। তার বাবা-মা গুজরাটি মুসলিম, ব্রিটিশ অঞ্চল টাঙ্গানিকা (বর্তমান তানজানিয়া) তে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার বাবা সেখানে কলেজে পড়ার সময় বোম্বেতে চলে আসেন। মামদানির বয়স যখন দুই বছর তখন পরিবারটি টাঙ্গানিকার দার এস সালামে ফিরে আসে এবং তার বয়স যখন পাঁচ বা ছয় বছর তখন উগান্ডায় চলে আসে। উগান্ডায় থাকার সুবাদে তিনি একজন উগান্ডার শিক্ষাবিদ এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
কেন জোহরানের বিজয়?
মাত্র এক বছর আগেও জোহরান মামদানি ছিলেন রাজনীতির অচেনা মুখ। এখন তিনি নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় মেয়র, যার প্রভাব শহর ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো আমেরিকায়, এমনকি বিশ্বজুড়ে। ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট হিসেবে তার উত্থান ছিল বজ্রগতির। তরুণ ভোটারদের সক্রিয়তা, তৃণমূলভিত্তিক প্রচারণা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাস্যরসাত্মক কিন্তু মানবিক বার্তার মধ্য দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন এক নতুন রাজনৈতিক ধারা।
জোহরান বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমর্থন বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়েছেন। কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে সমর্থন গত মাসে ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭১ শতাংশ হয়েছে। ৫০ বছরের নিচের ভোটারের মধ্যে ৬৯ শতাংশ তাকে সমর্থন করছেন, ৫০ বছরের বেশি বয়সিদের মধ্যে সমর্থন যথাক্রমে : জোহরান ৩৭ শতাংশ, কুওমো ৩১ শতাংশ, স্ল্লিওয়া ২৮ শতাংশ।
মারিস্ট নিউ ইয়র্ক সিটি জরিপে দেখা যায়, জোহরান কুওমোর চেয়ে ১৬ পয়েন্টে এগিয়ে, আর স্ল্লিওয়ার তুলনায় ৩২ পয়েন্টে এগিয়ে। সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ জোহরানের পক্ষে, ৩২ শতাংশ কুওমোর এবং ১৬ শতাংশ স্ল্লিওয়ার পক্ষে। জরিপটি ২৪-২৮ অক্টোবরের মধ্যে পরিচালিত হয়। নিউ ইয়র্কে মেয়র নির্বাচনের ঠিক আগে ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী একটি অংশের সমর্থন পেয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী মামদানি। তবে এ সমর্থনকে কেন্দ্র করে সম্প্রদায়টির নেতাদের মধ্যে বিভক্তিও প্রকাশ্যে এসেছে। ঐ গোষ্ঠীর শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা কুওমোকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে, সাবেক গবর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমোর মতো রাজনীতিকরা যখন ধনকুবের দাতাদের টাকায় প্রচারণা চালান, তখন মামদানি ছিলেন মানুষের মাঝে, নিজের সমালোচকদের সঙ্গেও মুখোমুখি আলোচনা করেছেন। ফলে তিনি হয়ে ওঠেন ‘পুরনো রাজনীতি’র বিপরীতে এক তরুণ বিকল্প।
গত জুনে ডেমোক্রেটিক মেয়র প্রাইমারিতে ব্যাপক ব্যবধানে জয়ের পর তিনি ধীরে ধীরে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস, গবর্নর ক্যাথি হোচুল ও কংগ্রেস নেতা হাকিম জেফরিসসহ শীর্ষ ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন পান। ছোট ছোট তৃণমূল অনুদানেও গতি পায় তার প্রচারণা। টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে নীতিগত বার্তাভিত্তিক কনটেন্টের মাধ্যমে তিনি তরুণ ও প্রথমবারের ভোটারদের রাজনীতিতে টেনে এনেছেন। তার অঙ্গীকার, ভাড়ার লাগাম টানা, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, সাশ্রয়ী শিশু যত্ন, সহজলভ্য মুদি বাজার ও গণপরিবহন। পাশাপাশি তিনি ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধি, করপোরেট ট্যাক্স বাড়ানো এবং সিটি-মালিকানাধীন মুদি দোকানের প্রস্তাব দিয়েছেন।
বর্ণবাদ ও ইসলামোফোবিয়ায় ভরা বিরোধী প্রচারণার মুখেও মামদানি প্রচারণা চালিয়েছেন উর্দু, হিন্দি ও স্প্যানিশ ভাষায় মসজিদ থেকে নাইট শিফটের কারখানা পর্যন্ত গিয়ে। মুসলিম পরিচয়ের গর্ব, গাজা ইস্যুতে অবস্থান ও অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ভূমিকা তাকে করে তুলেছে নতুন প্রজন্মের প্রেরণার প্রতীক। আর এভাবেই বিজয় ছিনিয়ে আনেন তিনি। বিশ্লেষকরা বলেন, ৯/১১-পরবর্তী প্রজন্মের এক তরুণ মুসলিম হিসেবে মামদানির উত্থান ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন শ্বেত জাতীয়তাবাদ ও কর্তৃত্ববাদ আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে আমেরিকায়। তবু তিনি দৃঢ় থেকেছেন নিজের মূল বার্তায় নিউইয়র্কের জীবনকে আরও সাশ্রয়ী ও ন্যায্য করতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে।’ এখন নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানি আমেরিকান রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায় সূচনা করেছেন। তার সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক, কিন্তু শহরটি তাকিয়ে আছে এক নতুন সূর্যোদয়ের দিকে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।