ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (রহ.) ছিলেন এক অনন্য আলোকবর্তিকা, যিনি শুধু ধর্মীয় জ্ঞানের শিক্ষক নন-ছিলেন সত্য, ন্যায় ও ঈমানের সাহসী কণ্ঠস্বর। কুরআন ও সুন্নাহর গভীর ব্যাখ্যা, হৃদয়স্পর্শী দাওয়াত এবং যুক্তিনির্ভর বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি লাখো মানুষের হৃদয়ে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলেছেন। তার জীবন ছিল ত্যাগ, অধ্যবসায় ও ধৈর্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শৈশব থেকেই জ্ঞানার্জনের অদম্য আগ্রহ তাকে দেশের খ্যাতিমান আলেমদের শিষ্য করেছে। পরবর্তীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে পালন করেছেন।
প্রচণ্ড রাজনৈতিক চাপ, মিথ্যা মামলা এবং দীর্ঘ কারাবাস সত্ত্বেও তিনি নীতি ও আদর্শ থেকে একচুলও সরে যাননি। তার বাণী মানুষকে তওবা, নৈতিকতা ও ঐক্যের পথে আহ্বান জানিয়েছে। আজ তিনি দেহে আমাদের মাঝে না থাকলেও তার দাওয়াতি উত্তরাধিকার, অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্য ও নৈতিক দৃঢ়তা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সত্যের পথে চালিত করবে-এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (রহ.) ছিলেন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, কুরআনের মুফাসসির, দাওয়াতি নেতা ও ইসলামী আন্দোলনের অগ্রপথিক। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ছিল কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সমাজ সংস্কার, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের জন্য অবিরাম সংগ্রামের গল্প। আল্লাহ বলেন-যারা আল্লাহর পথে আহ্বান জানায়, সৎকর্ম করে এবং বলে—‘আমি মুসলিম’। তাদের চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে?” (সূরা হা-মীম আস সাজদাহ ৩৩)
আল্লামা সাঈদী ১৯৪০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানীর বালিপাড়া ইউনিয়নের সাঈদখালী গ্রামে তার জন্ম। পিতা মরহুম ইউসুফ সাঈদী ছিলেন আলেম, শিক্ষক ও দাঈ। শৈশব থেকেই ইসলামি জ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল তার। ছারছিনা আলিয়া মাদরাসা ও খুলনা আলিয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করেন এবং ১৯৬৪ সালে তাফসির শাস্ত্রে কামিল পাশ করেন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে তিনি পাঁচ বছর ধরে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, মনোবিজ্ঞান ও নানা ভাষায় গভীর গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬০ সালে বেগম সালেহা সাঈদীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ৪ পুত্র-রাফীক বিন সাঈদী, শামীম বিন সাঈদী, মাসুদ বিন সাঈদী ও নাসিম বিন সাঈদী। বড় ছেলে রাফীক ২০১২ সালের ১৩ জুন ইন্তিকাল করেন।
মাওলানা সাঈদী সত্তরের দশক থেকে তিনি ইসলামী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৭৯ সালে জামায়াতের রুকন শপথ নেন, ১৯৮৯ সালে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য, ১৯৯৬ সালে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, ১৯৯৮ সালে নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং ২০০৯ সালে নায়েবে আমীর হন-যা শাহাদাত পর্যন্ত বহাল ছিল।
রাজনীতিতে তিনি ছিলেন নীতিবান, সাহসী ও ত্যাগী। পিরোজপুর-১ আসন থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হন, যদিও এলাকা হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। তার প্রচেষ্টায় সংসদে শিরকি রীতি-স্পিকারের সামনে মাথা নত করা-বন্ধ হয়।
জাতীয় স্টেডিয়ামে সাফ গেমস উপলক্ষে ‘মশাল টাওয়ার’ বা আগুন পূজার প্রতীক স্থাপন করা হলে তিনি তাওহিদী জনতাকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন এবং এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দেন। সরকারের ভয়ে সেই টাওয়ার ভেঙে ফেলা হয়। তিনি সংসদে কওমী সনদের স্বীকৃতি এবং দাওরায়ে হাদীসকে স্নাতকোত্তর সমমান দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এই উদ্যোগের ফলেই পরবর্তীতে সরকার নোটিফিকেশন জারি করে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৯-৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বজ্রকণ্ঠ ছিলেন। ১৯৯৪ সালের কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলন এবং ১৯৯৮ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিরোধী আন্দোলনে দৃঢ় অবস্থান নেন। রাসুল সা. বলেছেন- “যে জালিম শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলল, সে-ই শহীদ।” (আবু দাউদ, তিরমিযি)
বাংলা ভাষায় তাফসিরে কুরআন উপস্থাপনায় তিনি ছিলেন অনন্য। গভীর জ্ঞান, হৃদয়গ্রাহী ভাষা ও সহজবোধ্য উপস্থাপন তাকে সাধারণ মানুষের প্রিয় করে তোলে। হাজারো মানুষ তার দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামী জীবনধারায় ফিরে আসে। পেশাগত জীবনে তিনি শিক্ষক ও লেখক ছিলেন। রচনা করেছেন ৭৭টি গ্রন্থ, যেখানে তাফসির, হাদিস, ফিকহ, নৈতিকতা, ইতিহাস ও সামাজিক সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা রয়েছে। ২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট রবিবার সকালে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে কাশিমপুর থেকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, পরে পিজি হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু দীর্ঘসূত্রিতা ও অবহেলায় সারাদিন নষ্ট হয়ে যায়।
২০১৯ সালের পর থেকে তার কোনো চিকিৎসা হয়নি। গুরুতর অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসা বিলম্বিত হয়। ১৩ আগস্ট রাত ১১টার পর তাকে হাসপাতালে আনা হয়, পরিবারকে অবস্থা জানানো হয়নি। ১৪ আগস্ট রাত ৯টায় জানানো হয়, তিনি রাত ৮টা ৪০ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ বলেন-“আল্লাহর পথে নিহতদের মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা অনুভব কর না।” (সূরা আল-বাকারা ১৫৪)
তার ছাত্র, অনুসারী, তাফসির মাহফিল, বই ও সংগ্রামী আদর্শ আজও লাখো মানুষের হৃদয়ে জীবিত। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন-
সত্যের পথে দৃঢ় থাকা
ইসলামী আদর্শে সমাজ সংস্কার
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া
তার জীবন মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
পরিশেষে বলতে চাই, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (রহ.) ছিলেন এক আলোকবর্তিকা, যিনি জীবনভর আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তার তাফসির, দাওয়াত, রাজনৈতিক অঙ্গনে সাহসী ভূমিকা এবং নৈতিকতার দৃঢ় অবস্থান তাকে মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে চিরঅম্লান করে রেখেছে। মিথ্যা অপবাদ, কারাবরণ ও নির্যাতনের মধ্যেও তিনি সত্যের পতাকা উঁচিয়ে রেখেছিলেন।তিনি কেবল একজন আলেম ছিলেন না; ছিলেন একজন মুজাহিদ, একজন দরদি দাঈ, একজন প্রভাবশালী বক্তা ও প্রেরণাদায়ী নেতা। তার মুখের তাফসির শুনে অসংখ্য মানুষ তওবা করে সঠিক পথে ফিরে এসেছে। তার জীবন আমাদের শেখায়—আল্লাহর পথে ডাকে সাড়া দিতে হলে ধৈর্য, ত্যাগ ও আল্লাহর ওপর অটল আস্থা অপরিহার্য।
আজ তিনি দৌহিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার শিক্ষা, আদর্শ ও সাহসী কণ্ঠ যুগে যুগে মানুষকে সত্যের পথে ডাকতে থাকবে। কুরআনের ভাষায়, “আল্লাহর পথে নিহতদের মৃত বলো না; তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা অনুভব কর না।” (সূরা আল-বাকারা ১৫৪) আল্লাহ তায়ালা যেনো আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (রহ.)-কে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চতম মাকাম দান করেন, তার সকল ত্যাগ, পরিশ্রম ও দাওয়াতি কাজকে কবুল করেন, এবং আমাদেরকেও তার মতো সত্যের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দেন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক।