মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী

সম্প্রতি পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকা থেকে পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনযোগে কক্সবাজার বেড়াতে যাই। ট্রেনের দুপুরের খাওয়ার মান খুবই নিম্নমানের। ট্রেন যাত্রায় কোন চা পাওয়া যায়নি। ট্রেন ভাল তবে অপরিষ্কার। লাগেজ বা মালামাল রাখার জায়গা সল্পতার জন্য প্রায়ই যাত্রীদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। ট্রেনে কোন রেলওয়ে পুলিশের ভূমিকা চোঁখে পড়েনি। সবকিছুর পর যখন কক্সবাজার পৌছে কক্সবাজার আইকন রেলওয়ে স্টেশন দেখে মন ভরে যায় । কী চমৎকার কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশন! গুণে-মানে অদ্ভূত যা নিজ চোখে না দেখলে অনুধাবন করা দুষ্কর। কক্সবাজারের রাস্তাগুলোও চমৎকার ও সুন্দর। সেখানকার খাবারের মান মোটামুটি, তবে মূল্য বেশী।

বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে এর করুণ অবস্থা দেখে পর্যটক কেন আমি নিজেও হতবাক। অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন এ সমুদ্র সৈকতে শতশত কুকুর, ভিক্ষুক, শিশু ম্যাসেজ বয়, শিশু গান ওয়ালীদের উৎপাত, হরেক রকমের হকার, নোংরা ও গন্ধে ভরপুর ঘোড়া ও বাইকের দৌরাত্ম্যে পর্যটকরা অতিষ্ঠ এবং ক্ষুব্ধ। দেখতে পেলাম গোটা কক্সবাজার শহর এখন রোহিংগাদের অভয়নগরে পরিণত হয়েছে। এবার রাস্তা এবং হোটেলগুলোতে স্পা-ম্যাসেজ-এর সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখে একটু আশ্চর্য হলাম। তবে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ভ্রমণের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যেতে পারে যে, দেশ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও এই সমুদ্র সৈকত কোনভাবেই আন্তর্জাতিক মানে গড়ে উঠেনি। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের চরম অবেহলা ও উদাসীনতা এবং টুরিস্ট পুলিশের নজরদারীর অভাবে গোটা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত তার ঐতিহ্য, মান-মর্যাদা ও সুনাম হারাতে বসেছে। অথচ প্রতিবছর লাখ লাখ দেশী-বিশেী পর্যটক কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসে। তবে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে উড়ন্ত ধুলো বালুর জন্য ছাতীর নিচে বসা বা রিলাক্স করা যায় না। তারপরও পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত অনেক হোটেল-মোটেল ছাড়াও সৈকতের নিকটেই কয়েকটি পাঁচতারকা হোটেল রয়েছে। সেবা প্রদানে যথেষ্ট অবহেলার জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হোটেল-মোটেলগুলোর অবস্থা শোচনীয়।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত অবস্থিত। এর পূর্বে রয়েছে মায়ানমার এবং ভারত সীমান্ত, দক্ষিণে রয়েছে বিশাল বঙ্গোপসাগর। কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকতের নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের জন্য সাধারণত কোন বিদেশী পর্যটকদের এখন পর্যন্ত আকর্ষণ করতে পারছে না। গোটা সমুদ্র সৈকতের অনেক এলাকা মনে হয় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যত্রতত্র আবর্জনায় ক্রমেই নষ্ট হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ, যা দেখার কেউ নেই। ফলে বিশ্বের দীর্ঘতম এ সমুদ্র সৈকতটি ধীরে ধীরে হারাচ্ছে তার অপরূপ সৌন্দর্য। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। সমুদ্র সৈকতটি এতো নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন যা কোন শিল্পীর পক্ষেও ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। বলার অবকাশ রাখে না যে, সম্প্রতি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ করে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতায় সৈকতের বালিকা মাদরাসা পয়েন্ট হতে সারমর্ম বিচ পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ডাবের খোসা, ময়লা ও খালি পানির বোতল, চিপসের খালি প্যাকেট, চিনা বাদামের খোসা, আজেবাজে ময়লার স্তূপ দেখে আমি নিজেই হতবাক ও ক্ষুব্ধ। তারপর সমুদ্র সৈকত সন্নিকটে ভাতের হোটেল ও ঝুপড়ি দোকানের ময়লা পরে থাকতে দেখা যায়। এটা কী পৌরসভা বা জেলা প্রশাসকের চোখে পরে না। হকার, ভিক্ষুক, ফেরিওয়ালাদের দৌরাত্ম্যে সৈকতে পর্যটকরা সুন্দরভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে সমুদ্র বিনোদন উপভোগ বা ঘুড়াঘুড়ি করতে পারছে না। এতে চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় স্ত্রী-মেয়েদের নিয়ে পরতে হয়। জানা যায় যে, সৈকতের উন্নয়ন ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, ভিক্ষুক-হকারমুক্ত রাখার দায়িত্ব জেলা প্রশাসক, বিচ ম্যানেজমেন্ট ও টুরিস্ট পুলিশের দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত কোনভাবেই যেন বিদেশী সি-বিচের মত গড়ে উঠতে এবং বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারছে না। তবে কক্সবাজার শহরটি দারুণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখে পর্যটক কেন আমি নিজেও অনেক অনেক খুশী।

পর্যটন নগরী কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে যেমন সমস্যা আছে, ঠিক তেমনি রয়েছে অফুরন্ত সম্ভবনাও। কিন্তু সঠিক নির্দেশনা বা সৈকত নীতিমালা না থাকার কারণে বছরের পর বছর অনেকটাই অবহেলিত হয়ে আছে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সৈকতসহ এ অঞ্চলের পর্যটন স্পষ্টগুলো। পাশাপাশি দূষণের কারণে দিন দিন বিনষ্ট হচ্ছে সৈকতের সৌন্দর্য। কক্সবাজার পৌরসভার অবহেলার জন্য সী-বিচ এলাকার সৌন্দর্য বর্ধন ও উন্নয়ন এবং পরিচ্ছন্নতা এখন পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। তবে কক্সবাজার শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটামুটি ভাল থাকার কারণে বড় ধরনের তেমন দুর্ঘটনা ঘটতে শুনিনি। কক্সবাজার শহরে রোহিঙ্গাদের বিবিধ কর্মকাণ্ডে বিশেষ করে মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী তৎপরতাসহ হরেক রকমের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই তবে প্রশাসন সচেতন। কক্সবাজার শহর থেকে নৈকটের কারণে লাবনী বিচকে কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্র সৈকত বলে বিবেচনা করা হলেও ইনানী বিচ সহ অন্যান্য বিচগুলো অনেক সুন্দর। নানা রকম সামুদ্রিক জিনিষের পসরা সাজিয়ে সৈকত সংলগ্ন এরাকায় রয়েছেছোট-বড় অনেক বার্মিজ দোকান যা পর্যটকদেরআকর্ষন কওে থাকে। রয়েছে অনেক ঝিনুক মার্কেট। নিরাপওার স্বার্থে কক্সবাজার সেনানিবাস বা ক্যান্টনমেন্টকে আরো আধুনিকরণ ও শক্তিশালী করার ওপর জোর দিতে হবে। এখানে কোন অবহেলাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। সাগরপাড়ে কোন টুরিষ্ট পুলিশ ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দেখা মিলে নাই।

বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার কক্সবাজারকে একটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে বদ্ধপরিকর থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ইহা নজরে আনছে না। ভ্রমণ পিপাসুরা মনে করেন প্রয়োজনে কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতের আধুনিকতার জন্য আগামী ১০ বছরের জন্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, বা জাপানের কাছে সী বিচটি লীজ দিলে এতে করে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি এ শিল্প বিকাশের যথেষ্ট উন্নতি ও আধুনিকতার ছোঁয়া পরবে। বাড়বে দেশী-বিদেশী অনেক পর্যটক। তারা সী-বিচটিকে একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে উন্নত সেবা দিতে কারপর্ণ করবে না। বাড়বে সরকারের রাজস্ব তাতে কোন সন্দেহ নেই। আরো বাড়বে দেশীয় মুদ্রার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সার্ফিয়ের জন্য খুবই উপযোগী। সমুদ্রের কোন একটি পয়েন্টে যদি সার্ফার জোন প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং তা সার্বক্ষণিক তদারকি করা হয় তাহলে এ খাত থেকেও প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় করা সম্ভব। তবে বিগত সরকারের আমলের দুর্নীতিই কক্সবাজার জেলার সকল প্রকার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। কক্সবাজার শহরে দিন দিন রোহিংগাদের আগমনকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। এ শহরের আধুনিকতা ও শৃঙ্খলার বড়ই প্রয়োজন। পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কক্সবাজার পর্যটন শিল্পকে অবিলম্বে বিদেশীদের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করার ওপর জোড় দিচ্ছি।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলাম লেখক।