শেখ এনামুল হক

উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলো ইসরাইল থেকে ক্রমেই বেশি হুমকি অনুভব করছে। এমন প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি সৌদি আরব ও পাকিস্তান কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি (এমএমডিএ) স্বাক্ষর করেছে। ফলে পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা হিসাব-নিকাশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ চুক্তির মধ্য দিয়ে রিয়াদের অর্থশক্তি এবং ইসলামাবাদের বিশাল পারমাণবিক ক্ষমতার দারুণ মেলবন্ধন হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, ইসলামাবাদকে বিভিন্নভাবে অর্থ সহায়তা দেবে রিয়াদ। বিনিময়ে প্রয়োজনীয় পারমাণবিক সহযোগিতা নিয়ে রিয়াদের পাশে দাঁড়াবে ইসলামাবাদ।

এ চুক্তির বিস্তারিত জানা না গেলেও পাকিস্তানের ঘোষিত পারমাণবিক নীতি হলোÑ শুধু চির বৈরী প্রতিপক্ষ ভারতকে লক্ষ্য করেই দীর্ঘমেয়াদি তাদের (পারমাণবিক) অস্ত্র তৈরি করা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ বলেছেন, কোনো আগ্রাসনের জন্য আমাদের এই চুক্তি ব্যবহার করার ইচ্ছা নেই। কিন্তু যদি কোনো পক্ষ হুমকির মুখে পড়ে, তবে স্বাভাবিকভাবেই এটি কার্যকর হবে।

তবে রিয়াদ ইঙ্গিত দিচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করার মধ্য দিয়ে তারা কার্যত পারমাণবিক সুরক্ষা বলয়ের নিচে চলে এসেছে। ভাষ্যকারদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের সম্ভাব্য একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ইসরাইল সৌদি আরব পাকিস্তানের চুক্তিকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, এ চুক্তির আওতায় পারমাণবিক অস্ত্র নেই। অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কিত কোনো ধারা নেই, শুধু প্রচলিত সামরিক সহযোগিতার বিষয় আছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশকে ভবিষ্যতে এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

খাজা মোহাম্মদ আসিফ বলেন, কোনো প্রকার আগ্রাসনের জন্য এ চুক্তি ব্যবহার করার ইচ্ছা নেই; কিন্তু যদি কোনো পক্ষ (সৌদি আরব বা পাকিস্তান) হুমকির মুখে পড়ে, তবে স্বাভাবিকভাবেই এটি কার্যকর হবে। ইসলামাবাদ যা-ই বলুক, চুক্তির আওতায় পারমাণবিক অস্ত্র থাকছে কিনা তা ভিন্নভাবে দেখছে রিয়াদ।

শুধু মার্কিন নিরাপত্তার ওপর ভরসা করা উচিত নয়। কারণ এটিরও সীমাবদ্ধতা আছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। উপসাগরীয় আরব দেশগুলো বলছে, কাতারে ৯ সেপ্টেম্বর হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে ইসরাইল কার্যত যেকোনো আরব দেশে আগ্রাসন পরিচালনার হুমকি দিয়ে রেখেছে। এদিকে ইসরাইল এখন পর্যন্ত নিজেদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করেনি। তবে ধারণা করা হয়, দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। অন্যদিকে সৌদি আরব ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলে তারাও করবে।

সৌদি আরবের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে রয়টার্স জানতে চেয়েছিল পাকিস্তান কি এখন সৌদি আরবকে পারমাণবিক সুরক্ষা দেবে? উত্তরে তিনি বলেন, এটি একটি ব্যাপক প্রতিরক্ষা চুক্তি। সব ধরনের সামরিক উপায় এর অন্তর্ভুক্ত। বিশ্লেষকরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলে যে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, এ চুক্তির মধ্যে সেটির ওপর নির্ভরশীলতা কমারও প্রতিফলন রয়েছে। লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) মধ্যপ্রাচ্যনীতিবিষয়ক সিনিয়র ফেলো হাসান আল হাসনা বলেন, সৌদি আরবের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পারমাণবিক শক্তিধর ইসরাইলের তুলনায় কৌশলগত ও প্রচলিত সক্ষমতায় পিছিয়ে থাকা দেশটি এ চুক্তির মধ্য দিয়ে শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করছে।

প্রতিবেশী ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের সাতগুণ বেশি। এ পরিস্থিতিতে সৌদি আরব থেকে আর্থিক সহায়তা পেলে দেশটি সামান্য হলেও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনতে পারে।

সৌদি আরব এক বিবৃতিতে বলেছে, এ চুক্তির লক্ষ্য উভয় দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিভিন্ন দিক উন্নত করা এবং আক্রমণ প্রতিহত করার সক্ষমতা শক্তিশালী করা; কিন্তু এ চুক্তিতে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কিনা, তা জানতে যোগাযোগ করা হলে সৌদি আরবের গণমাধ্যম বিভাগ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। চুক্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পররাষ্ট্র বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তারাও কোনো মন্তব্য করেননি। চুক্তিটি পাকিস্তানের প্রতিবেশী ভারত ও ইরানের উদ্বেগ তৈরি করে থাকতে পারে।

পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে দুর্বল; কিন্তু সারা বিশ্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যার রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আশা করেছিলেন, আব্রাহাম চুক্তির আওতায় চলতি মেয়াদে তিনি আরো কিছু আরব দেশ ও ইসরাইলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করবেন; কিন্তু মনে হয় না তা সম্ভব হবে। রিয়াদ ইতোমধ্যে স্পষ্ট বলেছে, গাজা যুদ্ধ বন্ধ ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে না।

পাশাপাশি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও বেশ বড়, সদস্য ছয় লাখের বেশি। অর্থাৎ দেশটি বৈরী প্রতিবেশী ভারতকে তারা মোকাবিলায় প্রস্তুত। পারমাণবিক শক্তিধর এ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এরই মধ্যে তিনটি বড় যুদ্ধ ও অনেক ছোট ছোট সংঘাত হয়েছে। গত মে মাসে চারদিনের পাল্টাপাল্টি বিমান ও ড্রোন হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সমর বিশেষজ্ঞদের মতে, এ যুদ্ধে ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি ছিল গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাত।

রিয়াদ-ইসলামাবাদ চুক্তিতে পারমাণবিক অস্ত্র বা অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে সরাসরি কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। পাকিস্তান বলেছে চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের ওপর হামলা হলে তা উভয় দেশের ওপর আগ্রাসন বলে গণ্য হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এক বিবৃতিতে সৌদী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক সম্প্রসারণের বিষয়ে তিনি গভীর আগ্রহী। ভারত ও পাকস্তিান ১৯৯০-এর দশকের শেষার্ধে পারমাণবিক শক্তি অর্জন করে। পাকিস্তান এমন ক্ষেপণাস্ত্রও তৈরি করেছে যা ভারতের একেবারে গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম। অন্যদিকে খাতা-কলমের হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলে আঘাত করার সক্ষমতাও রয়েছে।

পাক সেনাবাহিনীর কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগের (পারমাণবিক অস্ত্র তত্ত্বাবধান করে) সাবেক কর্মকর্তা আদিল সুলতান বলেন, ‘আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম।’ তিনি আরো বলেন, ‘পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ইসরাইল কখনো স্বস্তিবোধ করেনি। কিন্তু আমাদের (পারমাণবিক) সক্ষমতা খুব সীমিত এবং ভারতকে লক্ষ্য করেই এসব তৈরি করা হয়েছে।

গত বছর হোয়াইট হাউসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছিলেন, পাকিস্তান দূরপাল্লার ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতা অর্জন করেছে। এর ফলে দেশটি ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরের নিশানায় আঘাত হানতে সক্ষম হবে। কিন্তু ইসলামাবাদ এ দাবি অস্বীকার করেছে। এ চুক্তি নিয়ে সৌদি আরবভিত্তিক গালফ রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ সাগের বলেন, পারমাণবিক কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনো হয়নি। তবে তিনি বলেন, শুধুৃ মার্কিন নিরাপত্তার ওপর ভরসা করা উচিত নয়। কারণ এটারও সীমাবদ্ধতা আছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আশা করেছিলেন আব্রাহাম চুক্তির আওতায় চলতি মেয়াদে তিনি আরো কয়েকটি আরব দেশ ও ইসরাইলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করবেন; কিন্তু তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। রিয়াদ ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছে, গাজা যুদ্ধ বন্ধ ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে না।

সৌদি আরবে দীর্ঘদিন যাবত পাকিস্তানের স্বল্পসংখ্যক সেনা অবস্থান করছে। কিন্তু নতুন চুক্তি আরো বড় ধরনের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোদি বলেন, পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে; কিন্তু তারা এমন এক অঞ্চলে প্রবেশ করছে যা অত্যন্ত অস্থির ও সংঘাতপ্রবণ।

পাকিস্তান সিনেটের প্রতিরক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মুশাহিদ হোসাইন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাকাল থেকে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি প্যান-ইসলামিক (মুসলিম বিশ্বের ঐক্যকেন্দ্রিক) ছিল। পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা রয়েছে। এটা কাজে লাগিয়ে আমরা অর্থনীতি শক্তিশালী করতে সক্ষম। উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে এখন পাকিস্তান নতুন কৌশলগত বিকল্প। প্রতিবেশী ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের চাইতে সাতগুণ বেশি। এ পরিস্থিতিতে সৌদি আরব থেকে অর্থ পেলে দেশটি সামান্য হলেও ভারসাম্য আনতে পারে। রিয়াদ কয়েক বছর ধরেই ইসলামাবাদকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে। সর্বশেষ ৩০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে তারা।

অবশ্য ভারত বলেছে, তাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর এ ঘটনার (রিয়াদ-ইসলামাবদ চুক্তি) প্রভাব কেমন তারা তা পরীক্ষা করে দেখবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।