মুসফিকা আন্জুম নাবা

অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘনের পরিণাম কখনোই ভালো হয় না। আর এ অবাধ্যতার কারণেই অনেক জাতি ও সভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে; বিলীন হয়ে গেছে কালের গর্ভে। বস্তুত, সীমালঙ্ঘন ও পাপাচারের কারণেই পৃথিবীর বহু সভ্যতা, জনপদ, শক্তিধর রাজা-বাদশাহ এ প্রলয়ংকরী দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে। একসময়ের প্রভাবশালী জনপদ ধুলায় মিশে গেছে; যেমন পম্পেই নগরী। যা ইতিহাসের এক ভয়াবহ স্মৃতির কথায় স্মরণ করিয়ে দেয়। মূলত, ধ্বংসপ্রাপ্ত পম্পেই নগরী জৌলুস ছিল চোখ-ধাঁধানো নাগরিক সভ্যতার সূতিকাগার। একাধারে ব্যবসা, সংস্কৃতি আর বিনোদনের কেন্দ্র ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত এ নগরী। মঞ্চ-মণ্ডপ, ক্রীড়াগার, বন্দর আর তৎকালীন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের শহর এটি। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি তারুণ্যের আনন্দ আর যৌবনের বাঁধভাঙা উল্লাসের এক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অবাধ্যতা ও অশ্লীলতায় হারিয়ে যাওয়ার জনপদ ছিল এটি। অভয়ারণ্য ছিল মুক্ত মন আর সস্তা শরীরের। মূলত, এ শহর ছিল পতিতাদের। এ শহর ছিল সমকামের, শিশুকামের; অযাচারের আর অবাধ যৌনতার। মদ গোস্ত আর মাৎসর্যের যতসব আনন্দ চিন্তা করা যায় আর যা কিছু চিন্তা করা যায় না, সব কিছু খুঁজে পাওয়ার শহর ছিল এ পম্পেই।

ইতালির কাম্পানিয়া অঞ্চলের নেপলসের (নাপোলি) কাছে যে আগ্নেয়গিরি রয়েছে তার পাদদেশে ‘পম্পেই’ নামক ছোট্ট এ নগরীর অবস্থান। পাশেই রয়েছে নেপল উপসাগর। এটি হাজার বছরের পুরনো একটি শহর। খৃস্টপূর্ব ৬-৭ শতাব্দীর দিকে ইতালীর তৎকালীন রাজা ওসকান কর্তৃক এ শহরের গোড়াপত্তন হয়। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন যুদ্ধের মাধ্যমে খৃস্টপূর্ব ৮০ এর দিকে শহরটি রোমান সাম্রাজ্যের দ্বারা অধিকৃত হয় এবং সেখানে গড়ে উঠে রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম বাণিজ্য বন্দর। সে থেকে রোমানরা সেখানে বসবাস শুরু করে।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, পম্পেই নগরীর অধিবাসীরা ব্যাপকভাবে ভোগ-বিলাসে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। ইন্দ্রিয়প্রবণতা তাদেরকে একেবারে পশুর পর্যায়ে নেমে এনেছিলো। বিপুল বিত্ত-বৈভব, সম্পদ এবং অট্টালিকায় পরিপূর্ণ এ শহরে অবাধ যৌনতা ও সমকামীতার মত নিকৃষ্ট ঘৃণিত পাপাচার প্রকাশ্যে চলতো। কিন্তু মহান আল্লাহর শাস্তি যে বড়ই কঠিন। ৭৯ সালের এক সকালে পম্পেইয়ের পার্শ্ববর্তী বিশালকায় ভিসুভিয়াস পর্বত থেকে কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত ছাই নির্গত হয়ে শহরে উড়ে আসে। মুহূর্তে তলিয়ে যায় শহরটি। ভীতসন্ত্রস্ত অধিবাসীরা প্রাণ বাঁচাতে দেবতাদের ডাকতে থাকে। দিগি¦দিক হারিয়ে দৌড়াতে থাকা শহরবাসীর আর্তনাদ-আহাজারীর মাঝেই গগণবিদারী শব্দে বিস্ফোরিত হয় ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি, লাভা বেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ে। বিষাক্ত ছাই আর উত্তপ্ত লাভার নিচে পুরো পম্পেই নগরী আটকে মারা যায় কয়েক হাজার মানুষ, চিরতরে হারিয়ে যায় পম্পেই নগরী। মহান আল্লাহর শাস্তি কেমন হবে, এটা তার একটা সামান্য উদাহরণ মাত্র!

ইতিহাসের পাতা উল্টালেই আজও আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে অভিশপ্ত পম্পেই নগরীর ধ্বংসলীলার ভয়াবতা কথা। মূলত, এটি ছিলো ৭৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের কথা। অন্যদিনের মতোই সরগরম ছিলও সেদিনের বাজার। বাসায় গৃহিণী অথবা দাস-দাসিরাও নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। সরাইখানাগুলোতেও মানুষের ভিড়। সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য অনুশীলন করছে। কিন্তু কে জানতো সে দিনটাই নগরীর ধ্বংসের দিন হয়ে থাকবে।

মাত্র ১৮ ঘণ্টায় পুরো পম্পেই ঢাকা পরে গিয়েছিল আগ্নেয়গিরির লাভায়। হাজার হাজার মানুষ জীবন্ত অবস্থায় সে লাভায় ঢাকা পড়েছিল। এ শহরের পাশেই ভিসুভিয়াস পর্বত। আগ্নেয়গিরির মধ্যে যাকে সবচেয়ে ভয়ংকর বলা হয়। হঠাৎ বিস্ফোরণ হলো। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠল। ধোঁয়া, গলিত লাভা, ছাই পুরো পম্পেই নগরীতে আছড়ে পরতে লাগল। যারা বাসায় ছিলেন তারা বাড়ির মধ্যেই আটকা পরে মারা গেল। সে আগুনের তাপে সাথেই সাথেই মারা গেল রাস্তার অনেকে।

১৫৯৯ সালের আগ পর্যন্ত এ নগরী ছাইয়ের নিচেই ঢাকা ছিল। সারনো নদীর গতিপথ পরিবর্তন করতে গিয়ে এর সন্ধান পান ডমিনিক ফোন্তানা। তারপর ১৮৬৩ সালে ছাইয়ের ভিতর থেকে আবিষ্কার হল সে নগরীর বাসিন্দাদের দেহাবশেষ। ফুসফুস পুড়ে গিয়েছিল তাদের, মাংসপেশিও গলে গিয়েছিল। কয়েকদিন পর আগ্নেয়গিরির লাভা শক্ত হয়ে গেলেও ভেতরে থাকা দেহগুলো ধীরে ধীরে পচতে শুরু করল। পুরোপুরি পচে যাওয়ার পর সেখানে তৈরি হল বাতাস আর হাড় মিশ্রিত জায়গা। সে দেহাবশেষগুলো এয়ারপকেট আকারে থাকায় তা নিয়ে গবেষণা সম্ভব ছিল না। তাই বিজ্ঞানীরা বুদ্ধি বের করলেন যে, সে ফাঁকা জায়গাগুলো প্লাস্টার দিয়ে পূর্ণ করার। ৪৮ ঘণ্টা পর সে প্লাস্টার শুকিয়ে গেলে বেড়িয়ে আসলো ২০০০ বছর আগের সে নগরীর মানুষের আকৃতি। তাদের মৃত্যুর সময়ের করুণ দৃশ্য।

আল্লাহর নির্দেশে যেমন শূন্য থেকে বিশাল সাম্রাজ্য দাঁড়িয়ে যেতে পারে, তেমনি আল্লাহর হুকুমেই সাজানো শহর মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। পবিত্র কালামে হাকীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই জীবিত করেন এবং মৃত্যু দেন। যখন তিনি কোনো কাজের আদেশ করেন, তখন একথাই বলেন, হয়ে যাও, তা হয়ে যায়।’ (সুরা : গাফির, আয়াত : ৪৮) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোনো কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে শুধু একথাই বলেন, ‘হয়ে যাও’ আর তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১১৭)

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আরেকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি কওমে লুত। তাদের যখন আল্লাহর নাফরমানি সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছিল, তখন তারা তাচ্ছিল্য করেছিল। পবিত্র কুরআন তাদের সে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘তার জাতির (লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়ের) লোকদের এটা ছাড়া আর কোনো জবাবই ছিল না যে, এদের তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও, এরা নিজেদের বড় পবিত্র রাখতে চায়। (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৮২) ফলে তাদের ওপর আল্লাহর আজাব এসে গেল এবং তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। তাদের ধ্বংসের ভয়াবহতা কতটা ছিল সে ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর যখন আমার আদেশ এসে গেল, তখন আমি জনপদের ওপরকে নিচে উল্টে দিলাম এবং ক্রমাগত পোড়ামাটির পাথর বর্ষণ করলাম। (সুরা : হুদ, আয়াত : ৮২)

হুদ (আ.) আদ জাতিকে সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু তারা উদ্ধত হয়ে বলেছিল, ‘আর আদ সম্প্রদায়, তারা জমিনে অযথা অহংকার করত এবং বলত, আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী কে আছে? তবে কি তারা লক্ষ করেনি যে নিশ্চয় আল্লাহ, যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? আর তারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করত।’ (সুরা : ফুসসিলাত, আয়াত : ১৫)

অতঃপর মহান আল্লাহর চূড়ান্ত গজব প্রাকৃতিক দুর্যোগের বেশে এসে তাদের চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আদের ঘটনায়ও (নিদর্শন আছে)। আমি তাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম অকল্যাণের বাতাস। ওই বাতাস যার ওপরে এসেছিল তাকে রেখে যায়নি, বরং সব কিছু চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিল। (সুরা : জারিয়াহ, আয়াত : ৪১-৪২)

আদ জাতির পর পৃথিবীতে শিল্প ও সংস্কৃতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সামুদ জাতি। মহান আল্লাহ তাদের বহু নিয়ামত দিয়েছিলেন। কিন্তু বেইনসাফ, কুফর-শিরকে তাদের সমাজ নষ্ট হয়ে যায়। সমাজের নষ্ট লোকেরা নেতৃত্বে এসে সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে সালেহ (আ.)-এর কাছে পাঠানো আল্লাহর নিদর্শন উষ্ট্রীকে তারা হত্যা করে ফেলে। পরে সালেহ (আ.) তাদের আল্লাহর আজাবের ব্যাপারে সতর্ক করেন। কিন্তু তারা তা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেয়। অবশেষে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ওপর চূড়ান্ত আজাব চলে আসে। পবিত্র কুরআনে তাদের সে আজাবের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারপর সীমা লঙ্ঘনকারীদের মহানাদ আঘাত করে। ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে (ধ্বংস হয়ে যায়), যেন তারা কখনোই সেখানে বসবাস করেনি। জেনে রেখো, সামুদ জাতি তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করেছিল। আরো জেনে রেখো, ধ্বংসই হলো সামুদ জাতির পরিণাম।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৬৭-৬৮)

প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু একেকটি ক্ষতির ঘটনা নয়, বরং এটি আমাদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা। এ ধরনের দুর্যোগ দিয়েই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অবাধ্যদের শাস্তি দিয়ে থাকেন। তাই আমাদের উচিত এ দুর্যোগগুলোকে নিছক প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে না দেখে নিজেদের বদ আমলের ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করা এবং নিজেদের পাপের পথ থেকে ফিরিয়ে এনে আল্লাহর কাছে খাঁটি মনে তাওবা করা। একই সাথে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা এবরং ধৈর্য ধারণ করা।

মূলত, অবাধ্যতা কখনোই সুফল বয়ে আনে না বরং তাদেরকে দুনিয়াতে বিভিন্ন দুর্যোগ সহ নানাবিধ বিপদ-আপদ দিয়ে বা পুরোপুরি ধ্বংস করে শায়েস্তা করা হয়। যেমন আল্লাহর গজবের সম্পূখীন হয়েছিলো ইতালীর পম্পেই নগরী সহ বিভিন্ন জনপদ ও জাতি। আল্লাহ তাদেরকে যেমন দুনিয়াতের শাস্তি দিয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে আখেরাতেও রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তাই আসুন আমরা সীমালঙ্ঘন থেকে বেঁচে থেকে আল্লাহর একনিষ্ট ও অনুগত বান্দা হয়ে যাই। আর এতেই রয়েছে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি।

লেখক : শিক্ষার্থী, জয়পুরহাট সরকারি মহিলা কলেজ, জয়পুরহাট।