সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে একটা অলিখিত বন্ধন বা সখ্যতাও রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের মতে, ‘আমরা যা করি তাই আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের যা আছে তাই আমাদের সভ্যতা। মূলত সংস্কৃতি হলো মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রণালী এবং সভ্যতা হলো সে জীবন প্রণালীর বাহ্যিক রূপ। আর সভ্যতা বিকাশের পূর্বশর্ত হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির জন্ম ও টিকে থাকার মাধ্যমে একটি সভ্যতা পূর্ণতা লাভ করে এবং বিকশিত হয়........’।

মানবজীবনের ক্রমবিবর্তন যখন ইতিবাচক ধারায় সূচিত হয় তখনই তা সভ্যতা হয়ে ওঠে। এর বিপরীত দিকটাই হচ্ছে সভ্যতার সঙ্কট। আর এটিকে সভ্যতার বিচ্যুতি বলাও যুক্তিযুক্ত হবে। যার বাস্তব প্রমাণ সাম্প্রতিক বিশ্ব। কারণ, ইদানিং যাদেরকে সভ্যতার প্রতিভূ বা সহায়ক শক্তি বলে মনে করা হয়, তারাই এখন এর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সভ্যতার নামে যা কিছু হচ্ছে তা সর্বান্তকরণে ত্রুটিমুক্ত বলার সুযোগ থাকছে না। এমতাবস্থায় মানবসভ্যতা স্বকীয়তা হারাতে বসেছে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও পৃথিবীর সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রগতিশীলতা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য বা আন্তরিকতা দেখাতে পারছে না। সবকিছুই কথামালার ফুলঝুড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। কথা ও কাজের মধ্যে কোন সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপান জি-সেভেন নামে যা করছে তা মানবসভ্যতার জন্য গলার কাঁটা বা হুকর্ম হয়ে দেখা দিয়েছে। ন্যাটো বাহিনী ব্যবহৃত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের গণহত্যা ও আগ্রাসী যুদ্ধের কাজে। বিশ্বের ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রগুলোও উন্নত বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে ইতিবাচক নয় বরং অনাকাঙ্খিত লেজুরবৃত্তির বৃত্তেই আটকা পড়েছে। সমাজপতি, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, বৈজ্ঞানিক ও চিন্তাবিদরা এক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। ফলে সভ্যতার কথিত ক্রমবিকাশের সাথে সাথে অধঃপতনটা রীতিমত চোখে পড়ার মত। ফলে রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় ও আত্মসচেতন মানুষ।

এসব প্রবণতা থেকে আমরাও মুক্ত নই বরং ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। আমাদের রাষ্ট্রাচারের ক্রমবিবর্তন ইতিবাচক হিসাবে প্রচার পেলেও সার্বিক পরিস্থিতি মোটেই ইতিবাচক নয়। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি সর্বপরি জাতীয় জীবনে। মূল্যবোধের চর্চায়ও ঘটেছে বড় ধরনের বিচ্যুতি। ফলে আমাদের ‘সংস্কৃতি’ এখন ‘অপসংস্কৃতি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধ ও সমস্যার রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে সমাধান করা হচ্ছে না বরং জাতীয় জীবনে বার বার অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাই ঘটছে। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর এক রক্তক্ষয়ী সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি মাফিয়াতান্ত্রিক ও ফ্যাসীবাদী সরকারের পতন হলেও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখনো ইতিবাচক পরিবর্তন ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি বরং শ্রেণি বিশেষের তথাকথিত সংস্কৃতি এবং নানা অপবিশেষণের ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

এতে নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ বরাবই উপেক্ষিত হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে সভ্যতা, ভব্যতা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার কোন তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। মূলত মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অনুপস্থিতির কারণেই আমাদের দেশে ধর্ষণের সংস্কৃতি, হত্যা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের সংস্কৃতি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংস্কৃতি, সিন্ডিকেট সংস্কৃতি, জুলুম-জবরদস্তির সংস্কৃতি, মিথ্যাচারের সংস্কৃতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ঘুষ-দুর্নীতির সংস্কৃতি, ভোট চুরির সংস্কৃতি, পেশিশক্তি প্রদর্শনের সংস্কৃতি, স্বেচ্ছাচারিতার সংস্কৃতি এবং নারী নির্যাতনের সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। এ অশুভ বৃত্ত থেকে আমরা কোন ভাবেই বেড়িয়ে আসতে পারছি না। এক কথায় আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রে মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও অবক্ষয় এমনভাবে শেকড় গেঁড়েছে তা থেকে আমরা কোনভাবে পরিত্রাণ লাভ করতে পারছি না। ফলে মাঝে মাঝে ক্ষমতার হাত বদলের পর আমরা অনেকটা আশাবাদী হয়ে উঠলেও বারবার আশাহতই হতে হয়েছে। গত বছরের রক্তক্ষয়ী আগস্ট বিপ্লবের পর আমরা নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠলেও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অনৈক্যের কারণে আমরা সে মহান বিজয়ের ফসল পুরোপুরি ঘরে তুলতে পারছি না বরং এ নিয়ে নানাবিধ জটিলতা ও আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পতিত এবং তাদের প্রতিভূরা নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করার সুযোগ পাচ্ছে এবং অর্জিত বিজয় নস্যাৎ হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। যা কোন ভাবেই কাম্য নয়।

মূলত, সভ্যতার ক্রমবিকাশ এমন সব কাজের মধ্য দিয়ে হয়, যেগুলো ইতর প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। যেমন আগুনের ব্যবহার, পানির ব্যবহার। মানুষ জলবায়ু ও প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে সফলতা দেখিয়েছে। মানুষ পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাষ্ট্র গঠন করে। তারা বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্রের আছে প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা। মানুষের আছে প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য; সর্বোপরি রাজনীতি ও অর্থনীতি। এসবেরই মধ্যে আছে নৈতিক চেতনা, ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত ও ন্যায়-অন্যায়ের উপলব্ধি। মানুষের বিবেক আছে। বিবেক আর সত্য, ন্যায় ও সুন্দর হলো সভ্যতার মর্মগত অবলম্বন। কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব ও মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয়ের কারণে এসব ক্ষেত্রে আমাদের বিচ্যুতি রীতিমত উদ্বেগজনক পর্যায়েই পৌঁছেছে। যা মানবসভ্যতার ললাটে কলঙ্কতিলক এঁকে দিচ্ছে।

সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সূচনা মানুষের হাত ধরে হলেও তা কলঙ্কিত ও বিতর্কিত হচ্ছে আবার মানুষের অপকর্মের মাধ্যমেই। সে ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সারা বিশ্বেই অনাকাঙ্খিতভাবেই যুদ্ধবিগ্রহ বেড়ে গেছে। সম্প্রতি পাক-ভারত এবং ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ হয়ে গেল কোন প্রকার অর্জন ছাড়াই। ফলাফল শুধুই প্রাণহানী ও ধ্বংসযজ্ঞ। বস্তুত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্বব্যবস্থার কল্যাণকামীতারও ঘটেছে বড় ধরনের বিচ্যুতি। আগুন-পানি ও প্রকৃতির ব্যবহার, বৃহত শক্তিগুলো এমনভাবে করে চলছে যে প্রকৃতি মানুষের প্রতিকূল হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন শুধু ক্রমবর্ধমানই নয় বরং তা এখন উদ্বেগজনক পর্যায়েই পৌঁছেছে। সমুদ্রে পানির উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর স্থলভাগের এক-তৃতীংয়াশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিচ্যুতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। কায়েমি স্বার্থে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক বৈশিষ্টগুলো নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের অপব্যবহার বর্বরতা ও ধ্বংসের পালেই হাওয়া দিচ্ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি ব্যবহৃত হচ্ছে শ্রেণি, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি স্বার্থে। সাধারণ মানুষ সব রকম অন্যায়-অবিচার, জুলুম-জবরদস্তি ও মিথ্যাচারকে মেনে নিয়েছে বা নিতে বাধ্য হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই সমাজ-রাষ্ট্রে যারা কর্তৃত্ব করছে তারা অন্ধকারের শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে।

প্রত্যেক জাতির ইতিহাস এক ও অভিন্নও নয়। তবে কিছু বিষয়ে সব জাতির মধ্যে মিলও রয়েছে। তাই সভ্যতার সঙ্কট মোকাবেলায় বহুজাতিক ঐক্যের আবশ্যকতার বিষয়টিও অনস্বীকার্য। তবে সেক্ষেত্রে কোনো জাতিরই নিজস্ব সঙ্কটকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই বা আন্তর্জাতিক কোনো শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকাও উচিত নয়। সেক্ষেত্রে নিজ নিজ সমস্যা নিজ উদ্যোগেই সমাধান করে নেয়া উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় যে অবস্থা চলছে তাতে বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী শক্তিগুলোকে দেখা যাচ্ছে বৈশ্বিক সরকারের ভূমিকা পালন করছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাও প্রশ্নাতীত থাকেনি। চীন ও রাশিয়া কখনো কখনো ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইতিবাচক কিছু করার চেষ্টা করছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ঠ নয়।

সভ্যতার সঙ্কট ও বৈশ্বিক রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে আমরাও মুক্ত নই। আমাদের দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের ইতিবাচক পরিসরে গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল তাও আমরা ইতোমধ্যেই হাতছাড়া করে ফেলেছি। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দীর্ঘ পরিসরে আমাদের দেশে চলেছে বিরাজনীতিকরণ কার্যক্রম। দেশে অগণতান্ত্রিক শাসন ও জুলুমতন্ত্রের কারণেই দেশকে কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টার পরিবর্তে অবৈধ ক্ষমতা চর্চার প্রাধান্য পেয়েছে। দলন-পীড়ন চলেছে ভিন্নমতের ওপর। রাজনৈতিক শক্তিগুলো রাজনীতিকে করে ফেলেছিলো বৃহত শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস অভিমুখী। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গণমুখী করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বিচারব্যবস্থার বিচ্যুতি এবং নির্লজ্জ দলীয়কারণ জনদুর্ভোগের কারণ হওয়ার অভিযোগও উঠেছিলো ব্যাপকভাবে। গণপ্রশাসন ঘুষ-দুর্নীতি ও লাগামহীন স্বেচ্ছাচারে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে বসেছিলো। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এসব কথা সংবিধানে লেখা ছিলো ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলনটা ছিলো খুবই গৌণ।

’৮০-র দশকের শুরু থেকে ক্রমাগত বলা হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা। এর মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তবর্তীকালীন নির্দলীয় সরকার গেছে, গেছে জরুরি অবস্থাও। কিন্তু সার্বিক অবস্থার ক্রমাবনতিই হয়েছে বলতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সব প্রতিষ্ঠানগুলো স্বকীয়তা হারিয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেই নিকট অতীতে গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ বানানো হয়েছিলো। দেশ ও জাতি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার উপযোগী রাজনৈতিক শক্তির শূণ্যতা বোধ করছিলো। রাষ্ট্রাচারের বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের জয়জয়কারের কারণেই পরিবারব্যবস্থা দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। লাগামহীন বিবাহবিচ্ছেদ, পরকীয়া, স্বামী-স্ত্রীতে কলহ-সন্দেহ ও অবিশ্বাস, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা ছিলো নিত্য সঙ্গী। আর নারী নিগ্রহ ও ধর্ষণ তো এখন প্রায় ক্ষেত্রেই অপ্রতিরোধ্যই হয়ে পড়েছে। এমনকি নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা আগের তুলনায় আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হলেও স্বাধীন গণমাধ্যমের স্বপ্ন ছিলো পুরোপুরি অধরা। গণমাধ্যমের ওপর নিবর্তন, নিষেধাজ্ঞা, সাংবাদিক নির্যাতন, হামলা, মামলা এমনকি হত্যার মত জঘণ্য ঘটনাও ছিলো নিত্যসঙ্গী। তাই আমাদের দেশের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি বিকশিত হয়নি। তবে জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন করে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সংকটটা এখনো পুরোপুরি কেটে যায়নি।

মূলত, মূল্যবোধহীন ধর্মবিবর্জিত সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতিই মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিশ্বে যতগুলো ফলপ্রসূ সভ্যতা ও বিপ্লব এসেছে তার সবই আদর্শ ও মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরেই। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, অষ্টাদশ শতকে ফরাসিদের মধ্যে যে দু’টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যেত, তা হলোÑমূল্যবোধ ও ন্যায্যতা। ফলে তারা একটি সফল ও সার্থক বিপ্লব সাধনে সমর্থ হয়েছিল। সমসাময়িককালে ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা ফরাসিদের সাথে তুলনীয় না হলেও সে সময় ভারতবর্ষে যে মূল্যবোধের চর্চা ছিল না, তা বলা যাবে না। তবে এক রূঢ় বাস্তবতায় মূল্যবোধ ও নায্যতার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থা একেবারে প্রান্তিকতায় এসে ঠেকেছে। যা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যকেই দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বস্তুত, মূল্যবোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাগ্রত হয় না বরং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে এ জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি সৃষ্টি করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রই নাগরিকের সবকিছুই দেখভাল করে, তাই মূল্যবোধের লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। তাই নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের প্রথম কর্তব্য হবে নৈতিকশিক্ষা, মূলবোধের চর্চা ও সুস্থ্যধারার সংস্কৃতি উৎসাহিত করে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। তাহলেই সভ্যতার উৎকর্ষতাকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

এ ক্ষেত্রে সুশিক্ষাই কাঙ্খিত ও প্রত্যাশিত। কেউ যখন সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে তখন তার মধ্যে সয়ংক্রিয়ভাবেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়; ব্যক্তি হয়ে ওঠে সংস্কৃতিবান। তিনি অবক্ষয় মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। আর তা ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্য প্রয়োজন হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনুকূল পরিবেশ বা পৃষ্ঠপোষকতা। সুশিক্ষিত তিনিই যিনি তার শিক্ষাকে সৎ আর ন্যায়ের পথে নিয়োজিত করেন। যৌক্তিক বিষয়াদিকে যৌক্তিক বোঝার পর নিজ স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে, অযৌক্তিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত গ্রহণ করেন।

সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের চর্চার সাথে রাজনীতির নিবিরতম সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, রাজনীতির পরিসর খুবই বৃহত। রাজনীতি দেশ ও জনগণের আমূল কল্যাণের জন্য আবর্তিত হয়। এতে মূল্যবোধ আর ন্যায্যতার ভিত্তি মজবুত না থাকলে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই হয় বেশি। রাজনীতিকদের যদি মূল্যবোধের স্তর নিম্নমানের হয় তবে তা আর রাজনীতি থাকে না বরং অপরাজনীতি হিসেবে আখ্যা পায়। এর কুপ্রভাবে হাজারো মূল্যবোধ নষ্ট হয়। ব্যক্তির মূল্যবোধ নষ্ট হলে ক্ষতি শুধু একজনের কিন্তু শাসক শ্রেণির মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

মূলত, সভ্যতার সঙ্কট, সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মবিমুখতা, ধর্মের অপব্যবহার ও ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের মতো আরো কিছু বিষয়। ধর্মের যথাযথ চর্চা ও অনুশীলন কখনোই ধর্মান্ধতা শেখায় না বরং ধর্মীয় আদর্শের মাধ্যমেই ধর্মান্ধতার অভিশাপ মুক্ত হওয়া সম্ভব। ধর্মই মানুষের জীবনপ্রণালী অন্যান্য ইতর প্রাণী থেকে আলাদা করেছে; মানুষকে সভ্য, সংবেদনশীল ও পরিশীলিত করেছে। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে আমরা ধর্মকে মনে করি এগিয়ে চলার পথের প্রধান অন্তরায়। কিন্তু বাস্তবতা সে ধারণার অনুকূলে কথা বলে না।

বস্তুত, প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটি ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে গড়ে উঠেছে। তাই একটি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি সৃষ্টি ও অবক্ষয়হীন সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে নাগরিকদের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি, ধর্মীয় আদর্শের সম্প্রসারণ, মূল্যবোধের লালন ও অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। তাই আগস্ট বিপ্লবের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অর্জিত বিজয়কে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ করতে হলে আমাদেরকে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে। মনীষী সাইয়্যেদ কুতুবের ভাষায়, ‘যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে সে সমাজই সভ্য সমাজ’। মূলত মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে গতিশীল ও সুস্থ্য ধারার সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব। অন্যথায় সভ্যতার সঙ্কট ও সংঘাত মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না বরং সভ্যতার অধঃপতনই অনিবার্য হয়ে উঠবে।