রাজনীতিসহ নানাবিধ কারণে আমরা এমন খুব বেশি অস্থির সময় পার করছি। এমন কোনো দিন নেই যেদিন আমাদের সামনে নতুন করে কোনো ইস্যু সামনে আসছে না। তাছাড়া জাগতিক জীবনের অসংখ্য টানাপোড়েন ও সংকটও আমাদের ব্যস্ত থাকতে বাধ্য করছে। আমি নিজেও যেমন মৌলিক অনেক কাজের কথা ভুলে যাচ্ছি। গঠনমূলক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময় বের করতে পারর্ছি না। তেমনি আরো অনেককেই জানার সুযোগ হচ্ছে, যাদের আমল ও ইবাদতের মাত্রাও নানাবিধ ব্যস্ততায় আগের তুলনায় কমে এসেছে। তবে টালমাটাল ও অস্থির সময়ের মধ্যেও আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর ওপর আমরা যারা ঈমান এনেছি অন্তত আমাদের মনে রাখা উচিত যে, আমরা এ মুূহূর্তে বছরের শ্রেষ্ঠ ১০ দিন পার করছি।

মানবজীবনে কিছু সময় আছে যেগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত ও ফজিলতের বার্তা নিয়ে আসে। ঠিক তেমনিভাবে, হিজরি বর্ষপঞ্জির শেষ মাস জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন এমন একটি সময় যা আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য অনন্য বরকত ও অফুরন্ত সওয়াবের সুযোগ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। কুরআন ও সহিহ হাদিসে এ দশ দিনের গুরুত্ব এতটাই উচ্চতর যে, বছরের অন্য কোনো দিন এমন মর্যাদার সমকক্ষ নয়। এ দশ দিন শুধু হজ পালনকারীদের জন্য নয়, বরং মক্কার বাইরে বিশ্বের নানা স্থানে যারা ঘরে বসেই আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করে, তাদের জন্যও এটি আত্মশুদ্ধি, গুনাহ মাফ ও জান্নাতের সওগাত অর্জনের এক অনন্য সুযোগ।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “আল্লাহর কাছে কোনো দিনই সেসব দিনের চেয়ে অধিক প্রিয় নয়, যেসব দিনে সৎকাজ করা হয়। এক্ষেত্রে তিনি জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের কথা বলেছেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও কি এর চেয়ে উত্তম নয়? তিনি বললেন: “আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও না-তবে কেউ যদি নিজের জান ও মাল নিয়ে বের হয় এবং সে কিছুই নিয়ে ফিরে না আসে (অর্থাৎ শহীদ হয়), তাহলে তা ব্যতিক্রম।” (মুসলিম: ৯৬৯)

জিলহজ্জ মাসের এ নেয়ামতগুলোর প্রেক্ষাপটগুলো বোঝা খুব জরুরি। একজন মানুষ, হজরত ইবরাহীম (আ.) এর তাকওয়া, আরেকজন মানুষ বিবি হাজেরার সবর আর তাদের সন্তান ইসমাইল (আ.) এর কুরবানি- এ তিনটি বিষয়কে আল্লাহ তাআলা এত পছন্দ করেছেন, এতটা সম্মানিত করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা তাদের কিছু কার্যক্রমকে, তাদের লিগেসিকে শরীয়াতের বিধান বানিয়ে দিয়েছেন। সুবহানআল্লাহ, আল্লাহু আকবার। এ মানুষগুলো যে পথ দিয়ে হেঁটেছেন, যে কাজগুলো করেছেন সবগুলোই যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরাও সেগুলোই করে যাচ্ছি যাতে করে এ মহান ও কীর্তিমান মানুষগুলোর ঐতিহাসিক ও অনন্যসাধারণ সব মানবিক গুণাবলি আমরা বারবার স্মরণ ও ধারণ করতে পারি। এটি হজ্জের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য যা অনেক সময়ই সেভাবে আলোচিত হয় না।

যারা এ সময়ে হজ্জে যেতে পারলেন তারা সৌভাগ্যবান। তারা তাদের হজ্জের নিয়মিত আচারাদি ও আনুষ্ঠানিকতা পালন করবেন। কিন্তু যারা যেতে পারলেন না তারা এ ১০ দিনে নেক আমল অনুশীলন করতে পারেন। মনে রাখবেন এ ১০ দিনে যে কোনো ভালো কাজ করার সাওয়াব বছরের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষ করে আরাফাহ’র দিন অর্থাৎ ৯ জিলহজ্জে আমাদের আমল বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যারা সেদিন আরাফাহ’তে থাকবেন তারা তাদের আমল করবেন, দোয়া করবেন। আরাফাহ’র ময়দানে আরাফার দিনে দোয়া ও আমল নিয়ে রাসূল (সা.)-এর একাধিক হাদিস আছে। কিন্তু যারা আরাফাহ’তে যেতে পারবেন না, তারা ঘরে বসে টিভি দেখবেন অথবা সাদামাটা কাজ করবেন- এমনটা হওয়া কাম্য নয়।

আরাফাহ’র দিন রোজা রাখা যায়। আমাদের সালাফগণ এ দিনটিতে ঘরে বসে না থেকে মসজিদে এসে থাকতেন। বাড়তি নামাজ, তেলাওয়াত, জিকির ও দুআ করতেন। যত বেশি সম্ভব দুআ করতেন। বেশি বেশি করে দান ও সাদাকা করতেন। স্কলাররা বলেছেন, রমজানের শেষ ১০ রাত হলো সবচেয়ে বরকতময়। আর দিনের ক্ষেত্রে হিসেব করলে জিলহজ্জ মাসের ১০ দিন সবচেয়ে বরকতময় ও উত্তম। উল্লেখ্য, অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে-এ দশটি দিন বেশি উত্তম নাকি রমযান মাসের শেষ দশ দিন? এ প্রশ্নের জবাবে ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘জিলহজ্জের প্রথম দশকের দিনগুলি রমজানের শেষ দশকের দিনগুলির চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। আর রমজানের শেষ দশকের রাতগুলি জিলহজ্জের প্রথম দশকের রাতগুলোর তুলনায় শ্রেষ্ঠতর।”

ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর এ উক্তি প্রসঙ্গে ইবনে কাইয়েম (রহ.) বলেন, ‘এ উত্তর নিয়ে যদি কোন যোগ্য ও জ্ঞানী ব্যক্তি গভীরভাবে চিন্তা করেন, তাহ’লে তা সন্তোষজনক ও যথেষ্টরূপে পাবেন। যেহেতু দশ দিন ছাড়া অন্য কোনো দিন নেই যার মধ্যে করা নেক আমল আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় হতে পারে। তাছাড়া এতে রয়েছে আরাফার দিন, কুরবানী ও তালবিয়া (৮ই জিলহজ্জে)র দিন। পক্ষান্তরে রমজানের শেষ দশকের রাত্রিগুলি হলো জাগরণের রাত্রি। যে রাতগুলোতে রাসূল (সা.) রাত জেগে ইবাদত করতেন। আর তাতে রয়েছে এমন একটি রাত, যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর’। (যা’দুল মা’আদ: ১/৫৭)

জিলহজ্জ মাসের এ ১০ দিনে আমল করার ক্ষেত্রে আমরা যেন ভুলে না যাই-এ বরকতময় মাসের আমলগুলো যে নবির সাথে সম্পৃক্ত সে হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর জন্মভূমি ফিলিস্তিনের কথা। ফিলিস্তিনবাসী গত প্রায় দেড় বছর যাবত যে কষ্ট করছেন, কুরবানি করছেন, তা যেন আমাদের বিবেচনায় থাকে। আল্লাহ তাআলা ফিলিস্তিনের এ ভূমিকে কবুল করেছেন। এ ভূমি হাজার হাজার নবি-রাসূলের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে বারবার। আমরা যেন ভুলে না যাই, আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহীম (আ.) এর সন্তান হজরত ইসহাক (আ.) এর বংশধরকেও নেয়ামত দান করেছিলেন। কিন্তু তারা অকৃতজ্ঞ ও গাফেল হয়ে যাওয়ায় আল্লাহ তাদের কাছ থেকে সেই নেয়ামত কেড়ে নিয়ে সত্যনিষ্ঠ অনুসারীদেরকে দান করেছেন। আর এ অনুসারীরা হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর উম্মাহ আর আমাদের নবিজি (সা.) ও হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর আরেক সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর-যিনি তাকওয়া ও কুরবানির অসাধারণ সব দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

প্রকৃতপক্ষে আমরাই হজরত ইবরাহীম (আ.) এর অনুসারী, তার প্রকৃত লিগেসি। আর আমাদের এ উম্মতের ভাই ও বোনেরা এখন ইবরাহীম (আ.) এর জন্মভূমি ও পূন্যভূমি ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করার জন্য জীবন দিয়ে যাচ্ছে, ক্ষুধার কষ্টে আর বোমার আঘাতে নিত্যদিন গণহত্যার শিকার হচ্ছে। এগুলো দেখে আমরা অনেক সময় হতাশ হয়ে যাই কিন্তু মনে রাখবেন আশা ছাড়া যাবে না। শহীদের রক্ত কোনোদিন বৃথা যায় না, এবারও যাবে না। বাতিল শক্তি সাময়িকভাবে যুদ্ধে সফলতা পায় কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় হয় মুমিনের। যারা তাকওয়াবান, সময় তাদের নিয়ন্ত্রণেই আসবে - এটাই জিলহজ্জের শিক্ষা। হজরত ইবরাহীম (আ.) যখন কষ্ট পেয়েছেন, বারবার পরীক্ষায় পড়েছেন, তিনি নিজেও জানতেন না যে, আল্লাহ তাআলা তাকে এতটা সম্মানিত করবেন। তার পরে হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর বংশধর ও উত্তরাধিকারের বাইরে কোনো নবি আসেননি,। শুধু তাই নয়; কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তার পালনকৃত আচারাদি এভাবে পালন করে যাবে; বারবার তাকেই স্মরণ করবে। মূলত যারা সত্যনিষ্ঠ- স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আলোচনায় ও স্মরণে রাখার ব্যবস্থা করে দেন।

বরকতময় এ দিনগুলোতে আমরা

যে আমলগুলো করতে পারি :

১. রোজা রাখা : রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে এ দিনগুলোতে রোজা রাখতেন, আরাফার দিনের রোজা বিশেষ ফজিলতের অধিকারী। ইবনে কাসীর রহ. বলেন, “এটি রোজাদারের জন্য জান্নাতের প্রস্তুতি।”

২. নামাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি : ফরজ নামাজ যথাসময়ে পড়া। বেশি বেশি নফল সালাত (তাহাজ্জুদ, দোহা) আদায় করা।

৩. তাকবীর, তাহলীল ও জিকির : সাহাবীরা ঘরে, বাজারে, রাস্তায় তাকবীর পড়তেন। “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হাম্দ।” ি তাকবিরে তাশরিক একটি ওয়াজিব আমল। জিলহজের ৯ তারিখের ফজর থেকে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত দিনগুলোকে তাশরিকের দিন বলে। এসব দিনে মুসল্লিরা যে তাকবির পড়েন তাকে তাকবিরে তাশরিক বলে। এ তাকবিরে মুসল্লিরা মহান আল্লাহর মহত্ব, বড়ত্ব ও একক সত্ত্বার কথা বলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করেন।

৪. কুরআন তেলাওয়াত: প্রতিদিন কুরআন থেকে অন্তত কিছু অংশ তিলাওয়াত করা।

৫. দান-সাদকা : গরীব-অসহায়দের সহায়তা করা। - হাদিসে আছে, “সাদকা গুনাহ নিভিয়ে দেয় ঠিক যেমন পানি আগুন নিভায়।” (তিরমিজি)

৬. তওবা, ইস্তিগফার ও আত্মসমালোচনা: নিজের জীবনের ভুলগুলো সংশোধন করে আত্মশুদ্ধির দিকে অগ্রসর হওয়া।

৭. কুরবানি : কুরবানির অর্থ হলো-আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মত্যাগের প্রতীকী ঘোষণা। ০ এই দিনগুলোকে কেবল ঈদের প্রস্তুতির জন্য দুনিয়াবি ব্যস্ততায় কাটিয়ে দেওয়া।

আমরা অনেকেই এ সময়গুলোতে

যে ভুলগুলো করি :

নিামাজ ও কুরআনের চর্চা উপেক্ষা করা। কুরবানির প্রকৃত দর্শন না বোঝাÑবরং গোশত খাওয়াকেই কুরবানির উদ্দেশ্য মনে করা।

জিলহজ্জের এ দশ দিন আমাদের জীবনে আর ফিরে নাও আসতে পারে, কিন্তু এটিকে যদি যথাযথভাবে কাজে লাগাই, তবে তা আমাদের জান্নাতের পথে এক স্থায়ী বিনিয়োগ হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন হলো এমন এক সময়, যা শুধুমাত্র হজযাত্রীদের জন্য নয়, বরং প্রতিটি ঈমানদারের জন্য আত্মশুদ্ধি ও নেকির অফুরন্ত সুযোগ। এ সময় এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যেন পরকালে এর সুফল পাওয়া যায়। যদিও এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি দিন চলে গেছে তারপরও এখন থেকেই চেষ্টা করা দরকার যাতে বাকি দিনগুলোকে দুনিয়াবি ব্যস্ততার মোহে হারিয়ে না ফেলে বরং ঈমান, তাকওয়া, আত্মশুদ্ধি ও সওয়াব অর্জনের এক সুবর্ণ নেয়ামত হিসেবে আমরা কাজে লাগাতে পারি। আমিন।