গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস পরিচালিত অপারেশন আল আকসা ফ্লাডের দু’বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আবার গত সপ্তাহেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনার আওতায় আবারও গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ৭ অক্টোবর পরিচালিত অপারেশন আল আকসা ফ্লাডের দৃশ্যমান পরিণতিতে গাজার ধ্বংসস্তূপের চিত্র আমাদের সামনে স্পষ্ট; কিন্তু অপারেশন আল আকসা ফ্লাডের প্রাপ্তি কি এটুকুই? এর কি কোনো সুদূরপ্রসারী প্রাপ্তি বা প্রভাব নেই? সে উত্তরে যাওয়ার আগে ৭ অক্টোবর, ২০২৩ পূর্ববর্তী গাজা নিয়ে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করছি।
১৯৪৮ সালের আরব ইসরাইলী যুদ্ধের সময় মিশর গাজা উপত্যাকা দখল করে নেয়। ১৯৬৭ সালের আরব- ইসরাইল যুদ্ধের আগ পর্যন্ত গাজা মিশরের হাতেই ছিল। ৬৭ সালের যুদ্ধেও পর ইসরাইলীরা পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের পাশাপাশি গাজাও অধিগ্রহণ করে নেয়। প্রকৃতপক্ষে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৭৭ বছর যাবৎ গাজাবাসী বঞ্চনা আর অবহেলার ভেতর দিয়েই দিনযাপন করেছে। ২০০৫ সালে ইসরাইল গাজা থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেয় এবং সেখানে বসবাসরত ৮ হাজার ইহুদি পরিবারকে গাজার আশপাশে এবং পশ্চিম তীরে নতুন করে ২১টি বসতি শিবিরে স্থানান্তরিত করে দেয়। ২০০৭ সালে হামাস গাজা নির্বাচনে জয় লাভ করার পর থেকে ইসরাইল গাজার ওপর সড়ক, নৌ ও আকাশপথে অবরোধ আরোপ করে। তখন থেকেই গাজা অবরুদ্ধ হয়ে আছে। গাজায় কোনো মানুষের প্রবেশ বা বের হওয়া তো দূরের কথা, গাজায় খাবার, ওষুধ বা নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণ ইসরাইলের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে পারতো না। গাজার লোকদের বাইরে যাওয়ার বা অন্য কোথাও গিয়ে কাজ করারও অবকাশ নেই। এ কারণে গাজাকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
২০০৮ সাল থেকে ইসরাইল গাজার অভ্যন্তরে চারবার সামরিক আগ্রাসন ও অভিযান চালিয়েছে। অভিযানগুলো পরিচালিত হয়েছে ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ এবং ২০২১ সালে। এ অভিযানগুলোর কারণে হাজার হাজার ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন যার অধিকাংশই নারী ও শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক। ইসরাইলী এসব অভিযানের পরিণতিতে অসংখ্য বাসাবাড়ি ও অফিস ধ্বংস হয়। পানি ও সুয়ারেজ লাইনের পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে গাজার পানি দূষিত হয়ে যায় এবং সেখানকার মানুষ পানিবাহিত নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। গাজায় যুগ যুগ ধরে চলা ইসরাইলের অবরোধটি গোটা উপত্যাকাকে সব ধরনের পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো সেবাই গাজাবাসী পায়নি। অবরোধের প্রভাবে গাজায় বিশুদ্ধ পানির স্বল্পতা সারাবছরই প্রকটভাবে বিদ্যমান থাকে। সেখানে বিদ্যুতের সরবাহও কম। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে অনেক সময়ই হাসপাতালগুলো রোগীদেরকে জরুরি সেবা প্রদান করতে পারে না। গাজার ৯৭ শতাংশ পানিই দূষিত ও বিষাক্ত জীবানুতে ভরপুর। গাজার বিদ্যুৎ গ্রিডে ইসরাইল প্রায়ই হামলা চালানোর কারণে গাজার মানুষেরা অনেক সময়ই বিদ্যুৎবিহীন জীবনযাপন করে। গাজায় বসবাসরত জনসংখ্যার ৬০ ভাগ প্রচণ্ড দরিদ্রতার মাঝে বসবাস করে। আর সেখানে বেকারত্বের হার ৬৩ শতাংশ। জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বহু বছর যাবৎ অবরোধ চলমান থাকার কারণে গাজার ৮০ শতাংশ বাসিন্দাই এখন পুরোপুরিভাবে আন্তর্জাতিক ত্রাণ ও সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়েই বেঁচে আছে।
হামাস ২০০৭ সালের নির্বাচনের পর থেকে যেহেতু গাজার ক্ষমতাসীন দল তাই গাজাবাসীর প্রতি তাদের কিছু দায়বদ্ধতাও রয়েছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, গাজায় ইসরাইলী অভিযান বন্ধ, আল আকসায় মুসলিমদের হয়রানি ও ইহুদিদের অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং ইসরাইলের কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনী বন্দীদের মুক্ত করার জন্যই হামাস অপারেশন আল আকসা ফ্লাড পরিচালনা করেছে। হামাসের আল আকসা ফ্লাড অভিযানকে নিছক ট্যাকটিকাল জায়গা থেকে না দেখে যদি কৌশলগত অবস্থান থেকে মুল্যায়ন করা যায় তাহলে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, এ হামলার প্রভাব শুধু ফিলিস্তিন নয় বরং নানা আঙ্গিকেই ফিলিস্তিন ইস্যুকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্লেষকরা আরো মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি শান্ত করার নামে যুক্তরাষ্ট্র যে পরিকল্পনা সাজিয়েছিল, হামাসের আক্রমনের কারণে তাও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। হামাসের এ পদক্ষেপের কারণে আরব দেশগুলোর জন্য পরিস্থিতি এখন জটিল হয়ে পড়েছে এবং সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্যে চীন ও রাশিয়ার সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ বেড়েছে। একইসাথে মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের একটি অর্থনৈতিক করিডোর চালুর পথ খোলার চেষ্টাও করা হয়েছিল যা এ অপারেশনের ফলে ভেস্তে গেছে।
হামাসের আক্রমন কার্যত পশ্চিমা অপশক্তির সবগুলো পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। হামাসের অভিযানের কারণে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া থেমে গেছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার যে কাঠামো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তাও ভণ্ডুল হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে আনার মার্কিন পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে এরই মধ্যে ইসরাইলের বানোয়াট বয়াণ ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়েছে। বিগত ৭৭ বছর ধরে, ইসরায়েল অত্যন্ত যত্নসহকারে নিজেদের ভিকটিম হিসেবে একটি ইমেজ তৈরির প্রয়াস চালিয়ে আসছিল, যেখানে তারা নিজেদের উদারপন্থী গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের এক অপ্রতিরোধ্য রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করত। ৭ অক্টোবরের পর ইসরাইলের সে মনগড়া মুখোশ ভেঙে পড়েছে, এবং ইসরায়েলের সুনাম চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্ববাসী এমন সব চিত্র প্রত্যক্ষ করেছে যেখানে তারা ইসরাইলের কল্পনাতীত ধ্বংসযজ্ঞ, অবিরাম বোমাবর্ষণ এবং ৬৭,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখতে পেয়েছে যেখানে নিহতদের বিশাল সংখ্যাই শিশু, নারী ও বয়োবৃদ্ধ।
একইসাথে, ইসরায়েল হামাসকে প্রতিহত করার অজুহাতে যে ‘ক্ষুধানীতি’ গ্রহণ করেছে, তা গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মাঝে আরো বেশি ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এর ফলে এখন ইসরায়েলকে একটি ‘পরিত্যক্ত রাষ্ট্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। লন্ডন, বার্লিন, প্যারিস, মাদ্রিদসহ বিশ্বের প্রধান শহর, পশ্চিমা প্রায় সব দেশ এবং বহু মার্কিন শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাপ্তাহিক প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথমবারের মতো, আমেরিকান জনগণের একটি বড় অংশÑযারা ঐতিহ্যগতভাবে ইসরাইলের অটল মিত্র ছিলÑতারাও এখন ইসরায়েলকে আর নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হিসেবে নয়, বরং হতাশা হিসেবে দেখছে। কয়েক বিলিয়ন ডলার এবং দশকের পর দশক ধরে গঠিত জনসংযোগ ও ইসরাইলের একটি ইতিবাচক ইমেজ নির্মাণ প্রচেষ্টা মাত্র দুই বছরের কম সময়ে সম্পূর্ণভাবে উবে গেছে। এ ক্ষতি অপূরণীয় এবং ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে।
গাজা যুদ্ধের জেরে ইসরায়েলের প্রধান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রও পরাজিত হয়েছে। ইসরাইলকে বিশাল সামরিক সহায়তা প্রদানকারী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও ভাবমূর্তি এ সংঘাতের কারণে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র গাজার ধ্বংসযজ্ঞে ইসরাইলের সহযোগী হয়েছে আর এ কারণে ইসরাইলের পাশবিকতা থেকে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে কোনোভাবেই আলাদা করতে পারছেন না। কেননা বিপুল প্রভাব থাকার পরেও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের কার্যক্রমে কার্যকর হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। অনেকেই বিশ্বাস করে যে যুক্তরাষ্ট্র এ সংঘাতকে উৎসাহিত করেছে এবং এটি দীর্ঘায়িত করেছেÑযেটি সহজেই একটি বন্দি বিনিময় ও দখলদার সেনাদের প্রত্যাহারের মাধ্যমে মাস কয়েক আগেই শেষ করা যেত।
এ যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো গাজা এখন পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাজায় এখন কোনো হাসপাতাল নেই। খাবার নেই। ওষুধ নেই। ইসরাইল সবগুলো হাসপাতাল ধ্বংস করে দিয়েছে। ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স বা এমএসএফ ইসরায়েলের “গাজায় যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধের কথা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে এ চিকিৎসা সংস্থাটি বলেছে, তারা গাজা উপত্যকার ওপর ইসরায়েলি অবরোধকে “কঠোরভাবে নিন্দা জানায়, কেননা এ অবরোধ ফিলিস্তিনী বেসামরিক জনগণকে মৌলিক পরিষেবা ও জরুরি সরবরাহ থেকে বঞ্চিত করছে। ইসরায়েল সবশেষে গাজাকে “সমষ্টিগত শাস্তি দেয়ার কৌশল গ্রহণ করেছে এবং মানবিক সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।
অথচ মানবিক সহায়তা কখনোই যুদ্ধে দর-কষাকষির হাতিয়ার হতে পারে না। সব ধরনের সরবরাহের ওপর অবরোধ লক্ষাধিক মানুষের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে এবং প্রাণঘাতী পরিণতি তৈরি করেছে। গাজার মানুষগুলোই শুধু ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছেন তাই নয়। ইসরাইলী কারাগারে আটক থাকা ফিলিস্তিনীরাও তীব্র খাদ্য সংকট ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সামগ্রীর অভাবে ভুগছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনী বন্দী ও প্রাক্তন বন্দিদের কমিশন। এই তথ্য ফিলিস্তিনী ইনফরমেশন সেন্টারের বরাত দিয়ে গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। কমিশনের একজন আইনজীবী, যিনি সম্প্রতি কারাগারটি পরিদর্শন করেছেন, জানিয়েছেন যে মেগিদ্দো কারাগারের কর্তৃপক্ষ বন্দিদের ব্যথানাশক ওষুধ সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে এবং তাদেরকে কারাগারের চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়াও হচ্ছে না।
তবে ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও কিছু শক্তি বিস্ময়করভাবে লাভবান হয়েছে। এর মধ্যে সবার আগেই বলতে হয় গাজার জনগণ ও ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ আন্দোলন বিশেষ করে হামাস ও ইসলামিক জিহাদের কথা। যদিও বাহ্যত তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এরপরও গাজার জনগণ এবং প্রতিরোধ সংগঠনগুলো এক নজিরবিহীন, অটল দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছে। হামাস ও অন্যান্য সংগঠনগুলো প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে বারবার পরাস্ত করেছে, এবং কৌশলগত সাফল্য ও অভিযোজনশীলতা প্রদর্শন করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, গাজার জনগণ তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার প্রস্তাবগুলো দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে নেতানিয়াহু ও তার পরম মিত্র ট্রাম্পকে গাজা নিয়ে পরিকল্পনা বারবার পাল্টাতে হয়েছে। গাজার মানুষকে সেখান থেকে স্থানচ্যুতির পরিকল্পনাও ভেস্তে গেছে।
চলমান যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে, ফিলিস্তিন ও গাজা পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, সমাবেশ, বিক্ষোভ এবং কূটনৈতিক আড়ালে বেশি আলোচিত হয়েছে। অনেক দেশ, আন্তর্জাতিক সংগঠন ও নাগরিকদের মধ্যে ফিলিস্তিনের কষ্ট ও দাবি সম্পর্কে স্বীকৃতি ও সহানুভূতি বেড়েছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের আপডেট পরিসংখ্যান অনুযায়ী ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের ১৫৭টি সদস্যরাষ্ট্র স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ সংখ্যাটি সমস্ত ইউএন সদস্য দেশের প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি। নতুন-নতুন আরও কিছু পশ্চিমা দেশ ২০২৫-এ স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যেমন ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতা থাকায় আগামীতে জাতিসংঘের যে কোনো প্রস্তাবনায় ফিলিস্তিন সুবিধা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র চাপের মুখে কোনঠাসা হয়ে পড়ায় অপারেশন আল আকসা ফ্লাডের দুই বছর পূর্তির আগেই গাজায় আরেকদফা যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে বাধ্য হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই এবারের শান্তি পরিকল্পনার প্রস্তাব দিয়েছেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার লোভে তিনি ইসরাইলকে কিছু সুবিধা দিয়েই এই চুক্তির আয়োজন করেছেন যার গ্যারান্টর দেশ হয়েছে মিশর, তুরস্ক ও কাতার। গাজায় ইসরাইলী সেনাদের দু একটি বিচ্ছিন্ন আক্রমন হলেও সামগ্রিক অর্থে আপাতত যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। এ লেখাটি যখন লিখছি, তখন গাজার অনেক এলাকা থেকেই ইসরাইলী সেনাদের প্রত্যাহারও করে নেয়া হয়েছে। এবারের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে কে জিতল, কে হারল? সে প্রশ্নের উত্তরে সরেজমিন বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, ফিলিস্তিনীরাই আপাতত বিজয়ী হয়েছে। এটি অনুধাবন করার সহজ মানদণ্ড হলো বিদ্যমান বাস্তবতা। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার থেকেই ফিলিস্তিনীরা উল্লাস করছে। অপরদিকে ইজরাইলিদের ভেতর নেমে এসেছে কবরের নিস্তব্ধতা। গাজায় আঁটকে পড়া জিম্মিদের আত্মীয়-স্বজন ছাড়া ইসরাইলের কোনো উল্লাস চিত্র আমাদের চোখে পড়েনি।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় ফিলিস্তিনে আবারও খাবারসহ জীবনরক্ষাকারী সব ত্রাণ প্রবেশ করবে। যে যার এলাকায় ফিরবে। ইসরাইলী সেনারা রেডলাইন থেকে সরে যাবে। আপাতত ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামীদের সবচেয়ে বড়ো বিজয় হলো তারা ফিলিস্তিনকে আলোচনায় রাখতে পেরেছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা মতে ফিলিস্তিনকে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার চেতনা ম্লান হওয়ার পরিবর্তে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। হামাসসহ কোনো মুক্তিকামী সংগঠনকেই ইসরাইল তাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। অন্যদিকে, খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই বলছেন, ইসরাইল গোটা বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ২০২৩ সালের পর থেকে নিয়মিতভাবেই এ দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে যেখানেই নেতানিয়াহু বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়েছেন সেখানেই সব দেশের প্রতিনিধিরা তাকে বয়কট করেছেন। ইসরাইল অর্থনৈতিকভাবেও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ও আর্থিক সহায়তা না দিলে ইসরাইলের যুদ্ধ পরিচালনা তো দূরের কথা টিকে থাকাও কঠিন হয়ে যেত। তাই আপাতদৃষ্টিতে সম্পদ ও জানমালের ক্ষতি হলেও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিফলে যায়নি; বরং গাজা যুদ্ধের দু’বছরে এসে এটি স্পষ্ট যে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম আগের তুলনায় আরো অনেক বেশি জোরদার হয়েছে।