ভারতজুড়ে মুসলিমদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার চলছে। বিশেষ করে গুজরাটের মুসলমানদের ওপর যা চলছে তা রীতিমত অমানবিক এবং গর্হিত অপরাধ। বলা হচ্ছে, ভারতের গুজরাট রাজ্যে শনিবার ভোর রাত থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত দিন দিনে সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে তারা আটক করেছে। যারা বাংলাদেশী নাগরিক বলে পুলিশের সন্দেহ। শনিবার ভোর রাত থেকে প্রথমে আহমেদাবাদ ও সুরাটে এবং তারপরের দুদিনে পুরো গুজরাটেই কথিত বাংলাদেশী আটক করার জন্য অপারেশন চালিয়েছে গুজরাট পুলিশ।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানিয়েছে, সুরাট থেকে বাংলাদেশী সন্দেহে আটক হওয়া সুলতান মল্লিকের স্ত্রী সাহিনা বিবি বলেন, রাত তিনটে নাগাদ পুলিশ আসে আমাদের বাসায়। আমার স্বামী, বাচ্চাদের সবার আধার কার্ড দেখতে চায়। তারপরে তারা আমার স্বামী আর দু’ভাগ্নেকে নিয়ে যায়। ওরা বলেছিল যে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে আমার স্বামী। কিন্তু প্রায় তিন দিন হতে চলল, তিনি ফেরেননি। মূলত যেদিন প্রথম অপারেশন শুরু হয়, সেদিনই আটক হন মল্লিক ও তার দু’কিশোর ভাগ্নে। বাংলাদেশী সন্দেহেই এদের আটক করা হয়। তবে বিবিসি বাংলার হাতে মল্লিকের পাসপোর্ট ও ১৯৯৩ সালের একটি জমির দলিল হাতে এসেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর অঞ্চলের বাসিন্দা।
সুলতান মল্লিক বছর ছয়েক ধরে সুরাটে এমব্রয়ডারির কাজ করেন। তার স্ত্রীর কথায়, ‘প্রথমে তো জানতেই পারিনি যে কোন থানায় নিয়ে গেছে, কোথায় রেখেছে। শনিবার আমার স্বামী পুলিশের একটা নম্বর থেকেই ফোন করে জানায়, তাদের কোনো একটা গুদাম ঘরে রেখেছে। সব নথি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে বলেন আমার স্বামী। পাসপোর্ট, জমির দলিল যা যা প্রমাণ ছিল, সব পাঠিয়েছি। কিন্তু তারপর থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত আর কোনো যোগাযোগ নেই। শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তার ছেলের এ দশা দেখে, আমার বড় মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। মাত্র এক বছর হলো আমি গুজরাটে এসেছি এখন কোথায় স্বামীর খোঁজ করতে যাব বুঝতে পারছি না।’
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে, এমন একটি সংগঠন ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’ গুজরাটের ধরপাকড় শুরু হওয়ার পরে একটি হেল্পলাইন খুলেছে। প্রিয়জনের খোঁজ পাওয়ার জন্য ওই হেল্প লাইনে দুদিনে প্রিয়জনের খোঁজ না পাওয়া একশোরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানাচ্ছিলেন সংগঠনটির রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক। তিনি বলছেন, গুজরাটে সংখ্যাটা বড়, তাই বিষয়টা ব্যাপক আলোচনায় উঠে এসেছে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা আর মহারাষ্ট্রেও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশী’ তকমা দিয়ে হেনস্তা করার ঘটনা সম্প্রতি উদ্বেগজনক বেড়ে গেছে। তার কথায়, আরও একটা গুরুতর বিষয় জানতে পারলাম মল্লিকের ব্যাপারে। আটক হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আদালতে পেশ করার কথা। কিন্তু তিনদিন হয়ে গেল তাদের আটক করা হয়েছে, আদালতে কেন পেশ করা হল না এখনও!
বিবিসির বর্ণনায় ভারতের মুসলিমদের ওপর আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানের বর্ণনা দেখলে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলের দৃশ্য মনে পড়ে যায়। ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময় একইভাবে প্রতিবাদ বা গণতন্ত্রের কথা বলা হলে কিংবা ইসলামের কথা বলা হলে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী তুলে নিয়ে যেত। জঙ্গি নাটক সাজাতো। আইন-বিধির তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছে মতো গুম করে রেখে দিতো। এতো গেলো হাসিনার আমলের কথা।
কথিত বাংলাদেশীদের খোঁজে পুলিশ অপারেশন শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে আহমেদাবাদ পুলিশের ‘ক্রাইম ব্রাঞ্চ’ দফতরের সামনে বিবিসির গুজরাট সংবাদদাতা তেজশ ভৈদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ফারজানার। মেহেন্দি করা হাত দেখিয়ে ফারজানা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে একটা বিয়ের কার্ড বের করলেন। ফারজানা বললেন, বাড়িতে বিয়ে আছে। বরযাত্রীরা এসেছিল। আমাদের বাড়ি খুবই ছোট। তাই তাদের ঘুমোনোর ব্যবস্থা করেছিলাম চান্দোলা এলাকায় এক আত্মীয়র বাড়িতে। সেখান থেকেই বাংলাদেশী সন্দেহ করে বরযাত্রীদের ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। তিনি বলেন, মহারাষ্ট্রের আকোলা থেকে এসেছিল আমার বড় ভাই আর ভাতিজা। তারা না থাকলে কী করে বিয়ে হবে? ওইদিনই বাড়িতে হলদি (গায়ে হলুদ) অনুষ্ঠান ছিল। সেটাও পিছিয়ে দিতে হয়েছে। তাদের বিয়েতেই সপরিবারে এসেছিলেন জেবুন্নেসা। তার ছেলে আর ভগ্নীপতিকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছিল ‘বাংলাদেশী’ সন্দেহে।
তার কথায়, আমরা মহারাষ্ট্রের আকোলা থেকে বিয়েতে যোগ দিতে এসেছিলাম বরযাত্রী হিসাবে। আমাদের কাছে জন্মের প্রশংসাপত্র থেকে শুরু করে আধার কার্ড সব আছে। বিয়ে বাড়ি ছেড়ে সারাদিন খাওয়া দাওয়া না করে তারা বসেছিলেন ক্রাইম ব্রাঞ্চের দফতরে। সব নথিপত্র জমা দেওয়ার পরে শনিবার রাত সাড়ে দশটার দিকে সবাইকে ছাড়া হয়। ফারজানা বা তার আত্মীয়রা কেউ বাংলাদেশী নন। এমনকি বাংলাভাষীও নন। তারা গুজরাট আর মহারাষ্ট্রের মুসলমান। তিনি বলছিলেন, আমি তো সৈয়দবাড়ি মোহাম্মদী মসজিদ এলাকায় থাকি। গত ২৩ বছর ধরেই আহমেদাবাদে আছি। আমার ছেলে রিয়াজের শ্বশুরবাড়ি চান্দোলা ঝিল এলাকায়। রাতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল ও, সেখান থেকে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আমার পুত্রবধূকেও আটক করা হয়েছে। তিনি বলছেন, আমাদের কাছে আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র, আয়কর বিভাগের প্যান কার্ড, বিদ্যুতের বিল ইত্যাদি সব নথিই আছে। পুলিশ আমাকে জানায়, সব নথি নিয়ে এখানে হাজির হলে ছেলে আর ওর বউকে ছেড়ে দেবে। সকাল দশটা থেকে এখানে বসে আছি। রাত দশটা নাগাদ তার ছেলে ও পুত্রবধূকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তবে আবারও তাদের দেখা করতে বলা হয়েছে। আলম আরা পাঠান বলছিলেন, আমরা তো বাংলাদেশ থেকে আসিনি, অপরাধও করিনি। আমার সন্তানরা এখানেই জন্মিয়েছে। তবুও বুঝতে পারছি না । ছেলে আর তার স্ত্রীকে কেন আটক করা হলো।
গুজরাট পুলিশের সন্দেহ আধার কার্ড বা ভোটার পরিচয়পত্রসহ নথি বাংলাদেশীরাও বানিয়ে নিতে পারে। তাই গুজরাট পুলিশ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়সহ বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া কয়েকটি রাজ্যে তাদের দল পাঠাচ্ছে। যেসব পরিচয়পত্র জমা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আসল না কি নকল, সেটা সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবে গুজরাট পুলিশের দলগুলো।
এদিকে ভারতের মিডিয়াগুলো বলছে, ভারতে অবৈধভাবে বসবাসের অভিযোগে মুসলমানদের বসতবাড়ি ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করেছে গুজরাট প্রশাসন। ২০০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করে অবৈধ স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করে আমেদাবাদ মিউনিসিপাল কর্পোরেশন (এএমসি)। এ কাজে ব্যবহার করা হয় ৫০টির বেশি জেসিবি, শতাধিক কর্মচারী ও নিরাপত্তারক্ষী। আমেদাবাদের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) শারদ সিংহল জানিয়েছেন, চাণ্ডোলা লেক পার্শ্ববর্তী সিয়াসতনগর বাংলাভাস এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ নাগরিকরা বসবাস করে। তিনি জানান এর আগে ২০০৯ সালে উচ্ছেদ অভিযান চলেছিল। তারপরেও অবৈধভাবে এই স্থাপনাগুলি নির্মাণ করা হয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে আমেদাবাদ মিউসিপাল কর্পোরেশন জানতে পারে যে, সরকারি জামিতে এই অবৈধ স্থাপনাগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এই অভিযানকে কেন্দ্র করে যাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে পুলিশি বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে। ৫০টি জেসিবি কাজ করছে। পাশাপাশি দুই হাজারের মতো পুলিশ সদস্য মোতায়েন রাখা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইউটিউবের ভিডিওগুলোতে দেখা যায় ভারতীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় কিছু উগ্র মানুষ অসহায় মানুষগুলোকে অত্যাচার করছে। বাড়িঘর তছনছ করে দিচ্ছে। নারী ও শিশুরা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। তাদের দিকে কোন দৃষ্টি দিচ্ছে না কেউ। এমতাবস্থায় মানবাধিকার কোন কর্মীকে জোরালো বিবৃতি দিতে কিংবা কোন রকম প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না।
‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’ বলছে তাদের কাছে সারাদেশ থেকে অন্তত একশোটি অভিযোগ জমা পড়েছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে ‘বাংলাদেশী’ অভিহিত করে হেনস্তা, মারধর করা হয়েছে। ওই সংগঠনটির কাছে অভিযোগ এসেছে যে, ১৮ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার ২৩ জন ফেরিওয়ালাকে উত্তরপ্রদেশের কুশিনগরে বাংলাদেশী তকমা লাগিয়ে দেয় ও বাংলাভাষায় কথা বলার জন্য মারধর করে স্থানীয়রা। এরপরে ওই আক্রান্তদেরই পুলিশ তাদের হেফাজতে নেয়, একদিন পরে তারা ছাড়া পান। আবার ২১ এপ্রিল মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ থেকে ৬০ জন পরিযায়ী শ্রমিক বাসে করে কর্মক্ষেত্র ওড়িশার কেওনঝড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন বলে জানাচ্ছে ওই সংগঠনটি। ওড়িশির ময়ূরভঞ্জ জেলার জসিপুরে সকাল বেলায় বাস পৌঁছনোর পর স্থানীয়রা তাদের বাংলাদেশী বলে হেনস্তা মারধর করে। তারা মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন। ওই মুর্শিদাবাদেরই সামশেরগঞ্জের এক বাসিন্দা ঈদের পর ফেরিওয়ালা হিসেবে জিনিসপত্র বিক্রি করতে ওড়িশার ভদ্রক টাউন থানা এলাকায় গেলে তাকে ‘বাংলাদেশী’ তকমা দিয়ে হেনস্তা করা হয় বলে অভিযোগ পেয়েছে ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’।
সংগঠনটির প্রধান আসিফ ফারুক বলছিলেন, এরকম প্রচুর অভিযোগ পাচ্ছি আমরা। সেই ২০১৪ সাল থেকেই এগুলো চলছে আর দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। পহেলগামের হত্যাকাণ্ডের পরে তো আরও বেড়েছে এটা। কোথাও স্থানীয় পুলিশ, কোথাও বা ছোটখাটো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের লোকজন পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্তা করছে, মারধর করছে। সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশী তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলছেন, ভারতের নাগরিক হিসাবে কী দেশের যে কোনো জায়গায় গিয়ে কাজ করার বা ব্যবসা করার অধিকার নেই বাংলাভাষী আর মুসলমান বলে?
উল্লেখিত ঘটনার পর সামনে আসে হাসিনার পলায়নের পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি অর্থাৎ প্রফেসর ইউনূসের সময় শুরু হওয়ার পর ভারতের পক্ষ থেকে একচেটিয়া বলা হলো বাংলাদেশে সনাতন ধর্মী মানুষের ওপর ব্যাপক অত্যাচার করা হচ্ছে। ভারতের মিডিয়া এবং মানবাধিকার কর্মীরা বিষয়টি নিয়ে এতো সোচ্চার ছিল যে, মনে হয়েছিল বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন করে ছাড়বে। এখন যদি বলি, ভারতে আজ মুসলমান হওয়ার কারণে আটক করে গুম করে দেওয়া হচ্ছে। বিয়ে বাড়ি থেকে লোকজন তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কথিত বাংলাদেশী। মুসলমান হওয়ার কারণে। তাহলে আজ কি সেখানে মানবতা লঙ্ঘন হচ্ছে না? সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে না? আজ মানবতার ধ্বজাধারীরা কোথায়? আজ তোমাদের প্রাণ কেঁপে উঠছে না কেন? কী অপরাধ ভারতের মুসলমানদের? তারা মুসলমান এটাই কি তাদের অপরাধ?
লেখক : সাংবাদিক।