আসিফ আরসালান
জুলাই সনদ অবশেষে ঐকমত্য কমিশনের সুরম্য অট্টালিকা থেকে রাজপথে গড়ালো। এটা মোটেই বাঞ্ছিত ছিলো না। কিন্তু কেনো এমন হলো? ৩২টি রাজনৈতিক দলের সাথে ঐকমত্য কমিশন ডায়ালগ শুরু করেছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। এখন সেপ্টেম্বর মাস পার হওয়ার উপক্রম। অর্থাৎ প্রায় ৮ মাস পার হয়ে গেছে। এভাবে কি সংস্কার হয়? কে বা কারা এমন অনভিপ্রেত পরিস্থিতির জন দায়ী?
সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে এসে গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর বিমানবন্দরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আলোচনা যেখানে চলমান, সেখানে রাজপথে আন্দোলন কেনো? এ কেনোর উত্তর দিতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। এতদিন আমরা যেটা করিনি। কিন্তু এখন সেটা করতে হচ্ছে। আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই।
গত বছরের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা তার দলবলসহ ভারতে পালিয়ে গেলেন। কিন্তু যাওয়ার আগে দেশটাকে তিনি কোন অবস্থায় রেখে গেছেন? ৫ অগাস্ট বেলা ৪টার পর থেকে বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিলো না। ৬ ও ৭ তারিখেও কোনো সরকার ছিলো না। ৮ অগাস্ট রাত ৮টার সময় ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করে।
এখানে কয়েকটি জ¦লন্ত প্রশ্ন এসে যায়। প্রথম কথা হলো, ৫ অগাস্ট ৪টা থেকে ৮ অগাস্ট রাত ৮টা পর্যন্ত এই ৭৬ ঘন্টা বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিলো না। কিন্তু ৬ অগাস্ট জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। কে ভেঙে দিলেন? কার নির্দেশে ভেঙে দেওয়া হলো? এগুলোর কোনো জবাব নেই। ৮ অগাস্ট দিনের প্রথম প্রহরে সংবিধানের ১০৬ ধারা মোতাবেক অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের মতামত চাওয়া হয়। সুপ্রীমকোর্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন বৈধ বলে মতামত দেন। প্রশ্ন হলো, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রীম কোর্টে রেফারেন্স কে পাঠিয়েছিলেন? কার নির্দেশে বা কোন সিদ্ধান্ত বলে সুপ্রীম কোর্টের মতামত চাওয়া হয়েছিলো?
এসবের কোনো সাংবিধানিক জবাব নেই। আর জবাব থাকার কথাও না। কারণ সংবিধানের পথ ধরে তো আর জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। তাই শেখ হাসিনা পদত্যাগ করুন বা না করুন তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। ড. ইউনূসের সরকার বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান থেকে উদ্ভূত সরকার। এটি কোনো সাংবিধানিক সরকার নয়। তাই সাংবিধানিক বৈধতার জন্য কোনো আইন আদালতের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই।
বিপ্লবের কাছে সব আইন এমনকি সংবিধানও Subordinate- বা অধীন। বিপ্লবই সর্বোচ্চ আইন। প্রশ্ন হলো, ৫ আগস্টের পর কি কোনো বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়েছিলো? উত্তর, হয়নি। কেনো হয়নি? বিপ্লবী সরকার গঠনের কোনো প্রস্তাব কি উঠেছিলো? উঠে থাকলে কারা বাধা দিয়েছিলেন? তখন তো কোনো পার্লামেন্ট ছিলো না। ছিলো না কোনো মন্ত্রিসভা। তাহলে বাধাটা কে দিলো? যিনিই বাধা দিয়ে থাকুন না কেনো, কোন অধিকার বলে তিনি বা তারা বাধা দিলেন?
৫ তারিখে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন, আন্দোলনের অবসান হলো। আর ৭ অগাস্ট মাত্র একদিন পর নয়াপল্টনে বিএনপি জনসভা করলো। সে জনসভায় মির্জা ফখরুল এবং তারেক রহমান ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেন। মির্জা ফখরুল বা তারেক রহমান কার কাছে নির্বাচন দাবি করেন? তখন তো কোনো সরকারই ছিলো না।
যে বা যারাই করুক, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রীম কোর্টের কাছে রেফারেন্স পাঠানোর মধ্যেই রয়েছে বিরাট রহস্য। এ রেফারেন্স পাঠানো এবং সুপ্রীম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠনের ঘটনার মাধ্যমে পৃথিবীর এত বড়ো একটি বিপ্লবকে সংবিধানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আজ বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন যখন বলেন যে, বর্তমান সরকার একটি সাংবিধানিক সরকার এবং সুপ্রীম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সরকার, তখন বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের সমস্ত স্পিরিটকেই নস্যাৎ করে দেওয়া হয়।
নির্বাচন সম্পর্কে এ্যাডভোকেট শিশির মনির অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন, আপনারা যে সব সময় নির্বাচন দাবি করছেন সেটা কোন আইনে দাবি করেছেন? বিএনপি যে সংবিধানের ধারাবাহিকতার কথা বলছেন, তারা কি জানেন যে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ মোতাবেক মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। সংসদ তো ভেঙে গেছে, প্রায় সাড়ে ১৩ মাস আগে। এ অতিরিক্ত ১০ মাস সময়ের পর নির্বাচন হলে সেটা তো সংবিধানের ১২৩ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়।
ওপরে যতগুলো প্রশ্ন করা হলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে এগুলোর কোনো উপযুক্ত জবাব নেই। আর এসব প্রশ্নের যুৎসই জবাব ছাড়া অথবা বিগত ১৩ মাস ধরে এই সরকার যেসব কাজ করেছেন সেগুলোর কোনো রক্ষাকবচ ছাড়া আজ হোক বা কাল হোক বা ২০ বছর পরেও হোক, কেউ যদি আদালতে প্রশ্ন করে তাহলে শেকড়সহ অন্তর্বর্তী সরকার এবং বিপ্লবের দালান হুড়মুড় করে ধসে পড়বে। তাই বলে কি এগুলোর কোনো রক্ষাকবচ বা প্রোটেকশন নেই?
উত্তর, অবশ্যই আছে। আর সেটারই দাবি তুলেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং টক’শোসহ বিভিন্ন সুধী সমাবেশে বলছেন এ্যাডভোকেট শিশির মনির। জামায়াতে ইসলামী বলছে যে, ভবিষ্যতে যেনো কেউ ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব এবং অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে না পারে সেজন্য জামায়াত দাবি করেছে একটি সাংবিধানিক প্রোক্লামেশন। যে প্রোক্লামেশন জুলাই সনদ এবং জুলাই ঘোষণাপত্রকে আইনি ভিত্তি তথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেবে। এরপর ঐ সাংবিধানিক ঘোষণা গণভোটে দেওয়া হবে। গণভোটে অনুমোদন পেলে সেটি সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে। এরপর আর বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ থাকবে না।
এখানে এসে জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য ইসলামী দলের সাথে বিএনপি এবং তার জোট সঙ্গীদের লেগেছে বিরোধ। দুর্বোধ্য কারণে বিএনপি এ সাংবিধানিক অর্ডার এবং গণভোটের বিরোধী। এখন তারা নতুন করে বলছে যে সাংবিধানিক অর্ডার এবং গণভোট যদি করতেই হয় তাহলে সেটা নির্বাচনের পরে করা হোক। এর আগে তারা দাবি করেছে যে জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে সে পার্লামেন্ট যে পার্লামেন্ট গঠিত হবে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনের পর। এসব বিষয় নিয়ে এবং সে সাথে অন্যান্য সংস্কার প্রস্তাবসহ মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য কমিশন ৩২টি রাজনৈতিক দলের সাথে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আলাপ আলোচনা শুরু করেছে। আগেই বলেছি, সেপ্টেম্বর মাসও পার হতে চললো। ঐকমত্যের আলাপ আলোচনা কি অনন্তকাল ধরে চলবে?
Email:[email protected]