॥ সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা ॥

বিচারপতি খায়রুল হক দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি দায়িত্ব পালনকালে নানাবিধ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। এমনকি বিচারক হিসাবেও তিনি কখনোই নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন নি। দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আরো অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিচারকাজে রাষ্ট্রীয় সংবিধান, আইন-বিধি, জনস্বার্থ কোনকিছুই বিবেচনায় না নিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা গ্রহণেরও অভিযোগ রয়েছে। তিনি সবচেয়ে ন্যক্কারজনক যে কাজটি করেছিলেন তা হলো জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল। যা জাতীয় সংকট তৈরি এবং ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারকে দীর্ঘ পরিসরে হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম, অপহরণ, গুপ্তহত্যা, আয়নাঘর সৃষ্টি তথা অপশাসন-দুঃশাসন চালাতে পুরোপুরি সহায়ক হয়েছিলো। এমনকি প্রকাশ্য আদালতের ঘোষিত রায় বিচারিক অসদাচারণ ও চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে পরিবর্তনের অভিযোগও রয়েছে তার মধ্যে। যা ছিলো রীতিমত ফৌজদারি অপরাধ এবং তার পদপদবি ও আত্মমর্যাদার সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিহীন। ফলে তার বিরুদ্ধে দেশের বিচার বিভাগ ধ্বংস ও গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ আনা যুক্তিযুক্ত হবে।

মূলত, বিচারপতি খায়রুল হক রাজনৈতিক বিবেচনা ও আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে বিচারকাজ পরিচালনা করতেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। যা পতিত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনকে দীর্ঘায়িত করেছে। এর পুরস্কারস্বরূপ তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদও দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু আগস্ট বিপ্লবের পর তিনি আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। তিনি বিদেশে পালিয়েছেন বলে নানাবিধ গল্পকাহিনীও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তবে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। গত ২৪ জুলাই সকাল সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর ধানম-ির একটি বাসা থেকে তাঁকে আটক করা হয়েছে। গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, সাবেক প্রধান বিচারপতিকে খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জে মোট তিনটি মামলা রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল মামলার মূল রায়দানকারী হিসেবে রাজনৈতিকভাবে সমালোচিত খায়রুল হক। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা মডেল থানায় খায়রুল হকের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতি করে রায় দেওয়া এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা রয়েছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারী ভূঁইয়া বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এ ছাড়া ঢাকাতেও মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পান খায়রুল হক। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে তাঁর নিয়োগ কার্যকর হয়। পরের বছরের ১৭ মে তিনি অবসরে যান। ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই খায়রুল হককে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ মেয়াদ শেষে কয়েক দফা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁকে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়। গত বছরের ১৩ আগস্ট তিনি কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আপিল বিভাগে থাকাকালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল এবং ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার রায় দেন খায়রুল হক। হাইকোর্ট বিভাগে থাকাকালে শেখ মুজিব হত্যা মামলার রায় ও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় দিয়েছিলেন খায়রুল হক। এ ছাড়া তিনি ঢাকার চার নদী রক্ষা, স্বাধীনতার ঘোষকসহ বিভিন্ন মামলায় রায় দেন।

বিতর্কিত সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক শেখ হাসিনার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। পতিত সরকারের আমলে নিয়োগকৃত এ প্রধান বিচারপতির কর্মকা- বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন। হাসিনা সরকারের দীর্ঘ ১৭ বছর যাবৎ ক্ষমতায় অটুট রাখার ক্ষেত্রে তার ন্যক্কারজনক ভূমিকা সবার কাছে নিন্দনীয়। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় বিতর্কিত রায় দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক একজন দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তি। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই তিনি উল্লেখিত টাকা নিয়েছিলেন। বিচারপতিগণের দেশে ও বিদেশে চিকিৎসা খরচ সরকার বহন করে থাকে। অতিরিক্ত টাকা নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এক্ষেত্রে উক্ত টাকা যে অবৈধভাবে নিয়েছিলেন তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ব্যক্তিগত একাউন্টে উক্ত টাকা জমা হয়। জমা হওয়ার তারিখেই তিনি ১ লাখ টাকা উঠিয়ে নেন। ২০০৯ সালের ২৮ জুলাই ২০ হাজার টাকা নগদ উত্তোলন করা হয় এবং অ্যাকাউন্ট পে-চেকের মাধ্যমে ৩৮,৬০০/- টাকা স্থানান্তর করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী যিনি সংসদ সদস্য ছিলেন চেকটি বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। দৈনিক দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ২০১১ সালের ৩০ মে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তার টাকা প্রাপ্তির বিষয়টি অস্বীকার করেন নি। তিনি কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করে দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যান নি, বরং আরো বেশ কয়েকটি বিতর্কিত রায় প্রদান করে সম্পূর্ণ বিচার ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার ঘোষক কে তা ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিষয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে ২৬ মার্চ কালুর ঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তা বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণে সুপ্রতিষ্ঠিত। অথচ ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বিষয়কে তিনি আদালতে টেনে এনে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে রায় প্রদান করেন।

তিনি পুরান ঢাকার মুন সিালেমা হলের মালিকানাকে কেন্দ্র করে দায়েরকৃত মামলায় সম্পূর্ণ অন্যায়, অবৈধ, বে-আইনীভাবে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে উল্লেখ্যযোগ্য দিক ছিল- সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন। এতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকা-কে বৈধতা দেয়া হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে উল্লেখ করা হয়-‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি’। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল তা জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয় এবং ৯ এপ্রিল পাস হয়।

বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক কর্তৃক ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট প্রদত্ত ৫ম সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী আপিল দায়ের করলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা খারিজক্রমে হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল করে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত রায় এবং তার ১৭৪ দিন পরে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। আপিল বিভাগে যারা রায় প্রদান করেন তারা হলেন- তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তোফাজ্জল হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মাদ ফজলুল করিম, বিচারপতি আবদুল মতিন, বিচারপতি বি কে দাস, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এসকে সিনহা। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক আপিল বিভাগের বিচারপতি হয়েও অনেক বিতর্কিত রায় দিয়েছেন। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি নিয়ে আনীত লিভ টু আপিল মামলা কোন শুনানি গ্রহণ না করেই উত্থাপিত হয় নি মর্মে খারিজ করে দেন।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নিরপেক্ষতার জন্য প্রধান বিচারপতির অফিসে কোন সময় কোন রাজনৈতিক নেতার ছবি টাঙ্গানো হতো না। কিন্তু এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হয়েই সর্বপ্রথম তার অফিসে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি স্থাপন করেন। অবসর গ্রহণের পরেও বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক পুরষ্কৃত হয়েছেন। তাকে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয় এবং দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তাকে বিদায় নিতে হয়েছে।

বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সম্পূর্ণভাবে তার বিচার কাজে আওয়ামী লীগের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে প্রধান বিচারপতির পদকে কলঙ্কিত করেন। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের মর্যাদা, ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা হয়েছে। মূলত, গত এক দশকে বাংলাদেশে যে সংকট তার অন্যতম প্রধান স্থপতি সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তার একটি রায়ের কারণেই দেশের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আর এজন্য তাকে পুরস্কৃতও করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে। আগস্ট ঝড়ে সে পদ অবশ্য হারিয়েছেন। পদত্যাগ করেছেন তিনি। তবে খায়রুল হককে নিয়ে আলোচনা থামছে না। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর রায় পরিবর্তন শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।

উল্লেখ্য, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি চলাকালে দেশের শীর্ষ সব আইনজীবী একটি প্রশ্নে একমত পোষণ করলেন। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা বহাল রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা। এমনকি শুনানির সময় মরহুম সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান চরম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলে দেশে বিপর্যয় তৈরি হবে; শুরু হবে গৃহযুদ্ধ। কিন্তু তিনি কারো কোন কথায় কর্ণপাত করেননি। এখানেই শেষ নয়, বরং তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় প্রকাশ্যে আদালতে ঘোষিত রায়ে দু’মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পথ খোলা রেখেছিলেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ১৬ মাস পর যে রায় প্রকাশ করলেন সেখানে তিনি এ অংশটি রাখেননি। আপিল বিভাগের দু’জন বিচারপতি এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। দৃশ্যত আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তই অনুসরণ করেছিলেন খায়রুল হক। যা ছিলো তার বিচারিক অসদাচারণ ও ফৌজদারী অপরাধ।

বিচারপতি খায়রুল হকের এ রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টে এক আলোচনা সভায় এ নিয়ে কথা বলেন তিনি। বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেছিলেন, আমি মনে করি না অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি। পদ্ধতিগত কারণে আপিল বিভাগের রায়ে দেরি হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে সেটা যৌক্তিক সময়, যেমন এক মাসের মধ্যে হতে পারে। কিছুতেই এক-দেড় বছর হতে পারে না। আর অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদেশের অংশ কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যাবে না। সেটা করতে গেলে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন ও শুনানি হতে হবে। কিন্তু তা না করেই যদি রাতের অন্ধকারে, এক-দেড় বছর পর রায় পরিবর্তন করে ফেলেন, তাহলে সেটা ফৌজদারি অপরাধ। মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, রায়ে এ ধরনের পরিবর্তন ফৌজদারি অপরাধ। অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির এ প্রসঙ্গে বলেন, বিচারকদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের মূল হলো আস্থা ও বিশ্বাস। ঘোষিত রায় পরিবর্তন করা ফৌজদারি অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ। এটা দ-বিধির ৪০৬ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একইসঙ্গে এটি বিচারকদের আচরণবিধিরও লঙ্ঘন।

বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। দেশের পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। অথচ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু একটি দলকে খুশী করতে তা কোনভাবেই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি বরং দেশকে রাজনৈতিক সংকটের মুখে ঠেলে দিয়ে তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করেছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর প্রথম নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। সেসময় সংঘাতে ব্যাপক প্রাণহানি হয় এবং সম্পদ বিনষ্ট হয়। একতরফা নির্বাচনের পরও আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নিয়েছিল। তবে সে নির্বাচন রাতের ভোট নামে পরিচিতি পায়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনও বিরোধী দলগুলো বর্জন করে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায় ছাড়াও একাধিক রায়, বক্তব্য, বিবৃতিতে বিচারপতি খায়রুল হকের রাজনৈতিক মতাদর্শ স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে যা কখনো দেখা যায়নি। প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর অবশ্য তাকে পুরস্কৃত করা হয়। তাকে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বানানো হয়। সেখানেও তিনি পুরোদমে সরকারের প্রতি আনুগত্য বহাল রাখেন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মরহুম মাহবুব তালুকদার খায়রুল হক সম্পর্কে তার লিখিত ‘নির্বাচননামা: নির্বাচন কমিশনে আমার দিনগুলো’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির স্থপতি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি-সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। আমি তাকে অরাজনৈতিক ব্যক্তি বললেও মূলত তিনি পর্দার অন্তরাল থেকে দলীয় রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে দাবার চাল দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির আসনে থেকে তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে ঘটনাটি ঘটান, তার নাম সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়। এ রায়ের ফলে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়’। তিনি আরও লিখেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বিচার বিভাগ। গণতান্ত্রিক দেশে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে অনেক যৌক্তিকতা প্রদর্শন করা যেতে পারে। কিন্তু এ ব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত করার জন্য যে নতুন আইনি কাঠামোর প্রয়োজন ছিল, বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ে তা অনুপস্থিত’।

উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক রাষ্ট্রীয় সংবিধান, দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি এবং জনস্বার্থের দিকে খেয়াল না রেখে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারকাজ পরিচালনা করে দেশের বিচার বিভাগকে পুরোপুরি ধ্বংস এবং দেশকে গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। তার বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে ধ্বংস হয়েছে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। তার কারণেই দেশে স্বৈরাচারি ও ফ্যাসিবাদী শাসন দীর্ঘায়িত হয়েছে। একই সাথে আওয়ামী লীগকে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা ও ব্যাপক গণহত্যার সুযোগ করে দিয়েছে। তাই তার বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠেছে সকল মহল থেকেই।

বিলম্বে হলেও তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। তাই তার সকল আমলনামা, অপকর্মের নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে তাকে বিচারের আওতায় আনা উচিত; যাতে আগামী দিনে কেউ খায়রুল হক হয়ে ওঠার সাহস না পান!