DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বাধিকার আন্দোলন

ভাষা সংস্কৃতির বাহন। কোনো দেশের কৃষ্টি-কালচার, আচার-আচরণ, ইতিহাস-ঐতিহ্য তার ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যে দেশের মানুষ বা জাতি যে আদর্শ-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী তাদের ভাষায় সে আচরিত আদর্শই স্বাভাবিকভাবে ফুটে ওঠে।

Printed Edition
Default Image - DS

প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ

ভাষা সংস্কৃতির বাহন। কোনো দেশের কৃষ্টি-কালচার, আচার-আচরণ, ইতিহাস-ঐতিহ্য তার ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যে দেশের মানুষ বা জাতি যে আদর্শ-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী তাদের ভাষায় সে আচরিত আদর্শই স্বাভাবিকভাবে ফুটে ওঠে। ১৯৪৭ সালে মুসলিম সংস্কৃতি ও মুসলিম জাতিসত্তার সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে ভারতবর্ষ থেকে ‘পাকিস্তান’ নামে একটি আলাদা ভূ-খণ্ডের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই এ অঞ্চলের মুসলমানরা তাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করে। ’৪৭ এ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের কল্পনা করা যেতো না।

১৯৪৭-১৯৫২ সাল পর্যন্ত পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালি মুসলমানরা ‘বাংলা’কে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে ভাষাসৈনিক ডাকসুর জি. এস. গোলাম আযম (পরবর্তীতে অধ্যাপক গোলাম আযম) ৩৪ দফা দাবি সম্বলিত যে স্মারকলিপি পেশ করেন, তার মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল-‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি’। অন্যান্য ভাষাসৈনিকদের মতো ভাষা আন্দোলনের কারণে অধ্যাপক গোলাম আযমকে ১৯৫২ ও ১৯৫৪ সালে দু’বার কারাবরণ করতে হয়।

সে ঐতিহাসিক স্মারকলিপিতে ভাষার দাবির সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ ও মুসলিম সংস্কৃতির সঠিক মূল্যায়নের প্রস্তাবনাও ছিল জোরালোভাবে। মানুষের তৈরি মনগড়া কোনো মতবাদ ও বিজাতীয় কোনো অপসংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সেদিন রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন সংঘটিত হয়নি।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো-আজো আমাদেরকে আমাদের মুসলিম জাতিসত্তার অস্তিত্ব ও মুসলিম সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য, মাতৃভাষা ‘বাংলা’কে রাষ্ট্রীয় নির্দেশে সর্বস্তরে মর্যাদার আসনে সমাসীন করার জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে।

১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ ও ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলন পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। দীর্ঘ নয় মাস অসংখ্য দেশপ্রেমিক জনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও জীবন উৎসর্গের বিনিময়ে আমরা বিশ্বের মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের অভ্যুদয় ঘটাতে সক্ষম হই। কিন্তু আমাদর জাতিগত স্বকীয়তা ও মৌলিক অধিকার তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শাসনের নামে স্বৈরাচার নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র বিধ্বংস হয়েছে। আমাদের স্বদেশ, স্বাধীন ভূখণ্ড বিজাতীয় সংস্কৃতি, উলঙ্গপনা, বেহায়াপনার সয়লাবে প্লাবিত হয়েছে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিজাতীয় সংস্কৃতি আর বিভাষাপ্রীতি আমাদের দেশপ্রেম, ঈমান-আকিদা ও নৈতিক চরিত্রকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

নতজানু পররাষ্ট্র নীতিতে আধিপত্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ থাবা বিস্তার করেছে। গোলামী চুক্তিতে আমাদের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনে জাতির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে। যার দ্রোহী ফলশ্রুতিতে ২০২৪ এর জুলাই আগস্টে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ায় স্বৈরাচারগোষ্ঠী বিড়ালের মতো পেছন-দরজা দিয়ে স্বদেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছে।

এখন একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে আপামর জনতা অবাধ নিরাপত্তায় ভোট প্রদান করে দেশপ্রেমিক, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করতে পারে। অর্জন করতে পারে নৈতিক শিক্ষা ও বেঁচে থাকার জন্য সার্বিক স্বাধিকার। ঈমানদার, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের দায়িত্বশীলরা যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তারা আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ মোতাবেক চারটি কাজ পরিচালনা করবে। আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা :

“যদি তারা (প্রকৃত ঈমানদারগণ) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তবে তারা রাষ্ট্রের সর্বস্তরে চারটি কাজ বাস্তবায়ন করবে।

১. সালাত কায়েম করবে পরিবার ও রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে (সংসদ, অফিস, আদালতে) সততা প্রতিষ্ঠার জন্য

২. যাকাত আদায় ও সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করবে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য

৩. সর্বস্তরে সৎ ও মানবিক কাজের নির্দেশ জারি করবে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য

৪. অসৎ কাজ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ধোঁকা, প্রতারণা, লুটতরাজ, স্বৈরাচার বন্ধের নির্দেশ দিবে জনস্বার্থ রক্ষার জন্য। (সূরা আল হজ্জ-৪১)

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করুন, যাতে সকল পেশার মানুষ নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে মহৎ ও যোগ্য লোকদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাচিত করতে পারে। যারা সার্বজনীন বিধান আল কুরআন ও আসসুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

লেখক : শিক্ষাবিদ।