নূরুন্নাহার নীরু

সম্প্রতি বাংলা নববর্ষ উদযাপন সম্পর্কে সাংস্কৃতিক উপদেষ্টার ইতিবাচক ইঙ্গিত দেশবাসীকে “মঙ্গল শোভাযাত্রা” সংক্রান্ত অন্ত:সার শূন্য রেওয়াজের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা থেকে নিবৃত্ত রেখেছে। তাঁর “মঙ্গল শোভাযাত্রা” শব্দটারই বদলে দেয়ার ঘোষণা জাতিকে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করেছে। তবু বলবো এসব যেন ভিন্ন নামে ভিন্ন আঙ্গিকে পুনরাবৃত্তির পাঁয়তারা না হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সদ্যসমাপ্ত হওয়া ঈদুল ফেতর উপলক্ষে প্রদর্শিত শোভাযাত্রা জনমনে নানাবিধ প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। কী করতে চাচ্ছেন সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা? কোনদিকে যাচ্ছে আমাদের “ঈদ সংস্কৃতি?” এভাবে নববর্ষ উদযাপনেও আবার নতুন কোন অপসংস্কৃতির অবতারণা ঘটতে যাচ্ছে নাতো?

পহেলা বৈশাখের উৎপত্তি ও মঙ্গল শোভাযাত্রা সম্পর্কে বিভিন্ন বই, পত্রপত্রিকা উইকোপিডিয়া পড়ে আমি যতটুকু জেনেছি তা হচ্ছে; খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা সন গণনা, বাংলা মাসের নামকরণ, বাংলা বারের নামকরণ সহ সম্পূর্ণ বাংলার একটি সনের অস্তিত্ব তৈরি করার জন্য দায়িত্ব দেন কবি ও জ্যোতিষবিদ ইরানী সভাষদ ফতুল্লাহ সিরাজীকে। যার নামানুসারে নারায়ণগঞ্জের একটি জায়গার নাম ফতুল্লাহ হয়ে ইতিহাস স্বীকৃত হয়ে আছে। বলাই বাহুল্য, তৎকালীন ভারতবর্ষের উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলা ভাষার চর্চা ও সমৃদ্ধি বিকাশের জন্য ভারতবর্ষের মুসলিম শাসকরা অনেক কালজয়ী কাজ করে গেছেন তারমধ্যে বাংলাসনের উৎপত্তি অন্যতম। তারই ধারাবাহিকতায় সম্রাট আকবর কর্তৃক ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে কবি ফতুল্লাহ সিরাজী দীর্ঘ তিনবছর গবেষণা করে বাংলা সন, মাস, সপ্তাহে সাতদিনের নামকরণ এবং পঞ্জিকা তৈরি করেন।

যাহোক এখন বাংলা সনের প্রবর্তন করার সুবিধানুযায়ী বছরের ১ম মাসটি তথা ১ম দিনটিকেই ধরা হয় হিসেব সংরক্ষণের মাধ্যম হিসেবে। সে অনুযায়ী খাজনা আদায়ের জন্য চলে একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। শুরু হয় রাজ প্রাসাদের চত্বরে প্রজাদের আগমন। এ উপলক্ষে চলে কুশলাদি বিনিময়, মণ্ডামিঠাই বিতরণ, উপঢৌকন আদান-প্রদানসহ নানা সামাজিকতা। ওই সামাজিকতাকে মাথায় রেখে একসময় শুরু হয় ব্যবসায়িক ভাবনা ফলে গড়ে উঠে দোকানপাঠ, হাটবাজার, বিকিকিনি। এখানে পিঠাপুলি, মুড়কিমুড়ি সহ তৎকালীন ঐতিহ্যবাহী খাবারও চালু ছিল। তবে ছিল না পান্তা বা ইলিশ খাওয়ার হিড়িক। এমন কি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বলেও কোনো বাগাড়ম্বরতা। সবই কালের পরিক্রমায় উদ্ভাবিত।

আমাদের দেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের উদ্ভব এ দেশে পুরনো সংস্কৃতি। যা ছিল বর্তমান সময় থেকে একেবারেই ভিন্ন। এ দিনে প্রধানত দোকানে দোকানে হাল খাতা চলতো, মেলা বসতো। মূলত হিসেব নিকেষের সুবিধার্থে বর্ষবরণ হিসেবেই আমরা এটিকে নিয়েছি বলেই এ ধরনের আয়োজন থাকতো। প্রত্যেক জাতিরই বর্ষবরণ তথা নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা আছে। যেমন, ইংরেজদের ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’, আরবদের ‘নওরোজ’ ইত্যাদি উৎসব।

আমরা জানি, কুরআন হাদীসের ভাষায় নির্মল আনন্দে কোনো দোষ নেই। সুতরাং মুসলিম হিসেবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আনন্দ-উৎসব করতে গিয়ে কোনো বেদাত বা শিরকে জড়িয়ে না পড়া। কিন্তু বাস্তবিকই কি আমরা এমন বর্ষবরণের উৎসবে পারছি শিরক-বেদাত বিচ্ছিন্ন পরিবেশে থাকতে? বরং মুসলিম জনগোষ্ঠী হয়েও কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে আমরা মুসলিমরাই যেন এসব নিষিদ্ধ কাজে দিন দিনই অতি উৎসাহী হয়ে উঠছি ক্রমান্বয়ে। বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামের এ আনুষঙ্গিকতা এতে আরো নতুন মাত্রা যোগ করেছে যার ব্যাখ্যা করতে গেলে পাওয়া যাবে এর অন্তঃসার শূন্যতা। যেমন : ১. প্রচলিত মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎপত্তি হয়েছে মাত্র ১৯৮৯ সালে। অথচ বলা হয় এটি হাজার বছরের ঐতিহ্য যার কোনো প্রমাণ নেই। ২. বলা হয় এর পেছনে একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষিত নিহিত। অর্থাৎ তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মূলে কুঠারাঘাত। কিন্তু প্রশ্ন জাগে- এ অযুহাতের আড়ালে মূল উদ্দেশ্য যেন বিশেষ কোন ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলেই কুঠারাঘাত! ৩. যেসব জীবজন্তু পশুপাখীর প্রতিকৃতি বহন করে শুভাশুভের আরাধনা করা হয় তা হাস্যকর। কেননা যে মানবজাতিকে সৃষ্টির সেরা জীব বানানো হলো এমন কি শুধু বানানোই নয় তাদের চলার পাথেয় হিসেবে সঠিক পথনির্দেশিকা (আল কুরআন) দেয়া হলো তারা কিনা সমাজের মঙ্গল কামনা করছে ঐসব ইতর প্রাণীর কাছে! এখানেও জ্ঞানধ্যানের নিকৃষ্টতাই প্রমাণিত। ৪. রামেন্দ্র মজুমদারেদের মত কিছু সেকুলারদের উৎসাহে উৎসাহিত হয়েই একটি জনগোষ্ঠী একে লালন করে আসছিল। এটি এখনো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধ্যানধারণা থেকে বিচ্ছিন্নই রয়ে গেছে। ৫. প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার একটা প্রাতিপাদ্য বিষয় থাকে আর সেটিও নির্ধারণ করে আমাদের চারুকলার ছাত্ররা। তরুণ হিসেবে এটি প্রসংশনীয় বটে। তবে এমন একটী জাতীয় উৎসবের জন্য তাতে জাতির মনমানসিকতা, ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ছিল উপেক্ষিত।

আমি বলবো চারুকলার শিক্ষার্থীদের শৈল্পিক প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর এটি একটি মাধ্যম বিশেষ তাই তারা এত উৎসাহী। সে সাথে ধর্ম সম্পর্কে ঔদাসীন্য বরং তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে মূলতঃ শির্ক, বিদআ’তের দিকেই। অথচ এতোদিন সেখানে কতিপয় বিজ্ঞজনদের আগবাড়িয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার বাহক সেজে ঐসব কোমলমতিদেরে “মিসগাইড” করার যে পাঁয়তারা ছিল তা কি প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার বা একটা সত্য-সুন্দর-শুদ্ধতম কালচারের মূলে কুঠারাঘাতের প্রচেষ্টাই নয়? যেহেতু বলাই বাহুল্য এদেশ মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠের দেশ। আর আমাদের শিক্ষার্থীরাও অধিকাংশই মুসলিম পরিবারের সন্তান সেহেতু সংস্কৃতি হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশ্বাসের ভিত্তিতে। এটাই স্বাভাবিক। তবে এটিও সত্য এ দিবস বিশেষ কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের নয় এটি সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের সম্মিলনে একটি মঙ্গলময় শুদ্ধ সংস্কৃতি হিসেবেই জেগে উঠবে। গড়ে উঠবে অন্তঃসারশূন্যতা হীন কোন অর্থবহ সংস্কৃতি! বর্তমান সংস্কৃতি উপদেষ্টার প্রতি জাতির প্রত্যাশা ওখানেই।

বলাই বাহুল্য, যে জাতির নীতি-নৈতিকতায় এখনো গড়ে ওঠেনি কোনো শ্লীলতা, সভ্যতা, ভদ্রতা, ভব্যতা; যেখানে ২০-৬০ বছরের একটি মহিলারও নেই নিরাপত্তা, নেই সমাজের পরতে পরতে শোষণ মুক্ততা, তারা নাকি শুদ্ধতা চায় পেঁচা, ইঁদুর, বাঘ জাতীয় হিংস্র, ইতর প্রাণীর কাছে! এটা কি বাতুলতা বা জাতির বালখিল্যতা নয়?

বিগত ২০১৯-২০২১ সাল অব্দি প্রায় তিন বছর ধরে চলমান বৈশ্বিক অতিমারী বিশ্ববাসীর জন্যে ছিল একটি বিশেষ অনুভূতি উন্মোচনের বিষয়। কে ঠেকাতে পেরেছে ঐ মহামারী? কখনো কমেতো আবার বাড়ে, একই ওষুধেই কেউ বাঁচেতো কেউ মরে। এহেন অবস্থায় তৎপরবর্তী দু বছর পর বাংলাদেশে পুনরায় উদযাপিত হয়েছিল বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। কিন্তু সেবারে নতুন যোগ হলো মঙ্গল সঙ্গীত- পাশাপাশি শোভা যাত্রাতো আছেই। দৃশ্য দেখে শুধুই মনে হচ্ছিল, এ দেশের সংস্কৃতি নির্মাণের দায়িত্ব যেন চারু কলার শিক্ষার্থীদেরইÑ তারা যেন ইজারা নিয়ে নিয়েছে এ কাজের। চারুকলার শিক্ষার্থীরা যেন ভিন্ন কোনো গ্রহের ভিন্ন কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠায় নিরলস এগিয়ে চলছে-মঙ্গল সঙ্গীত তারই সংযোজন!

ভুলে গেলে চলবে না আমরা শুধুই বাঙালি নই- বাঙালী মুসলিম। মুসলিম হিসেবে আমাদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে, ঐতিহ্য আছে। তার সাথে বাঙ্গালীত্ব যোগ হয়ে আমরা পরিপূর্ণ। কিন্তু সেই বাঙালী সংস্কৃতিটি কী? সেটিই যেন আমরা জানি না। ফলে যার যেভাবে ইচ্ছা সংযোজন করছি নতুন নতুন কালচার।

এখন এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সবার কাছে আহবান আসুন আমরা মঙ্গল পেতে আল্লাহ মুখী হই, আল্লাহর বিধানকে যথাযথ ভাবে বুঝে নিই। তারই কাছে ধর্ণা দেই। বছরের প্রথম দিনটিতে বিশেষভাবে তাকেই স্মরণ করি, কিছু কমিটমেন্টে আসি। তবেই সেটি হবে সত্যিকারের শুদ্ধতা। আগামীর বর্ষবরণ হোক প্রকৃত শুদ্ধতায় পরিপূর্ণ। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত নতুন চমক প্রদানের দিকে সে আশা নিয়েই তাকিয়ে আছি আমরা বাংলাদেশীরা। আমরা ভুলে যাব না সুরা আত তাগাবুনের সেই বাণীটি : “কোন মুসীবতই আসে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর যে কেহ ঈমান আনবে আল্লাহর প্রতি, আল্লাহ তার অন্তরকে পরিচালিত করবেন সঠিক পথে। আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞানী।”

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।